ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ১৬)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

১৬।।
আমাদের মাঝিদ্বয় তাড়াতাড়ি নৌকা নিয়ে লাগালো সেই নৌকার পাশে। আমরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ঝুঁকে পড়লাম সেই নৌকায়। জ্যান্ত ইলিশ দেখে আমরা বিস্মিত, আনন্দে আত্মহারা। জেলেরা আমাদের চোখের সামনে মাছ চারটি ছাড়িয়ে নৌকার খোলে রাখল। দুইটি মাছ প্রমাণ সাইজের, আর দুইটি মাঝারি আকারের। খোলে রাখতেই মাছগুলো লেজ দিয়ে খোলে দুই/তিনবার ভীষণ আঘাত করল। মনে হল নৌকার খোল ভেঙে ফেলবে। তারপরই শান্ত। স্বল্পপ্রাণ বোঝাতে আমরা পুঁটি মাছের প্রাণ বলি। ইলিশ মাছের প্রাণও বলা যায়।
জ্যান্ত ইলিশ মাছ দেখার স্বাদ পূরণ হল। মানুষের জীবনে এমনসব অভিজ্ঞতা চলে আসে যা তার কল্পনায়ও থাকে না। ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় আমরা কি ভাবতে পেরেছিলাম যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখবো, পদ্মার বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াবো, জ্যান্ত ইলিশ দেখবো? এসবই হলো আকমল ভাইয়ের কারণে। আমরা মনে মনে আকমল ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম।
রাত দুইটা। এতখানি সময় কিভাবে চলে গেল টেরই পেলাম না।
আমরা বেশ ক্লান্ত। একটু ঘুমানো দরকার। আকমল ভাই মাঝিদ্বয়কে বললেন: নৌকা তীরে নিয়ে যান। আমাদের বিশ্রামের দরকার।
মাঝিদ্বয় তীরের দিকে নৌকা ছাড়ল। এবার আর হাল-বৈঠা দিয়ে নয়। ইঞ্জিন চালু করে দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা তীরে ফিরে এলাম।
নৌকা তীরে ভিড়লে আমরা সবাই নিচে নামলাম। চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে শরীর চাঙ্গা করলাম। পাবলিক টয়লেট ছিল। যার প্রয়োজন টয়লেট ব্যবহার করলো। তারপর ফিরে এলাম নৌকায়।
মাঝিদ্বয় খুব করিৎকর্মা। নৌকার দুই পাশে লগি পুতে খুব শক্ত করে নৌকা বেধে ফেলেছে। ছৈয়ের সামনে পলিথিন জুড়ে দিয়ে ছৈটাকে বড় করেছে। সবাই শুতে না পরলেও হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারবো। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না।
হাত-পা ছড়িয়ে বসতে না বসতেই ঘুম।
ঘন্টা দেড়েকের মতো ঘুম হয়েছে। বাঁশির শব্দ। ক্লান্তির ঘুমে বাঁশির শব্দ তেমন কোনো উৎপাত না। অন্যের কী হচ্ছিল তা জানি না। আমি তখন স্বপ্নের মধ্যে স্কুলের মাঠে গেম টিচার আলমগীর স্যারকে বাঁশি বাজাতে দেখছিলাম। বাঁশির শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। আমি অবাক হচ্ছিলাম যে, গেম টিচার আলমগীর স্যার (আমরা ডাকি বাদশা আলমগীর স্যার) এত জোরে বাঁশি বাজাচ্ছেন কেন? তিনি তো সাধারণত বাঁশি বাজানোর জন্য রাখেন না। পিটি ক্লাশে তিনি বাঁশিটা ব্যবহার করেন আমাদের বাড়ি দেয়ার জন্য। ফিতায় ঝুলানো একটা লোহার বাঁশি। পিটি করার সময় কারও পায়ে একটু তাল ভঙ্গ হলে ঠাস করে এক বাড়ি। যেখনে লাগে সেখানে ভীষণ জ্বলে। আমরা প্রায়ই ভাবি, একটা প্লাস্টিকের বাঁশি যদি বাদশা আলমগীর স্যারকে দেয়া যেত! কিন্তু তা দেবে কে? বদশা আলমগীর স্যার বাড়ি দিয়ে বলেন: পা ঠিকমতো উঠে না কেন? প্যারালাইজড হয়েছে?
বাদশা আলমগীর স্যার আমাকে ঠাস করে এক বাড়ি দিলেন। অমনি ধপ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। টুটে গেল আমর স্বপ্ন। দেখি কোনো পিটি ক্লাশ নয়। আলমগীর স্যারও আমাকে বাড়ি দেননি। মাহাবুব ভাই কুনোই দিয়ে গুঁতো দিয়েছেন। মাহাবুব ভাই বললেন: দেখতো এত রাতে বাঁশি বাজায় কোন ছাগলে।
এতক্ষলে বাঁশির শব্দ আমাদের নৌকার কাছে চলে এসেছে। সবারই ঘুম ভেঙে গেছে। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। তারা ঠিক নৌকার গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে। আকমল ভাই বললেন: এ দেশের পুলিশের আর আক্কেল বলে কিছু হবে না। মানুষ ঘুমাচ্ছে, আর তারা এসে জান-প্রাণ দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পিচ্চি বাচ্চা মেলা থেকে বাঁশি কিনে এনেছে।
একজন পুলিশ বলল: নৌকায় যারা আছেন নেমে আসুন।
গুল্লু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল: আমাদের নামতে বলছে!
আকমল ভাই আর মাহাবুব ভাই নৌকার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাহাবুব ভাই বললেন: আমাদের নামতে বলছেন কেন?
মোটা ও বেঁটে পুলিশটা বলল: আমাদের সন্দেহ হচ্ছে।
: কী সন্দেহ?
: নৌকায় আর কে কে আছে?
: কয়েকটা স্কুল পড়ুয়া ছেলে আছে।
: সন্দেহটা এখানেই।
: এখানে কী সন্দেহ?
: আপনারা শিশু পাচারকারী।
: বাজে কথা বলবেন না। মাহাবুব ভাই ধমক দিলেন।
মাহাবুব ভাইয়ের ধমকে পুলিশ টললো না। আরও দৃঢ় কন্ঠে বলল: বাচ্চাগুলোসহ নেমে আসুন।
মাহাবুব ভাই খাবি খেয়ে গেলেন। তার মুখে আর ভাষা নেই। আকমল ভাই বললেন: আমি একজন চিত্রশিল্পী। ছাপচিত্রের ওপর স্পেনে ছয় মাসের ট্রেনিং আছে।
এবার লম্বা ও পাতলা পুলিশ এগিয়ে এল। বলল: আমারও স্পেনে ট্রেনিং আছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।