ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৩০)

দার্শনিক হেলাল ভাই

আগুন লেগে গেল মোজাফ্ফরের পরনের লুঙ্গি আর জামায়। আগুন লেগে গেছে ঘরে অন্যান্য আসবাবপত্রে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা ছুটোছুটি করে পানি এনে আগুন নেভাতে চেষ্টা করলাম। আশেপাশের দোকানের মানুষ এবং পথচারীরাও সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মফিজ ফায়ার সার্ভিসে ফোন করল।
আর হেলাল ভাই? হেলাল ভাই মোজাফ্ফরের গায়ে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে বাঁচাল। কিন্তু হেলাল ভাই আহত হল অনেকটা। তার বুক আর হাত-পায়ের বেশ কিছুটা পুড়ে যায়।
আধা ঘন্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস আসে। তবে তার আগেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়। মানুষেল ঐকান্তিক সহযোগিতা ছিল। তা না হলে বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেত। আশেপাশের দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়লে পাশের বহুতল ভবনেও আগুন লেগে যেতে পারত।
আমরা মোজাফ্ফর আর হেলাল ভাইকে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে।
হাসপাতালে গিয়ে যথাযথভাবে ভর্তি করতে পারলাম। ডাক্তাররাও যথেষ্ট সহানুভূতি আর গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিলেন। বললেন: অল্পতে রক্ষা হয়েছে। ক্ষত আর একটু বেশি হলে বিপদ হতে পারত।
আমরা ছুটোছুটি করে ওষুধ, ফল, অন্যান্য খাবার আনতে লাগলাম। এরই মাঝে হেলাল ভাই আমাদের কয়েকজনকে তার বিছানার পাশে ডেকে নিল। বলল: আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
আমরা খুব অবাক হলাম। এরকম অবস্থায় হেলাল ভাই কী অনুরোধ করতে চায়?
হেলাল ভাই বলল: মহামানুষদের চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ কোনটা জানিস?
আমরা জিজ্ঞাসা দৃষ্টি মেলে তাকালাম হেলাল ভাইয়ের মুখে। মহামানুষদের বড়গুণ নিয়ে আলোচনার করার সময় তো এটা না। এসব নিয়ে তো মোজাফ্ফরের দোকানে কতই আলোচনা হয়েছে। হেলাল ভাই সুস্থ হয়ে ফিরে গেলে আবার হবে।
হেলাল ভাই বলল: মহামানুষদের চরিত্রের সবচেয়ে বড়গুণ হল ক্ষমার আদর্শ। যার ভেতর ক্ষমার আদর্শ নেই, শত গুণে গুণান্বিত হলেও সে মহামানুষ হতে পারবে না।
আমি বলললাম: হেলাল ভাই, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন তা সংক্ষেপে বলুন। ডাক্তার আপনাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
আমি বলতে চাই: আফজাল ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেন কোনো কেস-কারাবি না হয়। এমনকি এলাকার মুরুব্বিরা কোনো রকম বিচার-শালিসের আয়োজনও যেন না করেন। যা হবার হয়েছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক লোকটা একটা আচরণ করেছে, আর তাতে ঘটেছে একটা দূর্ঘটনা। সে গাব্বুর দিকে তেড়ে গিয়েছিল তা ঠিক, কিন্তু আগুন লাগানোর কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। এটা একান্তই অনিচ্ছায় হয়েছে।
আমাদের চোখে জল চলে এল। সত্যিই হেলাল ভাই অনেক বড় মনের একজন মানুষ। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এরকম মানুষ পাওয়া সহজ কথা নয়। আমরা কেউ কিছু বলতে পারছিলাম না।
হেলাল ভাই বলল: তোরা আজ বাসায় ফিরে যার যার বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবি। আফজাল ভাইকে এ কারণে ডাকা হলে, থানা-পুলিশ হলে আমি খুবই কষ্ট পাব। সব সময় থানা-পুলিশ, শাস্তি এসব মানুষকে সুন্দরের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে আরও আগ্রাসি করে তোলে। কিন্তু ক্ষমা আর ভালোবাসা সব সময় মানুষকে সুন্দরের পথে নিয়ে আসে।
গাব্বু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল: ঠিক আছে হেলাল ভাই, আপনি যেমন চাচ্ছেন তেমনই হবে। আমরা বাসায় ফিরে আমাদের যার যার বাবার সাথে কথা বলব।
: কান্নাকাটি করছিস কেন? কান্নাকাটি করার মতো কিছু ঘটেছে কি?
: আপনার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল, এই সুখে কাঁদছি হেলাল ভাই।
: পাগলের মতো কথা বলিস।
যাচ্ছিলাম হেলাল ভাই আর মোজাফ্ফরের জন্য ডাবের পানি আনতে। হাসপাতালের লম্বা বারান্দা দিয়ে হাঁটছিলাম দ্রুত পায়ে। তখন আমার ফোন বেজে উঠল। একটা অপিরিচত নাম্বার। ফোন রিসিভ করে বললাম: হ্যালো, স্লামালিকুম।
: অলাইকুম। আমার সাথে তোমরা খেলা পেয়েছো না? খেলা আমি ছুটাব। আমাকে কী মনে করছো তোমরা? মনে করছো তোমাদের কিছুই করতে পারবো না, তাই না? তোমরা আমার সাথে খেলা করেই যাবে। আবার সামনে পড়ে নাও, দেখাব আমি কী করি। মারামারি করব। তোমাদের সবগুলার সাথে আমি একা মারামারি করব। দুই/চারটার নাক যদি ফাটিয়ে না দিয়েছি তো…..। এলাকায় লেডি মাস্তান হিসেবে আমার পরিচয় রটে যাবে।
একদমে একটা প্যারাগ্রাফ বলে গেল। মেয়ে কন্ঠ। কন্ঠটা মিষ্টি। এত যে রাগান্বিতভাবে কথা বলল, তাও শুনতে মন্দ লাগেনি। প্রকৃতি মেয়েদেরকে এত যত্ন করে তৈরী করেছে যে, রাগের সময়ও তাদের কন্ঠ মিষ্টি থাকে।
আমি বললাম: দয়াকরে আপনার পরিচয়টা দিবেন?
: আমি তোমার নানী।
: নানী! আমার নানী অতিশয় বৃদ্ধ। ফোনে কথা বলতে পারেন না। কারণ তিনি কানে শুনেন না।
: সব নানীরে একরকম মনে করো না। ইয়াং নানীও আছে। আমাকে মিকাডোতে বসিয়ে রেখে…..। এর শোধ যদি আমি না নিয়েছি আমার নাম রিনি না। আমার নাম রাখবো কৈতুরী বেগম।
মিকাডোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, রিনি কথা বলছে। আমি বললাম: রিনি, খুব সমস্যা হয়ে গেছে।
: কিসের সমস্যা? আমি মেয়ে হয়ে টিচারের বাসা থেকে এসে বসে থাকতে পারি আর তোমরা…..।
: রিনি, হেলাল ভাইয়ের শরীর আগুনে পুড়ে গেছে।
: কী!
মিকাডোতে যাবার জন্য আমরা মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছিলাম। সেখানেই আগুন লাগে। হেলাল ভাই আর মোজাফ্ফরকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আমরা সবাই এখন হাসপাতালে।
: এ কী বলছো তুমি! হেলাল ভাইয়ের শরীর পুড়ে গেছে। কীভাবে আগুন ধরল?
রিনি ফসফস করে কাঁদতে শুরু করল। কান্না অনেক দেখেছি ও শুনেছি। ফোনের ভেতর কান্নার শব্দ কখনো শুনিনি। কেমন অদ্ভূত শোনাচ্ছিল। রিনি কাঁদে আর বলে: কী হয়েছে আমাকে বলো। আফজাল ভাই কিছু……? ওর নাক আমি ফাটিয়ে দিব। ও অনেক দিন ধরে এলাকায় মাস্তানি করে যাচ্ছে। ওর মাস্তানি আমিই ছুটাব।
রিনি আফজাল ভাইকে সন্দেহ করে ফেলেছে। মেয়েদের অনুমান ক্ষমতা খুবই তীক্ষ্ম। আমি বললাম: আরে বাই চাঞ্চ……।
আমি আফজাল ভাইয়ের কথা চেপে গেলাম। কারণ, হেলাল ভাই নিষেধ করেছে আফজাল ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতে। রিনি মাথা গরম মেয়ে। আফজাল ভাইয়ের কারণে হেলাল ভাইয়ের শরীর পুড়েছে এ কথা জানলে মাথা ঠিক রাখতে পারবে না।
রিনি বলল: কোন হাসপাতালে বলো।
: আমি রিনিকে হাসপাতালের ঠিকানা দিলাম।
হাসপাতাল থেকে হেলাল ভাই ছাড়া পেল চারদিন পর। ছাড়া পেয়ে তারা গ্রামের বাড়িয়ে ঘুরতে গেল। বলে গেল, এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবে।
আমরাও ভাবলাম, তার কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিত। একটু চেঞ্জ দরকার।
এক সপ্তাহের কথা বলে গেল। কিন্তু মাস অতিক্রান্ত হতে চললো অথচ হেলাল ভাইয়ের ফেরার কোনো নাম নেই। তার সেলফোনে ফোন করলে বন্ধ। তাদের গ্রামে কি নেওয়ার্ক থাকে না? আজকাল তো যে কোনো অপারেটরেরই সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে।
শ্রাবণ মাস। বর্ষাকাল চলছে। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিতে হেলাল ভাইয়ের সাথে মোজাফ্ফরের দোকানে বসে গরম পিঁয়াজু, আলুচপ আর মুড়ি খাব। চা খাব। অথচ হেলাল ভাই নেই। হেলাল ভাইকে ছাড়া মোজাফ্ফরের দোকানে এখন আর আমরা বসতে পারি না। শূন্যতা গ্রাস করে আমাদের। মোজাফ্ফরও মন খারাপ করে বসে থাকে। ব্যবসায় সুখ পায় না। বলে: হেলাল ভাইয়ের কোনো খোঁজ করতে পারলা না। তার গ্রামের বাড়িতে যাও।
এদিকে রিনি আর ঝিনি আপাও অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রেমের ব্যাপারে অস্থির না। হেলাল ভাইয়ের কোনো অঘটন ঘটল কিনা সেটা ভেবে অস্থির। এতবড় একটা দুর্ঘটনা থেকে উঠেছে।
একদিন আমার নাম্বারে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এল। বলল: আমার নাম রিংকু। আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। তোমার নাম্বারটা বেশ কিছুদিন আগে হেলাল ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়েছিলাম।
: আচ্ছা, কী বলতে চাও বলো।
: হেলাল ভাইয়ের নাম্বারটায় কল ঢুকছে না।
: হেলাল ভাইয়ের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?
: হেলাল ভাই আগে আমাদের পাড়ায় থাকত। আমরা হেলাল ভাইকে অনেক ভালবাসি। তোমাদের পাড়ায় গেলেও হেলাল ভাইয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। এখন একেবারে বিচ্ছিন্ন।
: আমরাও হেলাল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফিরে আসবে বলে তারা গ্রামে গিয়েছিল। এখন….।
: বলো কি! খুব চিন্তায় ফেললে।
তারপর মোহন নামে আরেকটা ছেলে দু’দিন পর আমাকে ফোন করলো। সেও টিংকুর মতোই কথা বললো আমাকে।
হেলাল ভাই মাঝে মাঝেই ফোনে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে ফোনে কথা বলতো। কখনো কখনো কারও সাথে দেখা করতে যেত তাও জানতাম। তখন বুঝতে পারলাম, হেলাল ভাই অন্য যেসব এলাকায় আগে থেকেছে, ওরা সেসব এলাকার ছেলেপেলে। হেলাল ভাইকে ভুলে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
একদিন হঠাৎ এক ঝলকের জন্য হেলাল ভাইয়ের বাবাকে দেখলাম। রিকশা করে যাচ্ছিলেন। তার মানে তারা গ্রাম থেকে এসেছেন। তাহলে হেলাল ভাই কোথায় ?

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।