ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ১)

দার্শনিক হেলাল ভাই – ১

কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা শত চেষ্টায়ও নেতা হতে পারে না। যেমন, আমাদের আফজাল ভাই।
আফজাল ভাইয়ের চেহারা-সুরত ভাল। মানানসই উচ্চতা। দরাজ কন্ঠ। কথাও বলতে পারে বেশ। কিন্তু প্রাণপন চেষ্টায়ও নেতা হতে পারছে না। দিন-রাত আমাদের হুমকি-ধামকি দেয়, এটা করবি-ওটা করবি, এভাবে চলবি-ওভাবে চলবি। ঐ পর্যন্তই। তার আদেশ মতো আমরা কিছু করিও না, চলিও না।
কিন্তু এই হেলাল ভাই? টিংটিং-এ শরীর, চোয়াল বসে যাওয়া মুখ, ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর। কেমন করে সে আমাদের নেতা হয়ে গেল, আমরা কেউ টেরই পেলাম না। হেলাল ভাই উঠতে বললে উঠি, বসতে বললে বসি।
হেলাল ভাইয়ের সাথে আমাদের প্রথম দেখা মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে।
আমি, রান্টু, ফেকু, গাব্বু, বল্টু আরও কয়েকজন বিকেলে চা খেতে গেছি। চা খাওয়া মানে আড্ডা দেয়া। দেখি অপরিচিত একজন লোক বসে আছে। যুবক লোক। ভাবলাম, বাইরের কেউ হবে। চা খেয়ে চলে যাবে।
ও মা! ওঠার নাম নেই। চা খেয়ে সিগারেট ধরাল। রিং বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। সিগারেট শেষ করে আরেক কাপ চা। চা শেষ করে আরেকটা সিগারেট। আবার রিং বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়া।
বিকালের নরম আলো মরে গিয়ে আবছা অন্ধকার নেমে এল। লাইটপোস্টের আলো জ্বলে উঠল। কা কা করা দাঁড়কাকগুলো কোথায় যেন চলে গেল। কিন্তু লোকটার ওঠার নাম নেই।
ফেকু আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল: চেহারাটা কিন্তু দার্শনিকের মত।
আমি জীবনে কোনোদিন দার্শনিক দেখি নাই। দার্শনিকের চেহারা কেমন হয় জানি না। ফেকুর কথাটা আমার ভেতর গেঁথে গেল। আমার মনে হল, দার্শনিক এমনই হয়। টিংটিং-এ চেহারা। দুই চোয়াল গর্তে ঢুকানো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বড় বড় চোখ। কিঞ্চিত লম্বা চুল।
লোকটা বলল: তোমরা সবাই কি এই এলাকার ছেলে?
আমরা একযোগে তাকালাম তার দিকে। সে যে আমাদের সাথে এভাবে কথা বলবে তা আমাদের কল্পনায় ছিল না। আমরা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম যেন। আমাদের মধ্যে ফেকুটা অন্যরকম। বেশ চটপটে। পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে।
ফেকু বলল: জি, আমরা সবাই এ পাড়ার ছেলে।
: ও…..।
লম্বা করে ‘ও’ বলে সে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল। রিং বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। তারপর বলল: আমিও এ পাড়ার ছেলে-ছেলে ঠিক না, লোক-যুবক লোক।
আমরা একযোগে তাকালাম তারা মুখে। এবং একযোগে চমকে উঠলাম। লোকটা বলে কী! এ পাড়ার লোকজন আমাদের কারও কাছে অচেনা, অজানা নয়। জীবনে যার ছায়া পর্যন্ত দেখিনি, সে এ পাড়ার লোক হয় কেমন করে? নিশ্চিত গুল মারছে। হয়তো কোনো ধান্দা আছে।
আমাদের চমকানো বা বিস্ময়কে কোনো পাত্তা না দিয়ে সে মোজাফ্ফরকে বলল: আমার পক্ষ থেকে ওদের সবাইকে চা দাও।
আমি বললাম: না না, আমরা তো মাত্রই চা খেলাম।
: আবার খাও। ঐ যে আকাশলীনা……..।
আকাশলীনা কী? লোকটা আর কিছু বলে না। শোঁ করে শব্দ তুলে চায়ে চুমুক দেয়। আমরা সবাই তার মুখে তাকিয়ে। কি অদ্ভূত এক লোক! সবার আগ্রহ তার দিকে ফিরিয়ে রেখেছে।
ঢক করে চা-টা গিলে বলল: আমরা ঐ আকাশলীনার চার তলায় ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছি।
এবার বল্টু সচেতন হয়ে ওঠে। উৎসাহ নিয়ে বলে: তাই! আমরা তো ঐ বাড়ির তেতলায় থাকি অনেকদিন ধরে।
লোকটা বল্টুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল: বাহ! তাহলে আমি আর তুমি প্রতিবেশি।
: জি জি। বল্টুর ভেতর দারুন উচ্ছাস। একজন দার্শনিক প্রতিবেশি পাবার উচ্ছাস।
সে বলল: ভাড়া নেবার সময় এই নামটা আমাকে খুব টেনেছে। মূলত বাড়ির নাম দেখেই আমরা এখানে ভাড়া এসেছি।
বাড়ির নাম দেখে কেউ বাড়ি ভাড়া নেয় আমরা সেই প্রথম শুনলাম।
সে বলল: বাড়িটার নাম আকাশলীনা রেখেছে কেন?
বল্টু বলল: বাড়ির মালিকের ছেলের নাম আকাশ আর মেয়ের নাম লীনা।
: ও….। আমি আরও ভাবছিলাম, লোকটা হয়তো জীবনানন্দের কবিতার ভক্ত।
: আরে ধুর! সে জীবনান্দের নাম শুনেছে কি না সেটাই সন্দেহ।
: মানুষের নাম হিসেবে আকাশ অথবা লীনা কোনোটাই আমার পছন্দ না। তবে ‘আকাশলীনা’ এক সাথে খুবই রোমান্টিক। তাহলে জীবনানন্দের ‘আকাশলীনা’ কবিতাটা তোমাদের শোনাই।
আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে সাহিত্য হয় আমরা তা জানি। আমরাও সেখানে যাই মাঝে মাঝে। আমাদের গলির এই চায়ের দোকান কবিতা আবৃত্তির জন্য উপযুক্ত নয়। তার ওপর লোকটার কন্ঠ যেমন পাতি হাঁসের কন্ঠের মতো ফ্যাসফ্যাসে লাগছে, তাতে আমরা কেউ তার আবৃত্তি শুনতে আগ্রহ পেলাম না। আমাদের অনাগ্রহের ধার সে ধারল না। সে শুরু করলো:
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে-আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তোমার তাহার সাথে?-তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।
আবৃত্তি শুনে আমরা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জগতে কতই না বিস্ময় থাকে। এমন পাতিহাঁসমার্কা কন্ঠ থেকে এমন দরাজ আবৃত্তি, এমন দরদ, এমন লালিত্য আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল।
সে আমাদের স্তম্ভিত ভাব ধরতে পারল। বলল: কথা বলার সময় আমার কন্ঠটা পাতিহাঁসের কন্ঠের মতো ফ্যাসফ্যাসে। কিন্তু আবৃত্তি বা গানের সময় তা হয় না। ব্যাপারটা অন্য সবার মত আমার কাছেও বিস্ময়। এ নিয়ে
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।