• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ২৫)

দার্শনিক হেলাল ভাই

তবে একজন সহউপস্থাপক দরকার। আর সে হবে মেয়ে। কোন মেয়েকে বল্টুর সাথে উপস্থাপনায় অংশ নিতে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এলাকার অনেক মেয়েই কোনো কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। কিন্তু আমাদের দলের সাথে কাজ করবে কি না সেটাই হলো কথা।
এর মধ্যেই আমার সাথে দখা হলো রিনির। আমাকে দেখেই রিনি ক্ষেপে উঠল: এই, সমস্যা কী বলো তো?
: কিসের সমস্যা?
: আমি এত্তগুলা চিঠি দিলাম, হেলাল ভাইয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তরই এল না।
: আমরা খুব ব্যস্ত আছি।
: তা তো জানি। অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলাম তো। তাই বলে চিঠির একটু উত্তর দেবার ফুরসত……। নাকি চিঠি হেলাল ভাইয়ের হাতে পৌছায় নাই?
: শোনো, উত্তর পাবে। অনুষ্ঠানটা শেষ হলেই……।
: তুমি কী ছবি এঁকে পুরস্কার জিতলে?
: একটা স্কেস……।
: বিষয় কী?
: পৃথিবীতে মন্দের সংখ্যা কম, আর ভালোর সংখ্যা বেশি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালো তবে সাতান্ন। সেটাই স্কেচে দেখিয়েছি। দেখিয়েছি মন্দ না থাকলে ভালো, আরও ভালো, আরও ভালো কিছু হতো না। শেষ পর্যন্ত মন্দ নাই হয়ে যায়-শূন্য হয়ে যায়, ভালো টিকে থাকে, ভালোটা একশ’ হয়ে যায়।
: ইউনিক আইডিয়া। স্কেচটা কেমন তা একটু বলবে?
: অনুষ্ঠানে মঞ্চের পেছনে সেই স্কেচের একটা রেপ্লিকা লাগানো থাকবে, তখন দেখবে।
: ঠিক আছে।
: শোন রিনি, আমাদের জন্য একটু কাজ করতে পারবে?
: কী কাজ?
: অনুষ্ঠানে বল্টুর সাথে সহউপস্থাপিকার দায়িত্ব পালন করবে।
: পারবো, আমার এতে আগ্রহ আছে।
: ধন্যবাদ। তাহলে আমাদের সাথে রিহার্সেল করতে হবে।
: আচ্ছা, রিহার্সেলের টাইম-টেবল জানিও।
: কালই জানাব। তবে একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
: কী?
: রিহার্সেল চলার সময়ে, বা অনুষ্ঠানের দিন সেই প্রেম, প্রেমপত্র এসব নিয়ে কোনো কথা তুলতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি, অনুষ্ঠানটা শেষ হলেই হেলাল ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতি-উত্তর পাবে। আই এ্যাম গিভিং ইউ ওয়ার্ড। বিলিভ মি।
: ওকে, আই হ্যাভ বিলিভ অন ইউ।
: আরও একটু কাজ করতে হবে।
: আর কী?
: ঐ যে সুরঞ্জনা, ও তো রবীন্দ্র সংগীত গায়, আবার নাচও করে। ওর সাথে তোমার সম্পর্ক ভাল। ওকে বলে অনুষ্ঠানে একটা গান গাওয়ার আর একটা নাচ করার ব্যবস্থা করে দিবে।
: তা দিতে পারব, আমি বললে ও আমার কথা ফেলবে না। গান গাওয়ার জন্য আরও একজন মেয়ে দিব।
: সে কে?
: খাদিজা।
: ও গান গায়!
: খালি গলায় ও যখন গাইবে নিশি রাত বাঁকা চাদ আকাশে/ চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে…… তোমাদের মনে হবে ঠিক যেন গীতা দত্ত গাইছে।
: বলো কি!
: শুনলেই বুঝবে।
: তাহলে ওকে বলে দিও।
: দিব। আমি বললেই ও রাজি হবে।
: থ্যাঙ্কু।
: ওয়েলকাম।
অনুষ্ঠান খুবই সুন্দরভাবে সমাপ্ত হল। বল্টু আর রিনির উপস্থাপনা ছিল সাবলিল। অনুষ্ঠান সূচীতে যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু উপস্থাপন করা হয়ে গেল। যেমন-২৪৩ নম্বর বাড়ির পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের সুরঞ্জনা, যে হেলাল ভাইয়ের চিঠি পেয়ে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল, সে রবীন্দ্র সংগীত গাইল-আমার সকল দুঃখের প্রদীপ। আবার সে একটা নাচও পরিবেশন করল। রাঙা মাটির রঙে চোখ জুড়াল, সাম্পান মাঝির গানে মন ভরাল/ রূপের যাদু সুরের মধু কোন সে দেশে, রূপবতী মধুমতি বাংলাদেশে-এই গানের সাথে নাচ। নাচটা সত্যিই প্রশংসনীয় হয়েছে। সে রিনির অনুরোধ রেখে আমাদের অনুষ্ঠানের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করেছে।
আর গীতা দত্ত মানে খাদিজা, তার গানের প্রশংসা করার ভাষা নেই।
আবৃত্তি করলো গাব্বু। গাব্বু যে হেলাল ভাইয়ের আবৃত্তির স্টাইলটা ধারণ করে ফেলেছে আমরা তা কেউ জানি নাই। প্রথমে আবৃত্তি করলো নির্মলেন্দু গুণের প্রথম অতীথি কবিতাটি। কবিতাটি এমনিতেই অনেক সুন্দর। ‘এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি তুমি/ মুহূর্তে সবুজ ঘাস পুড়ে যায়/ ত্রাসের অগুন লেগে লাল হয়ে জ্বলে ওঠে চাঁদ/ নরম নদীর চর/হাঁ করা কবর হয়ে গ্রাস করে পর শত্রুকে/মিত্রকে জয়ের চিহ্ন, পদতলে প্রেম/ললাটে ধুলোর টিপ এঁকে দেয় মায়ের মতো……।’
দর্শকরা ব্যাপক করতালি দিল। আরেকটা শুনতে চাইল। শেষে গাব্বু দর্শকদের অনুরোধে আবৃত্তি করল শামসুর রাহমানের কবিতা ‘তুমি বলেছিলে।’ এ কবিতাটাও অনেক সুন্দর। স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভমিকায় লেখা। শুরু এরকম-দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার/ পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ, লোহা-লক্কড়ের স্তুপ, মসজিন এবং মন্দির…।’
হেলাল ভাইও দুইটা কবিতা আবৃত্তি করল।
তবে অনুষ্ঠানের মাঝখানে সমস্যা সৃষ্টি করল ফেকু। সে বলল: আমি গান গাইব।
ফেকু বাথ রুমেও কোনোদিন গান গেয়েছে বলে জানি না। গান গাওয়া তো দূরের কথা, লম্বা সুরে ও কখনো কথা বলেছে বলেও শুনি নাই। হেলাল ভাই বলল: গান করবি মানে? সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটা চলছে। সব পণ্ড করে দিতে চাস?
ফেকু কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। সে গান গাইবে। হেলাল ভাই বলল: তুই তবলের সাথে তাল রাখতে পারবি না। তাল কাটা গেলে গান শেষ।
: আমি মিউজিক ছাড়া খালি গলায় গাইব। খাদিজা গাইল না?
: খাদিজা আর তুই এক কথা। তোর গলা আছে বলে শুনি নাই কখনো। অমন হেরে গলায় বাঁশবাগানে ভূত তাড়ানোর জন্য গাওয়া যায়।
: আপনি দেখেন। আপনার পাতিহাঁসমার্কা গলা নিয়ে আবৃত্তি করেন না?
: কী গান গাইবি?
: কিশোর কুমারের আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল….।
: ওরে বাবা! মারাত্মক প্রেমের গান। তার চেয়ে দেশ প্রেমের গান কর। ভালো-মন্দ যাই হোক দর্শক মেনে নেবে। কিশোর কুমারের কন্ঠ….! বুঝিস তো।
: খালি গলায় দেশ প্রেমের গান ভালো লাগবে না। প্রেমের গান দিয়ে দর্শকদের আবিষ্ট করে ফেলব।
: আবিষ্ট! দর্শক পালাবে শেষে।
: এত অবহেলা করবেন না। আগে গান করি তারপর…..। দর্শক যদি পলায় তো আমার কানের নিচে দুইটা থাপ্পর দিয়ে দিয়েন।
মঞ্চে গিয়ে ফেকু যখন কন্ঠ ছেড়েছে, পুরো ক্লাবে পিনপতন স্তব্ধতা নেমে এল। এই সুর, এই কন্ঠ ও কবে কখন কিভাবে আয়ত্বে নিল। চোখ বন্ধ করে সবাই শুনল, ঠিক যেন কিশোর কুমার।
গান শেষ হলে দর্শকের ওয়ান মোর-ওয়ান মোর। তারপর ফেকু গাইল মান্নাদের গান-আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো….।
ফজা বেশ কয়েকটা কৌতুক পরিবেশন করল। দর্শকদের হাসিয়ে পেট ব্যথা করে দিল।
কৌতুক ১।
শিক্ষকঃ এখন আমি তোমাদের পীথাগোরাসের তত্ত্ব প্রমাণ করে দেখাবো।
এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বললঃ স্যার, প্রমাণ করার দরকার নেই। আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করি।
কৌতুক ২।
ছেলেঃ ডেডি আমি এফ গ্রেড পেয়েছি।
বাবাঃ ভেরি গুড! আমি তো ভেবেছিলাম তুই ফেল করবি। এই নে’ পাঁচ হাজার টাকা। মিষ্টি এনে পাড়ার সবাইকে খাইয়ে দে’।
কৌতুক ৩।
মৃত্যুর আগ মুহূর্তে স্বামী তার স্ত্রীকে বলছে-ওগো শুনছো, মৃত্যুর পূর্বে তোমাকে আজ কিছু সত্য কথা বলে যেতে চাই।
স্ত্রী আগ্রহ নিয়ে বলল-বলো, তুমি কী বলতে চাও।
স্বামী বলল-তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলতে আমার একটুও ভালো লাগতো না। তবু কখনো কখনো মিথ্যা বলতে হয়েছে। খাঁটের নিচে একটা বাক্স দেখতে পাবে। যখনই আমি তোমার সঙ্গে কোনো মিথ্যা কথা বলেছি, তখনই সেই বাক্সে একটা ডিম রেখেছি, যাতে তোমার সাথে কয়টা মিথ্যা কথা বললাম সে হিসাব রাখতে পারি।
স্ত্রী আগ্রহ নিয়ে খাঁটের নিচে গিয়ে বাক্স খুলে দেখে তাতে মাত্র তিনটা ডিম আছে। সে খুশি মনে ফিরে এসে বলল ঃ সারা জীবনে তুমি আমার সঙ্গে মাত্র তিনটা মিথ্যা কথা বলেছো! এটা কোনো ব্যাপারই না। অনেক মহামানবও তাদের স্ত্রীর সাথে এর চেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলে। যাও, আমি তোমাকে আনন্দ চিত্তে ক্ষমা করে দিলাম।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।