সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা


দ্বিতীয় খন্ড(ষষ্টিতম পর্ব)

এভাবে ট্রাকে করে এর আগে কোনোদিনও দূরে কোথাও যাই নি। একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চে দেহমন রোমাঞ্চিত হচ্ছে। সিট হিসেবে ধ্রুবদার সিটটাই বেশী ভালো। একমাত্র ওভারটেক করার সময় ছাড়া সবসময়ই প্রকৃতিকে অনেক কাছে থেকে অনুভব করা যায়। আমার জানালা থেকে তিনি অনেকটাই যেন অভিমানী দূরত্বে আছেন। এ ছাড়া ক্রমাগত বাস, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ির দল দু’জনের মধ্যে দেওয়াল তুলে দাঁড়ায়। তবুও এক অপরিসীম আনন্দে যেন ভেসে চলেছি। তখন কিন্তু একবারের জন্যেও মনে হয় নি, যে মুনসুবা মোড়ে লাল্টুর ধাবায় শাহজাহান শেখ নামের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার রাজারহাটের বাসিন্দা এই মানুষটির সাথে দেখা হওয়াটাও ছিলো সম্পূর্ণভাবেই পূর্বনির্ধারিত! পরবর্তী সময়ে এই সাজানভাইয়ের ট্রাকে করে কতবার যে আসতে হয়েছে বীরভূমের এই পাথুরে জমিতে, আর সে উপলক্ষে কতো কাহিনীই না লিখে রেখেছে মন তার স্মৃতির খাতায়, সেকথা না হয় পরে ফের কোনোদিনও সময় সুযোগ পেলে বলা যাবে। এই তারাপীঠ, গুরুপদবাবার আশ্রম, পরবর্তী সময়ে সোনাদার সোনাবাবায় রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনী, সোনাদার নতুন ছত্রে ভান্ডারা দেওয়ার নামে কতশত সাধুসঙ্গ লাভ, আর অবশ্যই কানাইদা আর বাউলনির অবিস্মরণীয় স্মৃতি। সে সব কাহিনীর সবকিছুর মূলে যে আজকে হঠাৎ করেই শাহজাহান শেখের সাথে দেখা হওয়া, সেটা কে বুঝতে পেরেছিলো!
ট্রাক চলছে, রাজ্যসড়ক ধরে রামপুরহাট থেকে মোড়্গ্রাম মোড়ের দিকে। ছবির মতো সরে সরে যাচ্ছে ক্ষেতখামার, গাছগাছালি, নয়নজুলিতে ফুটে থাকা বহুবর্ণের শালুকফুল, জলকলমির, পানিফলের দাম। টোকা মাথায় কৃষকের লাঙ্গল কাঁধে রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া।
ধ্রুবদা এর ভেতরেই নাক ডাকা শুরু করে দিয়েছেন। আর সাজানভাই ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে ব্রেক চেপে ধ্রুবদার ঘুম ভাঙাচ্ছেন। হেল্পার ছেলেটি বেশ চৌকশ। পরে এই কালুই আমার বেশ ভালো বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছিলো। ধ্রুবদার ঘুম চটকে যেতেই কালু প্রতিবার একটা করে বিড়ি ধরিয়ে ধ্রুবদার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, আর মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ করেই সাজানভাই একটা নয়ানজুলির ধারে গাড়িটাকে দাঁড় করালো।
— ” সারারাত কি না ঘুইমে কাইটেচো নাকি গো ধ্রুববাবু? নাও এট্টুসখানি নীচেয় নেইমে গা,হাত,পা ঝেইড়ে নাও দিনি, চোকে মুকে এট্টু পানির ঝাপটা দে নাও।”
উল্টোদিকে একটা ছোটোমতো ধাবা আছে, সেটা এতোক্ষণে নজরে আসেনি। অথচ আমার তো চোখে পড়া উচিতই ছিলো, আমি তো ওদিকের জানালাতেই বসে ছিলাম !
— লোহাপুর আসতিচে, একসাথে আরও কিচু গাড়ি জুইটলে পর, রওনা হতি হবে। ততক্কণে চলো গলায় এট্টু চা ঢেইলে চাঙ্গা হইয়ে নাও গো। এই শালার কালু, হাঁ কইরে দেইকচিস কী? ধাবার টিউকলের থে এক বালতি পানি এইনে দে জলদি, তেনারা হাত মুক ধুইয়ে নিক। “
চা খেতে খেতে কালুর সাথে গল্প জুড়লাম। বাড়িতে কে কে আছে, কতদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, এর ভেতরেই বিয়ে করে নিয়েছে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। শুধু যে বিয়েই করেছে তাই নয়, এরই ভেতর দুটো ছেলের বাবাও হয়ে গেছে।
এবার ধ্রুবদাকে আমার সিটে বসিয়ে আমি গিয়ে কালুর পেছনের সিটে বসলাম। কিছুটা পথ যেতেই ধ্রুবদা পেছনের লম্বা সিটে চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আমি গুনগুন করে গান গাইছি — গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে –।

এদিকটায় আদিগন্ত মাঠ জুড়ে ক্ষেতে ক্ষেতে মাথা তুলে আছে পাটগাছ। বর্ষার শেষে শরতের শুরুতে পাটগাছ কেটে নয়নজুলির জলে পচানোর জন্য ফেলে রাখা হবে। সেসময় এক তীব্র গন্ধে ছেয়ে যায় এসব অঞ্চলের বাতাসের বুক। আমার বীরভূমের মানচিত্র সম্পর্কে সেরকম ধারণা ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম ট্রেনের মতোই ট্রাকও বুঝি বোলপুর শান্তিনিকেতন ছুঁয়ে যাবে। কিন্তু যখন শুনলাম যে এ রাস্তা ওদিককার রাস্তার থেকে অনেকটাই পূবদিক থেকে গিয়ে নদীয়া হয়ে, উত্তর চব্বিশ পরগণা হয়ে কলকাতা যাবে, তখন মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। কানাইদার বাউলরাজার শান্তিনিকেতনে এখনও পর্যন্ত পা রাখিনি। লোকমুখে শুধু শুনেই গেছি।
এতোক্ষণ বেশ প্রকৃতির অনন্য শোভা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই যেন মনের ভেতর এসে হাজির হলো নিতান্তই সাধারণ এক গ্রাম্য বাউলের সাধনসঙ্গিনীর অপলক দৃষ্টি। মনে পড়ে গেলো ফেরার পথে পথের বাঁকে ওর লুকিয়ে পড়া, পিটুলিতলার ঘন গাছের আশ্রয়ে আমাদের পেছনে ছায়া হয়ে দৌড়ে বেড়ানো, নদীর জলে ওর লজ্জাশীলা মুখের ছায়া পড়ার ছবি।
ও কে? ওর সাথে আমার কী সম্পর্ক? কোনোদিনও কি মনের অজান্তে ও আমায় অথবা আমি ওকে মন দিয়ে ফেলেছিলাম? হয়তো দিয়েছিলাম, হয়তো… শুধুই হয়তো আর হয়তোর সমাহার। শুধুই ছায়া! শুধুই ছায়া? মন নিজের থেকেই মাথা নাড়লো — না হে, এ সম্পর্ক কখনোই শুধুমাত্র ছায়ায় ছাওয়া নয়, মায়ার বাঁধনে বাঁধা।
হঠাৎ করেই যেন কানাইদার গলা ভেসে এলো, ” পদীপদাদা, ভালোবাসা ককনোই পাপ লয় গো, সেটারে অস্বীকার করাটা পাপ। মন আর শরীলের দূরত্ব কয়েক যোজন, কিন্তু মনের মন্দিরে, শরীর দেবতার আসনে বসে থাকেন গো। তাকে ভালোবাসার ফুলের অঘ্য দে পূজা নিবেদন করো, দেকপে সে ফুল ককন যেন একতারার সুরে সুরে গলার মালা হয়ে গেচে। “
সাজানভাই হঠাৎ ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করালেন। ধ্রুবদা ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
— ” সামনে বেথুয়াডহরীর ভয়ানক জঙ্গল গো প্রদীপদাদা। একেনে দেঁইড়ে যেতি হবে। দশ বারোটা গাড়ি সাথে কইরে না নে গেইলে সব্বস্ব লুটে নে যাবে ডাকাতেরা। “
আমি মনে মনে বললাম — ” সাজানভাই, আমার মনেরও যে সর্বস্ব লুঠ হয়ে গেছে গো। ভাগ্যিস ডাকাতরা মায়া জানে না। “
মনে মনে একথা ভাবতেই ফের সেই মায়াভরা মুখ ভেসে উঠলো –” তুমি কিন্তু একেনে আর এসো না গো ঠাকুর, এ মাটি মায়া জানে, মায়াবিনী। এ মায়ার জালে একবার আটকে গেলে আর… “
আরও কত কথাই যে কইতে লাগলো সে মায়ামুখ, সারাটা রাস্তা যেন আমার সাথে সাথেই সঙ্গ দিলো সেই গ্রাম্য সরল মায়াবতী কন্যা।
যখন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম তখন রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেছে।
–” এ কী চেহারা করেছিস রে তুই? শরীর ঠিক আছে তো তোর? “
মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা কলতলায় গিয়ে গায়ে জল ঢালতে শুরু করলাম।

ইতি সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।