সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১০)

যুদ্ধ যুদ্ধ

দশ

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নতুন মাদুর বিছিয়ে বসে আজকের রোজগার কত হল তা গুনছে মানুষটা। মাত্র দশ টাকা বারো আনা। অখুশি মানুষটা বারবার মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, না না এই রোজগারে হইব না। বাড়াইতে হইব, বাড়াইতেই হইব। তারপর সে চারিদিকটা বারকয়েক ভাল করে দেখে নিয়ে গ্যাট থেকে মুদ্রা দুটো বার করে ওই দশ টাকা বারো আনার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। ফের একবার পুরো পয়সাগুলো গোনে। চোদ্দ টাকা বারো আনা। তবে এক টাকার মুদ্রা দুটোর প্রতি মানুষটা যেন একটু কৃতজ্ঞতার চোখেই তাকায়। শত হলেও এই দেশের মাটিতে এই মুদ্রা দুটো তার প্রথম রোজগার। শ্রমের মজুরি। নিজের হাতে সে নিজের রান্না করার জায়গাটুকু গোবরলেপা করে নিয়েছে। অথচ সবাই জানে ও দুটো কোনও বাচ্চা চুরি করেছে। মানুষটা যদি স্বীকার যেত যে, সেই মুদ্রা দুটো তুলে নিয়েছে তাহলে কি নিরেট বোকামো করা হত না? তবে অত রাত্রে গামছাটা চুরি যাওয়াতে মানুষটা অবাক হয়েছে। যদিও তাতে লোকসান তার কিছুই হয়নি। কদিন পরে ওটাকে এমনিই ফেলে দিতে হত। তার আগেই নতুন গামছা মিলে গেছে তার।
হঠাৎ এক দঙ্গল ঘন কালো মেঘ চাঁদের মুখ ঢেকে দিতে গাঢ় ছায়াটা তার পয়সাগুলোর ওপর মোক্ষম কামড় হয়ে আটকে থাকে। তাতে মানুষটা এক অশুভ ইঙ্গিত টের পায়। তৎক্ষণাৎ সে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে হুশিয়ার হতে হবে। বাজে খরচ কোনোমতেই করা যাবে না। ঘরের ব্যবস্থা হলেই একটা লক্ষ্মীর ঘট কিনবে। টাকাপয়সার উপর থেকে কালোছায়ার কুপ্রভাব ঘোচাতেই হবে।
ওরা আজকের মতো ঘর বাঁধার কাজ সেরে বসতিতে ফিরছে। একটা কোলাহল জেগে উঠছে ওদের মধ্যে। ওরা কাছে এলে মানুষটা শুনতে পায়, সবাই একরকম সমস্বরে দয়ালের কাছে দাবি করছে, এত কষ্ট করে তোমার গোঁসাইয়ের জন্য বিনা মজুরিতে ঘর বেঁধে দিচ্ছি তার বিনিময়ে কাল রবিবার, তোমাকে শুয়োর মারতে হবে। পেটভরে মাংসভাত খাব। ব্যস, আর কিছু চাই না আমরা।
এত করে বলাতে দয়ালের মন নরম হয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও ওরা রাত করে ঘর বাঁধার কাজ করছে, সে শুধু তার মুখ চেয়েই তো নাকি! এখন সে যদি ওদের জন্য একটু আনন্দ ফুর্তির ব্যবস্থা না করে তাহলে বেইমানি করা হয়ে যাবে। বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোদের কথাই মেনে নিলাম, কালই শুয়োর মারা হবে।
শুনেই ওরা মুহূর্তে আনন্দে হইচই করে উঠল।
মানুষটার মনে হল, যেন একদল জংলি মানুষ শিকার সেরে আনন্দসূচক বিভৎস চিৎকার করতে করতে ঘরে ফিরছে।
দয়াল মানুটার ভালমন্দ খোঁজ নিতে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, গোঁসাই, আপনার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? তা লুকাস ছোকরাটা গেল কোথায়?
যাইব আর কই, কাছেপিঠেই আছে কোনওখানে।
মানুষটা সত্যি কথাটা বলল না। আসলে লুকাস গেছে সয়েনিকে খবরটা দিতে। সয়েনিকে পাওয়ার সমস্ত রকম অস্ত্রই এখন তার হাতে মজুত। শুধু তিন রাত্রি সহবাসের ব্যাপারটা নিয়ে যা একটু চিন্তায় আছে।
মানুষটা বলল, অসুবিধা আমার  আর কী দয়াল। ঘরের ব্যবস্থা করতাছ, সে তুমি আমারে ভক্তি শোদ্দা কর বইলাই তো নাকি। তা তোমার লগে এ্কটু কথার দরকার আছিল দয়াল।
দয়াল উপস্থিত অন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, তোরা যার যার ঘরে যা এখন।
মানুষটার চালার বাইরে মাটিতে বসে পড়ে দয়াল। মানুষটা চারিপাশটা একবার ভাল করে দেখে নিয়ে  নিচু স্বরে মনের ইচ্ছের কথাটা বলতে থাকে। দয়াল মন দিয়ে শুনছে।শুনতে শুনতে সে পুলকিত হয়ে উঠে। সেইসঙ্গে সন্দিগ্ধও হয়। জিজ্ঞেস করে, এ আপনি কী বলছেন গোঁসাই, এও কি সম্ভব! নিজেদের ধর্মে ফিরে যেতে পারব আমরা? সেই বিধান কি শাস্ত্রে আছে?
পারবা, পারবা। অসম্ভবকে সম্ভব করুম তো আমি। এখন তোমার পোথম কাম হইল মুকুন্দ পোদ্দারের লগে আমার পরিচয় করাইয়া দেওন। মাটি না হইলে বাঁচন খাঁটি হয়না জানবা। মাটি হইলে যেমতেই হউক মাথার একটা আচ্ছাদন হইবই।
সহসা দয়ালের চোখজোড়া চকচক করে ওঠে। বলল, তাহলে গোঁসাই, আপনি বলছেন আমাদের জীবনে আবার বারো মাসে তেরো পার্বণ  ফিরে আসবে?
আসবে দয়াল, আসবে। এতদিনের পাপের জীবন থিকা তোমাগ মুক্তি দিয়াই ছাড়ুম আমি।
কিন্তু গোঁসাই, মনটা যে আমার বড় খচখচ করছে, প্রভু যীশু কি আমাদের ক্ষমা করবেন? শঙ্কাকাতর কন্ঠস্বর দয়ালের।
দয়াল, মানতাছি তোমার কথা, বিপদের দিনে ঐ মিশনবাড়ি তোমাগ বাঁচাইছে
কিন্তু বিনিময়ে আসল জিনিসটাই যে কাইড়া নিছে। মাইনষে যদি তার জাতধম্মই খুয়াইয়া ফালায় তাইলে তার আর থাকল কী? এর থিকা মরণ ভাল না?
শুনে বড় কষ্ট পায় দয়াল। কাঁদছে সে। আর মানুষটা দেখে জ্যোৎস্নার অপার ধারায় যেন দয়ালের যত অনুতাপ কষ্ট ভেসে যাচ্ছে। মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে মানুষটা।  অনুতাপ হওয়া ভাল। তা নইলে মানুষ শোধরায় না। চুপ করে থাকে সে। দয়ালকে আরও কাঁদতে দেয়।
আজ রাতে একটা সুখের স্বপ্ন দেখার অধিকার পেয়ে গেছে যেন মানুষটা। এক রাজ্যপাট হারিয়ে আরেক রাজ্যপাট জয়ের সম্ভবনা এখন মানুষটার সামনে। বসতির এই কয় ঘর প্রজা আপাতত পেলেই যথেষ্ট তার কাছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজার সংখ্যা বাড়বে। সেইসঙ্গে রোজগারপাতি। পরে পরেই মানুষটা ভাবে, এতকিছু ব্যবস্থা হওয়ার পরেও কি তার এই একার জীবনই থেকে যাবে! একা মানুষের জন্য তাহলে এত ব্যবস্থারই বা কী প্রয়োজন। না, প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার কষ্টেরও যে শেষ নেই। এই অনন্ত নিঃসঙ্গতা বড় অসহনীয় লাগে তার। পারুর কথা মনে পড়ে। মেয়েটার মন কাড়ার ক্ষমতা বেশ। এমন একটা মেয়ে যে কী করে অগস্টিনের মতো একটা চালচুলোহীন ছেলের প্রেমে মজল তা ভেবে পায় না মানুষটা।
ওদিকে মেঘের গায়ে মেঘ আছড়ে পড়ছে। তীব্র কঠিন শব্দে ভূমন্ডল কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাতাসের সোঁ সোঁ কোলাহল। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টিও প্রলয় নাচন শুরু করে। এমনই এক দমকা হাওয়া মানুষটার চালার ভিতরে ঢুকে সব এলোমেলো করে দেয়। ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে মানুষটা। লাখ লাখ কলসি উপুড় করা বৃষ্টি  পড়ছে। বড় এক বিদ্যুৎ চমকের আলোয় মানুষটা দেখে, বসতির দিক থেকে জলের ধারা তার আস্তানার দিকে ধেয়ে আসছে। দুশ্চিন্তায় পড়ে মানুষটা। তার বিছানাপত্র যে ভিজে যাবে।জিনিসপত্র ভেসে যাবে। বাতাসের তোড়ে যেকোনও সময় চালাটাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। দড়িদড়ার বাঁধনে কড়কড় শব্দ হয়।
তার জন্য নির্মীয়মাণ ঘরটা এখন যেন ভয়ঙ্করদর্শন এক কঙ্কাল। ঘরটার মাথার ওপর এখনও খড় চাপেনি। না না, ওই ঘর তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। বিছানাপত্র মাথায়, পুটুলিটা বগলদাবা করে মানুষটা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর সে ভাবে, এখন সে কোথায় যায়। রাত পোহাতে এখনও যে ঢের  দেরি। শরীরও যে তার লম্বা ঘুম চায়। জল গড়িয়ে এসে তার পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। নোনামাটি কাদা কাদা এখন। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। বসতির প্রধান ফটকের দিকে একরকম দৌড় লাগায়। এক দুবার আছাড় খায়। হাঁটুর ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় শরীরটা বেঁকে যায়। কোনওরকমে প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্গলহীন ফটক। তার উপরের ছাউনির ফাঁকফোকর গলে জল পড়ছে। ভিজতে থাকে মানুষটা। প্রমাদ গোনে, এভাবে ভিজলে নির্ঘাত জ্বরজ্বারি না হয়ে যায় না। তখন তার দেখভাল কে করবে। অসুখবিসুখে পড়ে শেষে প্রানটা না যায়। এক্ষুনি মাথার ওপর একটা নিরাপদ ছাউনি দরকার তার। ছোট এক বিদ্যুৎ চমকে সে বসতির ভিতরে ওদের উঠোন আর এক চওড়া বারান্দা দেখতে পায়। উঠোনের মাটিও ভিজে কাদা। এতদিনের তাপজর্জরিত জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে বসতির মানুষগুলো অকাতর ঘুমে বিভোর। তবুও মনের আশঙ্কা দূর হয় না মানুষটার, চারিদিকে চোখ চালায়, কেউ তাকে দেখে ফেলছে না তো! না, কেউ কোত্থাও জাগা নেই। তবুও যেন সে নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে চুপিচুপি দয়ালের ঘরের বারান্দায় উঠে আসে। পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ছনছা থেকে ঝরে পড়া জলে পরিষ্কার করে। তারপর গামছা দিয়ে ভাল করে গা হাত পা মোছে। দয়ালের পাশাপাশি তিনটে ঘর। দুই ঘরের দরজার মাঝের দেওয়ালের গা ধরে মাদুরটা বিছোয় মানুষটা। ভোরে ঘরের মানুষগুলো জেগে ওঠার আগেই সে এখান থেকে চলে যাবে।
সময় গড়ায়। বৃষ্টির তোড় বাড়তে থাকে। বাতাস আরও এলোপাথাড়ি  খেলা করতে থাকে। বৃষ্টির ছাট থেকে থেকে পুরো বারান্দার দখল নিয়ে নিচ্ছে। নিজেকে গুটোতে গুটোতে মানুষটা একরকম দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে যায়। আর সরে যাওয়ার জায়গা পায় না। এখন সে কোথায় যায়। এদিকে ঠান্ডায় শরীর কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। মাদুরের অন্য প্রান্তটা গায়ে চাপিয়েও রেহাই হচ্ছে না। উঠে বসল মানুষটা। বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে। তার একার এই কষ্টভোগ তাকে যেন অভিমানকাতর করে তোলে। অথচ কার বিরুদ্ধে, কেন এই অভিমান, এই ক্ষোভ তা নিজেই বুঝে উঠতে পারে না মানুষটা। সে উঠে দাঁড়ায়, মাথার দিকের ঘরটার দরজায় মৃদু আঘাত করে। কার ঘরের দরজায় সে আঘাত করছে, ভিতরে কে গভীর নিদ্রা যাচ্ছে তা জানে না সে। এই মুহূর্তে অতশত জানবার প্রয়োজনও বোধ করছে না। কেননা আগে তাকে বাঁচতে হবে। দরজায় আরও জোরে আঘাত করে। একসময় দরজাটা খুলে যায়। আর বিদ্যুতের আলোয় সে দেখে তার সামনে পারু দাঁড়িয়ে। পারুর কাঁচাঘুম ভাঙ্গা চোখ, ফুলো ফুলো মুখমণ্ডল।শঙ্কিত হয়ে পারু দুকদম পিছিয়ে আসে।
গোঁসাই, তুমি এত রাতে আমার এখানে? মতলবটা কী তোমার, শুনি? কঠিন গলা পারুর। সাবধানীও খুব।
কোনও মতলব নাই, বিশ্বাস যা পারু। অসহায় করুণ কন্ঠস্বর মানুষটার।
মতলব নেই তো রাতদুপুরে আমার ঘরে কেন শুনি? বসতির মানুষগুলো জানতে পারলে মেরে তোমার হাড়গোড় না গুঁড়িয়ে দিয়েছে!পারু আক্রমণাত্মক।
এইটা যে তোর ঘর তা আমি বোঝতে পারি নাই রে পারু। ঠান্ডায় শরীল এক্কারে জইমা গেল। এই দুজ্জুগের রাইতে আমি অখন যাই কই! রাতটার মতন আমারে একটু আশ্রয় দে পারু। ভোর না হইতেই চইলা যামু। কাকপক্ষিতেও টের পাইব না। বিশ্বাস যা, আমি তর কোনও ক্ষতি করুম না।
না না না, এ ঘরে তোমার কিছুতেই জায়গা হবে না।তুমি কি বোধবুদ্ধি সব হারিয়েছ নাকি? তুমি এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে।
কই যাম পারু?
তোমার যে চুলোয় খুশি!
তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে এই দেশে পারু?
না গোঁসাই না, সামান্য দুর্যোগের ভয়ে তুমি তোমার জাত ধর্ম মান খোয়াবে কেন!
তুই ছাড়া তো আর কেউ জানব না!
মনে মনে করুণার হাসি হাসে পারু। এই মানুষটাকে ঘৃণা করতেও মন চায় না তার। দরজা খোলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে ভেবেছিল এই দুর্যোগের রাতে অগস্টিন নিজেই চলে এসেছে তার কাছে। সে তো কোকিলের কুহু ডাক শোনার জন্য উদগ্রীব হয়েই ছিল। কিন্তু প্রকৃতি ঠান্ডা হতে আরামে কখন সে ঘুমিয়েই পড়ে। এই দুর্যোগে কুহু ডাক পারু শুনতে পাবে না ভেবেই বুঝি অগস্টিন সাহসী হয়ে উঠেছে আজ।
দাঁড়াও গোঁসাই, হ্যারিকেনটা উস্কে নিই।
চৌকির নীচে থেকে হ্যারিকেনটা বার করে উস্কে দিতেই মানুষটা চট করে ঘরে ঢুকে পড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। পাছে ক্ষ্যাপা বাতাস আলোটাকে নিভিয়ে দেয়। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পারু। ঘর এখন আলোময়। ভাবে, অগস্টিন কি তাকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে ফিরে গেল নাকি এই দুর্যোগের মধ্যে সে আসেইনি। না আসার সম্ভাবনাই তো বেশি।
চৌকিতে শুয়েও মানুষটার ঘুম আসে না। ভয়মিশ্রিত এক আকাঙ্ক্ষার বীজ মনটাকে বড় অস্থির করে তুলছে তার। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে দুঃসাহসী হতে দেয় না। সাহসী হয়ে উঠলে পারুর তরফ থেকে কীরকম ব্যবহার পেতে পারে তা মানুষটা বিলক্ষণ বুঝতে পারে। আর শিহরিত হয়ে ওঠে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে শুধু।
বাইরের প্রকৃতি এখন শান্ত। হঠাৎ ঘরের পিছন থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠতে চমকে ওঠে মানুষটা। তবে কি ভোর হয় এল! তাহলে তো এখনই তাকে এঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নিজের ডেরায় ফিরতে হবে। নয়ত দেরি করলে বসতির মানুষগুলো জেগে যাবে। কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে মানুষটা। ততক্ষণে কোকিলটা তৃতীয় বার ডেকে উঠতে পারুও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
ও কী গোঁসাই, উঠে বসলে যে, এখনও যে রাত অনেক বাকি? পারু বলল।
মানুষটা বলল, কোকিল ডাকল যে!
তাতেই কি ভোর হয়ে গেল গোঁসাই? ফিচেল হেসে জিজ্ঞেস করল পারু। বলল, কোকিল তো আর কাক নয়  যে, ভোর হয়েছে তা সবাইকে জানাবে। নাও, ফের শুয়ে পড়।
কিন্তু  এত রাইতে তুই কই যাইস পারু?
আমাকে যে কেউ ডাকছে তা শুনতে পাচ্ছ না গোঁসাই?
কে ডাকছে? বোঝতে পারলাম না আমি তর কথাটা।
ওই যে কোকিল! হাসতে হাসতে দরজার ছিটকিনিতে হাত দেয় পারু।
কে, অগস্টিন?
জানো দেখছি সবই। হ্যাঁ গোঁসাই, আমি এই এলাম বলে।
মুহূর্তে চৌকি থেকে একরকম লাফ দিয়ে নেমে আসে মানুষটা।
পারুর পথ আগলে দাঁড়ায়।
পথ ছাড় গোঁসাই। চিৎকার করে বসতির এতগুলো লোকের সামনে তোমাকে ছোট করতে চাই না আমি।
কর চিৎকার, যত জোরে পারস তুই! মানুষটা বোঝে, এই মুহূর্তে পারু তার প্রতি যতই নির্দয় হোক কোনোভাবেই বসতির মানুষগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করবে না। সে যে ভালবাসার মানুষটার কাছে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
ক্রোধে ফুঁসতে থাকে পারু। সে ঝট করে ঘরের দড়িতে ঝোলানো তার জামাকাপড়ের ভিতর থেকে একটা গামছা বার করে মানুষটার সামনে মেলে ধরে।
দেখ তো গোঁসাই, এটা চিনতে পার কিনা! কঠিন চাউনি আর ধাতব কন্ঠস্বর পারুর।
গামছাটা না চেনার কথা নয় মানুষটার। চিনতে পারে। তার সেই হারিয়ে যাওয়া গামছাটা। বলল, ঐদিন তুইই তাইলে গামছাটা চুরি করছিলি!
একে চুরি করা বলে না গোঁসাই, উল্টে চোর ধরা হল বলতে পার। তুমি চোরের মতো আমার পিছু নিয়ছিলে।
ঐটা এখন আর আমার কী কামে লাগব? নতুন গামছা তো হইছেই আমার।
তোমার না লাগুক আমার লাগবে। এখন যদি তুমি আমার পথ না ছাড় তাহলে রাত ভোর হলে বসতির সবার সামনে আমি বলব, কাল রাত দুপুরে তুমি বদ মতলব নিয়ে আমার ঘরে ঢুকেছিলে। আমি উল্টে তাড়া দিতেই ভয়ে পালাবার সময় তোমার কাঁধ থেকে এই গামছাটা কেড়ে রেখেছিলাম।
শুনে মানুষটা হতভম্ব। পরক্ষণেই ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে থাকে। বলল, মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা! এতবড় মিথ্যা কথা কইলে জিভ যদি না তর খইসা পড়ছে!
পড়ুক আমার জিভ খসে। ভালবাসার জন্য এটুকু মিথ্যা কথা বলায় কিছু আসে যায় না গোঁসাই।
মানুষটা অসহায় হয়ে দরজার একপাশে সরে দাঁড়ায়।
অভিসারে বেরিয়ে পড়ে পারু।

ক্রমশ… 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।