একার জীবনে এত আয় উন্নতির গল্প করতে বসলে মোটামুটি এভাবেই শুরু করে মৌলিনাথ, সেই কবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম , আজ আর মনে করতে পারি না, কত বছর যে হল গুনে দেখারও মন হয় না। সে কী আজকের কথা। তখন আমার বয়স কত আর, উনিশ কী কুড়ি ধরে নাও। পোশাক বলতে পরনের ধুতি পাঞ্জাবিটুকুই। হাতে গামছায় বাঁধা আ্যলুমিনিয়মের একটা থালা, একটা বাটি আর একটা গ্লাস। পকেটে সামান্য কটা টাকা। ঠাকুরদা টাকাটা হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, বাপঠাকুরদার সম্পত্তির ভাগ বলতে তুমি এটুকুই পেলে। ভাগ্যে থাকলে তোমার ওই থালা বাটি গ্লাস একদিন সোনার হবে। পকেটের ওই সামান্য কটা টাকা বেড়ে সিন্দুকের পর সিন্দুক ভরাবে। দুপায়ের নীচের মাটি ছড়িয়ে পড়ে লাটকে লাট জমিজমা হবে। আজ যে কফোঁটা চোখের জল ফেলে ঘর ছাড়ছো তা সিন্ধুর জন্ম দিয়ে যত মাছচাষের ভেরি হবে। হবে পাকা দালানকোঠা, সোনাদানা,গাড়িঘোড়া, তোমার হুকুমদারি সামলানোর জন্য চাকরবাকর ।জুটবে মোসায়েব আর তাঁবেদারের দল।পাবে চাটুকারদের বাগাড়ম্বর প্রশস্তি।ধরাকে তখন তোমার সরা জ্ঞান হবে। অর্থসম্পত্তির গোমরে মাটিতে পা নাও পড়তে পারে। কিন্তু এও জেনো, তখনও তুমি সুখী নও, বয়সের জোস তোমার মধ্যে তীব্র নারীমুখী আসক্তি তৈরি করছে। তুমি নিজেকে নিজের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারছো না। খালি বেড়া ভাঙ্গার দিকে মন। ওই তাড়নায় তুমি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছো। কিছুই ভাল লাগছে না তোমার। সব থেকেও যেন কিচ্ছুটি নেই। সে হল পদস্খলন হওয়ার কাল। হলে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তার টান খুব, তোমার অর্জিত যা কিছু সব নিয়ে রসাতলে টানবে। তখন তুমি আর কাল বিলম্ব না করে একটি বারের জন্য এই ভিটিতে ফিরে এসো। বাবা মায়ের কাছে না হোক আমার কাছে। তোমার জন্য পাত্রী নির্বাচন করাই আছে। সুলক্ষণা, সর্বগুনে গুণান্বিতা।আমি নিশ্চিত, তাকে পেয়ে তুমি সুখিই হবে। মৌলিনাথ বলে যেতে থাকে, আমি ঠাকুরদার হাত দুটো ধরে ডুঁকরে কেঁদে উঠে বলি, সৎমা আমাকে শান্তি দিল না, বাবা উদাসীন হয়ে গেল আর এখন তুমি আমাকে কোন অজানার দেশে পাঠাচ্ছো ঠাকুরদা, সেখানে পায়ের নীচে মাটি না পেলে আমি যে চিরতরে ভেসে যাব! ঠাকুরদা মিটিমিটি হেসে বলেছিল, সেটি কখনো হবে না। আমি তোমাকে চিনি। সৎমার অত্যাচারে পড়ালেখা হল না, সংসারে টিকতেও পারলে না, কিন্তু তোমার বোধবুদ্ধি তো তোমার সঙ্গেই রইল নাকি! বৈষয়িক বুদ্ধিতে তুমি তুখোড়, বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল। তোমাকে আর ঠেকায় কে। আমার মাথায় তখন ঠাকুরদার হাত। ভোর তখনও ঠিকঠাক নামেনি। পাতলা আঁধারে অগ্রহায়ণ শেষের মিহি কুয়াশা, তাতে ক্লান্ত তারাদের মুখভার করা মেঠো আলো। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাবা মা কিচ্ছুটি জানেনা যে আমি একরকম বাড়ি ত্যাগই করলাম। শুধু ঠাকুরদা জানল। কিন্তু সে সকাল হলে একমাত্র নাতিকে না পেয়ে হৈচৈ বাধিয়ে দেবে।নাতির জন্য পাগল হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। থানাপুলিশে দৌড়বে।এটুকু হবে তার নিখুঁত অভিনয়। সৎমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদিন মনখারাপ করে কাটাল। ঠাকুরদা আমাকে যে দেশে পাঠাল তার কত নাম। বাদার দেশ। আঠারো ভাটির দেশ। বন কেটে বসতের দেশ। বনবিবি, দক্ষিণা রায়ের দেশ। আবাদের দেশ। বাঘকুমিরের দেশ। পুরাণকথিত রসাতলভূমি। ম্লেচ্ছদের দেশ। এখানে ধুলোমুঠি সোনামুঠি হয়। গরীবগুর্বো মানুষগুলোর শ্রম সস্তা। ঘড়ি মেপে সময় চলে না। সূর্য ওঠা থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত মুখে রক্ত তুলে খেটে তবে প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। শাকসবজি, মাছ, চাল সস্তা। আসলে কেনার ক্ষমতা কম লোকের হলে হাহাকার কম হয়। জিনিসপত্র জলের দরে বিকোয়। সে দেশে প্রতিষ্ঠা পেতে বুদ্ধিই বড় সম্পদ। একবার টাকা বেঁধে ফেলতে পারলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না। তারপর থেকে শুধুই উন্নতি আর উন্নতি। তবে ওই, মাথাটি তোমার ঠান্ডা রাখতে হবে, ঘুরে গেলে হবে না। পা দুটোও মাটিতে গাঁথা থাকবে। যা কিছু করার স্বপ্ন দেখবে তা বাস্তবে করে না দেখানো পর্যন্ত থামা নেই। বাধা সে যাই আসুক কাজটা করাই বড় কথা।
মৌলিনাথের কথা এ পর্যন্ত শোনার পরে শ্রোতাদের মনে আলোড়ন ওঠে। এখন আর মৌলিনাথ জীবনের কথা বিস্তারে বলে না। পাপ, অন্যায়গুলোকে কাটছাঁট করে বলে। বয়স তার অনেক হল। চার কুড়ি পার। সেবাযত্নে আছে বলে হয়ত আরও এক কুড়ি পার করে দিতে পারে। কিন্তু একদিন তো চলে যেতেই হবে। তাই চিত্রগুপ্তের খাতায় নিজের জীবনচরিতটি নিজের হাতে পরিশুদ্ধ করে যেতে চায়। যেন ওসব পুরনো কথা আর না প্রকাশ করলে জীবন থেকে বাদই হয়ে যায়। কিন্তু যারা বয়সে মৌলিনাথের সমসাময়িক, এখনও বেঁচে, তাদের অনেকেই পরিস্কার মনে করতে পারে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার দিনটি থেকেই মৌলিনাথ অর্থ উপার্জন করা শুরু করে। ওই যাত্রাপথে সে দুবারই বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করে এবং সৌভাগ্যবশত একবারও ধরা পড়ে না। মৌলিনাথ তখনই বুঝে যায় যে ভাগ্য তার প্রতি সহায় আছে। একার জীবনের প্রথম দিনের দুটি ঝুঁকিতেই সে কৃতকার্য হয়, তাতে করে কিছু পয়সার সাশ্রয় হয়। যদিও লঞ্চের ভাড়া আর খেয়া পারাপারের পয়সা তাকে দিতেই হয়। জীবন যখন একটু উন্নতির পথে, মৌলিনাথের তখন অতীত আর বর্তমানের তুলনা টানতে বসে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলে, এমন একটা দিন ছিল যে সামান্য ট্রেনের ভাড়াটা পর্যন্ত পকেটে ছিল না। ধরা পড়লে বড়জোর থালাবাটিগুলো কেড়ে নিত কিম্বা কদিনের জেল হত।
আসলে নিজের কৃতিত্বকে মহিমান্বিত করতে পয়সা থাকতেও না থাকার গল্প ফাঁদে মৌলিনাথ। বলে, বাদার দেশে মঙ্গলমতো পৌঁছতে পারার সংবাদটুকু বাড়িতে দেওয়ার জন্য একটি পোস্টকার্ড কেনার পয়সা পর্যন্ত তার কাছে ছিল না। অথচ ছিল এবং সে চিঠিও পাঠিয়েছিল। যদিও বাবা মাকে নয়। ঠাকুরদাকে। বাবা তার এই যেনে স্বস্তি বোধ করেছিল যে, মা হারা ছেলেটি তার শুধু বেঁচেই নেই একটি কাজও জুটিয়েছে। কাজই তো প্রাণে বেঁচে থাকার উপায়। এর থেকে বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে।
মৌলিনাথ বলতে থাকে, লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে নতুন দেশ নতুন জগত দেখার অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু কোথাও তো তাকে নেমে পড়তেই হয়। ঘরবাড়ি বেশি, বাজারহাটও আছে এমন জায়গাই তো উপযুক্ত। মানুষের মধ্যে থেকে একজন কৃতি হয়ে ওঠাই আসল কৃতিত্ব। তারপরও দুই মনটানা বলেও একটা ব্যাপার থাকে। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, এখানেই নেমে পড়ো মৌলিনাথ। এখানেই তোমার ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। লঞ্চের টিকিট কাটতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে। কোথায় নামবে মৌলিনাথ? কতদূর যাবে এ লঞ্চ? শেষপর্যন্তেরই টিকিট কেটে নেয় মৌলিনাথ। মাঝে পছন্দের ঘাটে নেমে পড়ার উপক্রম করলে লঞ্চের কর্মী বলে, এখনও তোমার ঘাট আসেনি। যখন আসবে তখন সবাই নামবে। তুমি চাইলে একটা লম্বা ঘুম লাগাতে পারো। শুনল না মৌলিনাথ।কিছু বললও না। তার পছন্দের ঘাটেই নেমে পড়ল। বেলা তখন টনটনে দুপুর। আকাশের নাভিকুন্ডলিতে বসে অকাতরে তাপ ঢালছে সূর্যটা। মৌলিনাথের জঠরেও তখন আগুনে খিদে।পেটে কিছু না পড়লে এ দেহ আর চলে না। খেয়াঘাটের সীমানা পেরিয়ে বাজারের মুখপত্তনে কালীমন্দির। মাটির ঘর, মাথায় খড়ের চাল। সামনে একটি বুড়ো তেঁতুলগাছ। বাড়েনি তেমন। তবে ডালপালা ছড়িয়েছে বেশি। ফলে নীচটা ছায়াময়। পাতা ফুলে ভরেছে। সাষ্টাঙ্গে বড় করে প্রণাম সারে মৌলিনাথ। একটাই কামনা, তুমি আমায় দেখো মা। মৌলিনাথের বিশ্বাস, তিনি দেখলে সব হবে।
এখন পেটকে বুঝ দিতে বাজারের ভেতরে প্রবেশ করে মৌলিনাথ। বেশিদূর এগোতে হয় না। হোটেল ময়না। দরমার বেড়া, কাঠের পাটাতন করা দোতলা হোটেল। বিজ্ঞাপন, সুস্বাদু আমিষ ও নিরামিষ ভোজনালয়। ভাত ডাল আলুচোখা আর কুমড়োর ছক্কা খুব তৃপ্তি করে খেল মৌলিনাথ। একরকম বাধ্য হয়েই দুবার ভাত নিল। পেটের দাবি। বেলাটা ফুরোলেই আঁধার নামবে। এটুকু সময়ের মধ্যে একটা আস্তনার জন্য মৌলিনাথকে হন্যে হতে হবে। নয়তো পয়সা খরচা করে হোটেলে থাকতে হয়। সে একরকম অসম্ভব। ঠাকুরদার মুখে শুনেছে মৌলিনাথ, এ পান্ডববর্জিত ম্লেচ্ছের দেশে দ্বিজের খুব কদর। সম্মানের সঙ্গে মাথায় করে রাখে। বালতি থেকে মগে করে হাত ধোয়ার জল নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় মৌলিনাথ। দেখে, ছাইগাদার পাশ দিয়ে কটা কুকুর ভরপেট এঁটো কাঁটা খেয়ে শান্তিতে ঘুম যাচ্ছে। কুলকুচির জলটা সামনে পিরিচ করে ফেলতে দুটো কুকুর ঘুম জড়ানো লাল চোখ মেলে মৌলিনাথকে খানিক জরিপ করে বার দুয়েক ভুক ভুক ডেকে ফের ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। ভাবটা এমন, যা করেছো করেছো আর কোরো না, শান্তিতে ঘুমোতে দাও। অমন শান্তিতে ঘুমোতে তো মৌলিনাথও চায়। বুকের কাছটা দিয়ে পাঞ্জাবির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পৈতাটাকে টেনে গলার কাছটা দিয়ে খানিক চোখে পড়ার মতো করে বার করে রাখে। ভেতরে এসে হাত মোছার জন্য নিজের গামছাটি পেতে গিট্টু খুলে থালা বাটি গ্লাস তিনটিকে পাশে রাখার সময় বেশ শব্দ করেই রাখে যাতে তার প্রতি হোটেল মালিকের দৃষ্টি আকর্ষন হয়। হলও। পয়সা মেটানোর সময় প্রণাম পেল সেইসঙ্গে আপনি সম্বোধন। জিজ্ঞেস করে, দেশ কোথায়? কী উদ্দেশ্যেই বা এই অল্প বয়সে একা এই বাদার দেশে আসা? মৌলিনাথ একশো শতাংশই প্রায় সত্যি কথা বলে। বাড়ি হুগলি জেলার তারকেশ্বর লাইনে। মা নেই। সৎমার অত্যাচার আছে। বাবা সংসারে অশান্তির ভয়ে ছেলের প্রতি উদাসীন। ঠাকুরমা নেই। দেখার মধ্যে ছিল ঠাকুরদা। সেও মাস ছয়েক আগে গত হয়েছে। ভাগ্যের সন্ধানে সে ঘর ছেড়েছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। আচমন না করে জলস্পর্শ করে না। কোথায় থাকা হবে জানতে চাইলে মৌলিনাথ বলে, কাজ জুটলে থাকার ব্যবস্থা একটা কোথাও হবেই। একে ব্রাহ্মণ সন্তান তার উপর অসহায়। হোটেলমালিক দয়াপরবশ হয়, মনে একটি সুপ্ত বাসনাও থাকে। ব্রাহ্মণ পাচকের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! মৌলিনাথ রান্নার কাজ কিছুই জানে না। হোটেলমালিক বলে, আপাতত পৈতাটা দেখা গেলেই হল। কার হাতে খুন্তি কে রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে যাচ্ছে! ছয় মাস শুধু খাওয়া আর থাকা। এর মধ্যে রান্নাটা শিখে নিতে হবে। মৌলিনাথ মনে মনে বলে, তুমি আছো ঠাকুর!
পরদিন বিজ্ঞাপনটা পাল্টে গেল। ব্রাহ্মণ পাচক দ্বারা রান্না করা সুস্বাদু নিরামিষ আমিষ ভোজনালয়।
এসব গল্প তো মৌলিনাথের মুখেই শুনেছে সবাই। বছর ঘুরতে বাবার চিঠি পেল মৌলিনাথ। ঠিকানায় প্রাপক, মৌলিনাথ চক্রবর্তী। প্রযত্নে, হোটেল ময়না,…। এই ঠিকানাই তো ঠাকুরদাকে চিঠিতে জানিয়েছিল মৌলিনাথ।সে এখন রাঁধুনি মৌলিঠাকুর। এ চিঠি পেয়ে অবাক মৌলিনাথ।ছেলেকে মনে রেখে চিঠি লিখে খোঁজ নেওয়ার মতো মানুষ তো আর সে এখন নেই। তবুও আগ্রহ নিয়ে পড়ে মৌলিনাথ, তোমার ঠাকুরদার শরীরের গতিক ভাল নয়। তাই তিনি তোমার বিয়ে দেখে যেতে চান। তুমি আর কালবিলম্ব না করে চলে এসো। সামনেই কয়টি শুভদিন আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। হোটেলের মালিক গদাধর মন্ডল বলে, শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু ঠাকুর, তুমি যে বলেছিলে তোমার ঠাকুরদা গত হয়েছেন? মৌলিনাথের চটজলদি জবাব, এ আমার নিজের ঠাকুরদার পরের ভাই। ঠাকুরদা মরতে এই ঠাকুরদাই হল আমাদের অভিভাবক।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে অনেক কথাই ভাবছিল মৌলিনাথ। ঠাকুরদার বলা জীবনে দাঁড়ানোর সামান্যতমও তো কিছু হল না। এরই মধ্যে কিনা সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে হবে! একটি জীবনসঙ্গিনীর জন্য মন যে তার উতলা হয় না তা নয়। কিন্তু বিয়ে করে কোথায় সংসারপাতি করবে। এখানে হোটেলের টেবিলে শুয়ে রাত কাটে। কাস্টমারদের চাদর বালিশ ব্যবহার করে। তবে হ্যাঁ, সুখবর এই, ছয় মাসের মায়নার পুরোটাই মৌলিনাথ জমাতে পেরেছে। পাশে দাঁড়াল গদাধর মন্ডল। ব্রাহ্মণে ভূমিদান মহাপুণ্যের কাজ। বলল, ঠাকুর তুমি বিয়ে করে বউমা নিয়ে এসো। আমার ভিটির দক্ষিণে কাঠা দুয়েক জায়গায় তোমায় ঘর বেঁধে দিই। সংসারের প্রয়োজনীয় সবকিছুর আয়োজনও আমি করে রাখব এখন।
বড় খুশি হয়েছিল মৌলিনাথ। সুবিধাগুলো কেমন এক এক করে কত সহজে তার জীবনে চলে আসছে। একে ভাগ্য বলবে নাতো কাকে বলবে। ঠাকুরদা তার একজন বড় দূরদর্শী মানুষ। মৌলিনাথের বিশ্বাস ঠাকুরদার বলা বাকি সবকিছুই তার জীবনে এক এক করে ঘটবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর বিচারবুদ্ধির দরজা খোলা রেখে ওত পেতে থাকা।
লক্ষ্মীমন্ত সুন্দরী বউ নিয়ে কাজের দেশে ফিরে এল মৌলিনাথ। দেখে সকলার চোখ জুরোলো। কিন্তু মৌলিনাথের যৌবনের খিদের উদ্দামতার কাছে বউ সত্যবালা বড় শীতল। আগুনের পাশে শীতল জল থাকলে সে আগুন কি নিজেকে শেষ করে দিতে শীতল জলে সেধে ঝাঁপিয়ে পড়ে? পড়ে না। বরং দূরে সরে গিয়ে আগুনে আগুনে টক্কর নিতে আরেক আগুন খোঁজে। সে টক্করের সিদ্ধি হল নীল
3
অগ্নিশিখা।আগুনশ্রেষ্ঠ।তবুও মনুষ্যপ্রকৃতির সাধারণ নিয়মেই যেন, এক ছেলে এক মেয়ের বাপ হয় মৌলিনাথ। সত্যবালা সন্তানদের নিয়েই সুখি। স্বামীতে অনুরক্ত নয় তেমন।ঘরসংসারের সব কাজই সত্যবালা নিষ্ঠার সঙ্গে করে। স্বামীসেবাতেও কোনও ত্রুটি রাখে না। ফলত কী হয়, বাইরের জগৎ জানে মৌলিনাথের সুখের সংসার। এই জানাটাই মৌলিনাথের ঢাল।
এখন সে মায়নাও বেশি পায়। গদাধর মন্ডলের অবর্তমানে হোটেলের যাবতীয় কাজ দায়িত্বের সঙ্গে সামলায়। সে বিশ্বাস অর্জন করেছে মৌলিনাথ, এর মূল্য সে রাখবে, মানুষটা তাকে কাজ দিয়েছে, বাসস্থান দিয়েছে। তবুও মন তার উচাটন। ঠাকুরদার বলা কথাগুলো আর তো খাটছে না! এই গোনাগুনতি মায়নার কাজ নিয়ে পড়ে থাকলে হবেও না। এক ধারার জীবন নিয়েই আমৃত্যু কাটিয়ে দিতে হবে। যাকে বলে নিতান্তই ছাপোষা মানুষের জীবন।
এরপর হঠাৎই মৌলিনাথ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। কী উপায়ে? সে গল্পগাছা মৌলিনাথের মুখ থেকে কখনও শোনা যায় না। কিন্তু তা চাপাও থাকে না। সুদের কারবারি হরগোবিন্দ দত্ত চোরাই সোনাদানা কেনাবেচারও কারবার করে। সে মানুষ হঠাৎই কালীর থানে সকালবিকেল করে মাথা কুটে কুটে কাঁদে আর মায়ের কাছে কামনা করে, মা, হয় তুই আমার টাকা ফেরত পাইয়ে দে নয় মৌলিঠাকুরের ছেলেকে নে!
শুনে সত্যবালার বুক কেঁপে ওঠে। মৌলিনাথের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে বলে,এ অন্যায়, তুমি ওই টাকা দত্তবুড়োকে ফিরিয়ে দাও। আমার বুক খালি কোরো না গো!
ঘটনা এই, মৌলিনাথ তার গ্রামদেশের কোনো এক জাগ্রত থানের হদিশ দেয় দত্তবুড়োকে,সে থানের ঠাকুরের পা ছুঁইয়ে টাকা ব্যবসায় খাটালে রাতারাতি ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। লোভে পড়ে দত্তবুড়ো। একবারে অনেক টাকা ছুঁইয়ে আনলে ব্যবসায় রমরমা আর কে ঠেকায়। নগদ টাকার জোগান বাড়াতে চোরাই সোনা বেচার সিদ্ধান্ত নেয় দত্তবুড়ো। মৌলিনাথের উপর তার অগাধ বিশ্বাস। কলকাতায় সোনা বেচে টাকা নিয়ে একবারে থানে ছুঁইয়ে আনবে মৌলিনাথ। সে টাকা আর হাতে পায়নি দত্তবুড়ো। থানাপুলিশও করতে পারেননি। চোরাই সোনা যে!
এ ঘটনা এক কান দুকান করে রাষ্ট্রময় হয়। মৌলিনাথ বুক ঠুকে বলে, যত্তসব মিথ্যা অপপ্রচার!
সত্যবালা দত্তবুড়োর পায়ে পড়ে কাঁদে, বলে, আমার দায়িত্ব, ওই টাকা আপনি সময়ে ঠিক ফেরত পাবেন।
সে সময় আর এল না। মৌলিনাথই আসতে দিল না। টাকার শোকে শোকে দত্তবুড়োও আর বেশিদিন বাঁচল না। সে বছরই মৌলিনাথ ঘোষণা করল, কালীর থান পাকা করার পুরো খরচ তার। মূল মন্দিরের চারিদিকে চওড়া বারান্দার ঘের, চূড়ো আকাশছুঁই।সামনে তেঁতুলগাছটা ঘিরে চবুতরা, তার মাথায় টিনের ছাউনি, গ্রীষ্ম বর্ষায় ভক্তদের সুবিধা। ধন্য ধন্য পড়ল মৌলিনাথের নামে।
স্বামীর এতবড় মহৎ কাজেও সত্যবালা গর্বিতা না হলেও এইসূত্রে মায়ের কাছে যে ছেলের দীর্ঘ পরমায়ু মাঙেনি এমনটাও নয়।
উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় মৌলিনাথ এখন প্রভূত বিষয়সম্পত্তির মালিক। কাঠের গোলা, মুদিদোকান, কাপড়ের দোকান, খেয়া পারাপারের ঘাট, মাছের ভেরি, চাষের জমি, লাটে মস্ত খামারবাড়ি।এই খামারবাড়িতে মাঝেমধ্যেই সময় কাটাতে আসে মৌলিনাথ। যাকে বলে অবসরযাপন। তাকে দেখভালের লোকজন আছে। বয়স তো কম হল না। একটু আরাম আয়াসে ভোগের প্রবৃত্তি হয়। সত্যবালা মৌলিনাথকে সে সুখ দেয়নি। সত্যবালা সংসারে শুধু সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। মৌলিনাথ মনে মনে বলে, সে লক্ষ্মী ঠাকুরঘরেই থাকুক না হয়!
বড় দুঃখ মৌলিনাথের, ঠাকুরদা তার এত আয় উন্নতি দেখে যেতে পারল না। সে মানুষ মরতে মৌলিনাথ গ্রামদেশের পাট বরাবরের জন্য চুকিয়ে দেয়। কেমন আছে তার বাপ, সৎমা, সৎ ভাইবোন? কিচ্ছু জানে না মৌলিনাথ। যেন এ জন্মের নয়, গত জন্মেরও নয়, বহু জন্মের আগের ক্ষীণ রক্তধারা বুকের মধ্যে একাকীত্ববোধের সময় টের পায়। কিন্তু সে আর কতটুকু সময়ের জন্য। নিজেই নিজের উপর আক্রোশ দেখিয়ে মুহূর্তে সব ঝেড়েমুছে মন থেকে দূর করে দেয়। তখন বেশ একটা স্বস্তি বোধ করে। পিছুটানকে যত দূরছাই করা যায় ততই সামনে এগোনোর চেষ্টা বাড়ে। এটাই সার বোঝে মৌলিনাথ।
হোটেল ময়নার মালিক বৃদ্ধ গদাধর মন্ডল এখন আর হোটেলের ক্যাশে বসে না। একরকম গৃহী-সন্ন্যাসী। ভিটির যে অংশ সে মৌলিনাথকে দান করেছিল সেখানে এখন মস্ত রাধাগোবিন্দের মন্দির। মৌলিনাথই গড়ে দিয়েছে। ভক্তদের সমাগমে গমগম। সকাল সন্ধ্যায় কীর্তন হয়। হয় প্রসাদ বিতরণ। এসব নিয়েই মেতে আছে গদাধর মন্ডল। ধর্মকথার পাশাপাশি মৌলিনাথের কথা সে না তুলে শান্তি পায় না। কী মানুষ বাদারদেশে এলো আর সে কোথায় পৌঁছে গেল! গর্ব করে বলে, মানুষটার জীবনে দাঁড়ানো সে তো আমার হাত ধরেই নাকি। অবশ্য গদাধর এও মানে, বিনিময়ে মৌলিনাথ তাকে দিয়েছে ঢের ঢের বেশি। মৌলিনাথের দয়াতেই তার ভিটে এখন পূণ্যধাম। ফি বছর শীতে ষোলদিন ধরে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন হয়। দূর দূর গ্রাম থেকে ভক্তরা আসে। তারা বলে, মন্ডল বাড়ির কীর্তন। এতে করে মৌলিনাথের সঙ্গে তার নামও কি ছড়িয়ে পড়ছে না! দক্ষিণার বাক্স উপচে ওঠে। মৌলিনাথ বলে, এর একটি পয়সাও অসৎ কাজে ব্যয় হবে না!
মন্দিরের উন্নয়নে ব্যয়, ঝড় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের দান, লঙ্গরখানা খুলে কাঙালিভোজন করানো ইত্যাদি ইত্যাদি হয়। ফলে কী হয়, মৌলিনাথের যা কিছু অপকর্ম, সব মানুষের মন থেকে সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে যেতে থাকে । কথায় বলে,শেষ বয়সে ধর্মকর্ম কেন করে মানুষ, এ জীবনের যা কিছু পাপ তাকে পূণ্যে রূপান্তরিত করার জন্যই। নয়তো স্বর্গের পথ বন্ধ।
মৌলিনাথের এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা। প্রবল বারমুখী মনের সঙ্গে ব্যবসাবানিজ্য, বিষয়সম্পত্তির প্রতি ঘোর আসক্তির দুর্দান্ত ভারসাম্য রক্ষা করা। লোকে তাই অবাক হয়ে প্রশংসা করে বলে, এ মানুষের লয়ক্ষয় নেই!
নদীপারের সেই নিতান্তই গেঁয়ো হাটবাজার আজ আর নেই। সে এখন কলেবরে আর বৈভবে বেড়ে জমজমাট গঞ্জ। নদীর দুপার ব্রীজে বাঁধা পড়তে শহর কলকাতা উপচে পড়ে গঞ্জে ডানা মেলছে। এখন লোকে বলে টাউন। সে গঞ্জের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে মৌলিনাথের পেল্লাই পাঁচতলা বাড়ি। গৌরিনাথ ভবন, ঠাকুরদার নামে। যারা নতুন এদিকে আসে তারা অবাক চোখে গৌরিনাথ ভবনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরের চাকচিক্য মন গিলে নেয় তাদের। ভেতরের অন্ধকার,
4
নিঃসঙ্গতার হাহাকার বাইরে ধরা দেয় না। কটামাত্র তো মানুষ। ঘরের লোকের চেয়ে কাজের লোক বেশি। তিন চারটে ঘর মাত্র ব্যবহার হয়, বাকি সব খা খা। মৌলিনাথের একমাত্র ছেলে দিব্যনাথ বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় থাকে। বাপের ব্যবসায়বানিজ্যে কোনওদিনই তার মন ছিল না। লেখাপড়া শিখে নিজের চেষ্টায় বড় চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। একমাত্র মেয়ে গায়ত্রীকে সুপাত্র দেখে বড় ঘরে বিয়ে দিলে কী হবে কপালে সুখ সইল না তার। বছর দুই না ঘুরতে বিধবা হয়ে মেয়ে কোলে বাপের বাড়ি ফিরে এল। শ্বশুর বাড়িতে তার বেজায় বদনাম হয় অপয়া বলে।
মৌলিনাথ চাইলেই সোনার পালঙ্কে শুতে পারে, সোনার থালায় রাজভোজ খেতে পারে, ঠাঁটবাটে রাজসিক হতে পারে। কিন্তু না। বড় কৃচ্ছ্বসাধনার জীবন তার । নীচতলার এক ছোট ঘরে একার বসবাস। দেয়ালজুড়ে যত দেবদেবীর ফটো। প্রতিদিন ওগুলোতে মালা চড়ে। একটা নিচু তক্তাপোষ, তাতে সামান্য বিছানা। এককোণে ছোট একটা পিতলের কলসী, মুখে মাটির সরার ঢাকনা। ঢাকনায় উপুড় করা একটা কাঁসার গ্লাস। বিছানার পাশ দিয়ে ছোট একটা কাঠের আলমারি। তার একটা প্রকোষ্ঠে সেই গামছাটা দিয়ে জড়ানো তার সেই অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাটি গ্লাস তিনটে। অন্য একটা প্রকোষ্ঠে সামান্য কিছু জামাকাপড়। বাকিগুলোতে নানা ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ, পুঁথি। একরকম টাকাপয়সা সোনাদানা বর্জিত ঘর। ঢের থাকলেও মনে যেন এখন আর ওসবের স্থান নেই। মাথায় কদমছাঁট চুল। হাঁটুর উপর মোটা ধুতিকাপড়। গায়ে ফতুয়া। গলায় তিন ফেরতা তুলসীমালা। গায়ে রসকলি। হাতে ধরা জপের মালা। বয়স্ক ভক্তজনেরা সকাল বিকেলে আসে, ধর্মকথা হয়, হয় নানাজনের নানা সমস্যার কথা, মৌলিনাথ তাদের সমাধানের পথ দেখায়। ব্যবসাবানিজ্যের দেখভাল কর্মচারীরা করলেও পোড়খাওয়া মৌলিনাথের সেসবের গতিপ্রকৃতি বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়।
খুব কাছের মানুষ বলতে মেয়ের ঘরের নাতনি অম্বিকা। তার শত আব্দার আর চাহিদার এতটুকু অপূর্ণ রাখে না মৌলিনাথ। গায়ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে, এই করে নাতনির মাথা খাচ্ছো তুমি। শেষে না হাতের বাইরে চলে যায়।
এমন কথায় মৌলিনাথ হেসে মেয়েকে আশ্বস্ত করে, ও আর এ সংসারে কদিন। আঠারোয় পড়লেই ধুমধাম করে বিয়ে দেব। ছেলে আমার সাথ দিল না। একা মানুষ কত দিকে আর সামলাই। এই চিন্তায় চিন্তায় কোনদিন যে হঠাৎ চোখ বুজি! তা চোখে তুলসীপাতা পরার আগে সব ব্যবস্থা যেন করে যেতে পারি রে মা। তোকে কত করে বললাম, ফের বিয়ে দিই, তা রাজি হলি না। এখন নাতনি বড় হয়েছে। আমার এত বিষয় সম্পত্তি, অম্বিকার জন্য কিছু খরচা করে যদি আমি মনে শান্তি পাই তাতে তুই বাধা কেন দিবি মা!
মৌলিনাথ কখনও বলে না যে, নাতনি অম্বিকা আস্কারা পেয়ে পেয়ে আজকাল কতটা দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে।তার নিত্যনতুন বায়নার ফিরিস্তি সামলাতে গিয়ে মৌলিনাথও কখনও কখনও অসহায় হয়ে পড়ে। যখন যা দাবি করে তা তার তক্ষুণি চাই। গঞ্জে না পাওয়া গেলে জলদি কলকাতা থেকে আনা করিয়ে দিতে হয়। অন্যথায় অশান্তি করে সারা বাড়ি মাথায় তোলে। আক্রমণাত্মক ব্যবহার করে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে মৌলিনাথ। ভাবে আজই বুঝি তার শেষের সেই দিন। অম্বিকার বাঁ পায়ের একটি মোক্ষম লাথি এসে পড়বে মৌলিনাথের গায়ে, মৌলিনাথ ছিটকে পড়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না, ওখানেই তার শেষ নিঃশ্বাস পড়বে।
খামারবাড়ির কাজের মেয়ে ফুলমনি মন্ডল মৌলিনাথকে এমনটাই অভিশাপ দিয়েছিল। সেদিন থেকে মৌলিনাথের মৃত্যুর আতঙ্ক। যেকোনও উঁচু জায়গায় ওঠায় ভয়। কখন অম্বিকা বাঁ পায়ে আঘাত করে! আর সে নীচে গড়িয়ে পড়ে মরে।
সে এক ঘটনা।
মৌলিনাথ তখন খামারবাড়িতে খুব সময় কাটায়। বিধবা ফুলমনি মন্ডল মৌলিনাথের দেখভাল করে। বয়স ত্রিশের উপরে না। আঁটোসাঁটো যৌবন। দেখতেও সুশ্রী। আচার ব্যবহার মনে ধরার মতো। ওতেই মজে মৌলিনাথ। ফুলমনিকে স্বপ্ন দেখায়, তাকে আরেক বউ করে এই খামার বাড়িতে রাখার। ছেলেমেয়ের দেখভালের দায়িত্বও তার। তাতে করে ফুলমনির ভাগ্যে সুখই সুখ হবে। ফুলমনি রাজি হয় না, একে বিধবা, তার উপর ছোটঘরের মেয়ে সে, এ বিয়েতে মহাপাপ হবে। চৌদ্দপুরুষের নরকবাস নির্ঘাত।
মৌলিনাথ বলে, তাহলে দেহসুখ দাও ফুলমনি। তাতেও তোমার সুখের অভাব রাখব না।
এতেও ফুলমনি অরাজি।
একটা তুচ্ছ মেয়েছেলের এতটা আস্পর্ধা থাকবে কেন! বড্ড মানে লাগে মৌলিনাথের। একদিন সুযোগ পেয়ে বলিষ্ঠ দুহাতে ফুলমনিকে জাপ্টে ধরে বুকে টানার চেষ্টা করে। প্রবল এক ঝটকায় ফুলমনি মৌলিনাথকে দূরে ছিটকে ফেলে। মাটিতে পড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মৌলিনাথ। মুখে কথা ফোটে না।
ফুলমনির চোখেমুখে প্রতিশোধের আগুন। অভিশাপ দেয়, মেয়ের ঘরের নাতনির বাঁ পায়ের লাথি খেয়ে নীচে পড়ে তোমার মৃত্যু !
এর থেকে বড় অভিশাপ নাকি আর হয় না। তাতে অখন্ড অনন্ত নরকযন্ত্রণা।
মেয়ে বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলে মৌলিনাথের তাই আতঙ্ক। মেয়ের কোলে বসে তার মৃত্যুপরোয়ানা!
মৌলিনাথ চেয়েছিল মেয়েকে ফের বিয়ে দিয়ে এই আপদ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে। কিছুতেই রাজি হয়নি। বলে, এ হয় না বাবা। আমার কপালের লিখন। মানুষটার আত্মা কষ্ট পাবে।
অম্বিকারও বিয়ে দিতে পারেনি মৌলিনাথ। তার বড্ড বাছবিচার। পাত্র আর পছন্দই হয় না। সময় তো আর থেমে থাকেনি। অম্বিকা এখন বিগতযৌবনা, চুলে পাক। খল মন, চূড়ান্ত লোভ লালসা, হিংস্র স্বভাব। শরীরেও এসবের প্রভাব পড়ায় কুৎসিতদর্শন। সবসময়ের জন্য ওৎ পেতে থাকে সংসারে একটা বড় কান্ড ঘটাবার, যাতে লাথিটা কষাতে পারে। ভয় পায় মৌলিনাথ।
সত্যবালা কেঁদে বলে, আর কত চোখে চোখে রাখব তোমায়? কেন নাতনিকে এত ভালবেসে মাথায় তুলে রেখেছিলে তুমি!
কৈফিয়তই চায় সত্যবালা। মৌলিনাথ মুক।
উঁচুতে ওঠা বন্ধ মৌলিনাথের!