মা দিবস স্পেশাল – এ আফতাব হোসেন

নেগেটিভ ভাইব

(১)

– ‘ কাম অন মিতু , এই বস্তাপচা মার্কা গেঁয়ো সেন্টিমেন্ট থেকে কবে বেরোবে শুনি ‘ ?
একটা ছোট সিপ মেরে বললো রমিত ।
মিঠুন চুপ ।

– ‘ শোন মিতু , উত্তম সুচিত্রা আর হঠাৎ লোডশেডিং এর যুগ আর নেই । আমরা এখন হেব্বি ম্যাচিওর আর সাথে লজিক্যালি এডাল্ট , প্লিস মিতু আজকের দিনটা এভাবে নষ্ট করে দিও না , আমি আসছি একটা ছোট্ট বানিয়ে , স্টে টিউন প্লিজ ‘ ।

মিতুন চুপচাপ শুনছিল রমিতের কথাগুলো একমনে । রমিতকে ওই পছন্দ করেছিল । একই কোম্পানির দুজনে । কপালফেরে একই প্রজেক্ট এর । বিদেশি ক্ল্যায়েন্ট দের ফরমায়েসির চাপে প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়া মিতুন এর যখন ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা তখন কলকাতার ব্রাঞ্চ থেকে সুদূর ব্যাঙ্গালোরের এই প্রজেক্টের ডেভলপার হয়ে রমিতের জয়েন । বিদেশ বিভূঁই এ একজন বাঙালিকে পেয়ে মিতুনও বেঁচে গিয়েছিল । আসলে সহজ সরল আর অগোছালো লাবণ্য মার্কা ছেলে নয় রমিত । রীতিমত ফিটফাট আর ওয়েল মেন্টেনেন্ট করে রাখে নিজেকে সবসময় । ছেলে হয়েও ঠিক কিভাবে এতটা পরিপাটি রাখতে পারে নিজেকে সেটা ভেবে মিতুন অবাক হলেও একটা হালকা ভালোলাগা হয়ত সেই জন্যই ছড়িয়ে গিয়েছিল মিতুনের মনে । আসলে মিতুন বরাবরই একটু গোছান , পরিপাটি , ওর বাবার মত । ওর বাবা প্রায়ই বলতেন , – ‘শোন মিতুন কেয়ারলেস বিউটি বলে কিছু হয় না , হলেও ক্ষণিক ‘ ।
রমিত শুধু সাজসজ্জায় নয়, টিম ওয়ার্ক আর নিজের কাজেও প্রচন্ড পটু । দু বছর ধরে প্রজেক্টটা প্রায় একাই উৎরে দিয়ে গত রাতেই ক্লায়েন্ট মিটিং শেষ করে সব্বাই যখন যুদ্ধজয়ের আনন্দে গা ভাসিয়ে রিলাক্স মুডে ছিল তখনই কানের সামনে আলতো স্বরে রমিতের আওয়াজ শুনলো মিতুন
– ‘ কাল দুপুরে লাঞ্চ কি একসঙ্গে করতে পারি ? আমার ফ্ল্যাটে ? আমিই সেফ হব ‘।
একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় লাল হয়েছিল মিতুন ।
মানা করার মত অজুহাত খোঁজার চেষ্টাই করেনি আর ।

(২)

– ‘ শোন মিতুন , মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোবি না একদম ,আর বাইরে মাস্ক খুলবি না দরকার ছাড়া ‘

ফোনে কোনরকমে হ্যাঁ বলে মা রাখছি বলার আগেই একগাদা শব্দ আবার উড়ে এলো

– ‘শোন বাবা দশ টাকার একটা লাইফবয় সাবান কিনে নিস অফিসে , ওটা দিয়ে হাত ধুয়ে নিবি বার বার , খবরে দেখাচ্ছিল স্যানিটাইজে হাতে র্যাশ হয় ‘

মিতুন এবার একটু বিরক্তই হয় । ব্যস্ততার খাতিরে মা রাখছি বলে ফোনটা রেখে দিয়েই বুঝলো মেজাজটা আরো একটু বিগড়ে গেল মনে হয় । আসলে মিতুন বরাবরই একটু ডেয়ারডেভিল টাইপের । সাথে ভীষণভাবে স্বাধীনচেতা । সমাজের বেঁধে রাখা নিয়মগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ছোট থেকেই মজা পেত মিতুন । অবশ্য এ ব্যাপারে মিতুনের বাবাও প্রতিমুহূর্তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিতুনের পাশে । ওর মা অবশ্য বরাবরই একটু সেকেল । মিতুনের বাবা যাবার পর এই সেকেলভাবটা দিন দিন বেড়েছে । জেনারেশন গ্যাপ বলে নিজেকে স্বান্তনা দেওয়া মিতুনেরও মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ের এই নেগেটিভ ভাইব গুলো ওর মনেও নেগেটিভিটির একটা হালকা আস্তরণ তৈরি করে রেখেছে পার্মানেন্টলি । না হলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেই প্রথম দিনটাই যেদিন বিশ্রী ভাবে র্যাগ হল সিগারেট খাওয়া নিয়ে , মিতুন চাইলেই পারতো দু চার টান অবলীলায় টেনে দিতে কিংবা ইনফোসিস এর প্রথম জয়েনিং লেটার পাবার পর হোস্টেল মেটরা সব্বাই যখন ওল্ড মন্কে গলা ভিজিয়ে চিয়ার্স করে নিজেদের বেকার জীবনের ভার্জিনিটি বিদায় দিচ্ছিল , সেদিনও খুব খুব চেষ্টা করেও ডেয়ারডেভিল মিতুন একটানও বা এক পেগ ও মুখে তুলতে পারেনি । পারেনি বললে ভুল হবে বরং মোক্ষম মুহূর্ত গুলোই মিতুনের মায়ের সাবধানবানি বারবার ভেসে এসে মিতুনের সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল । কলেজের বন্ধুরা তো বলেই দিত মিতুনের মা নাকি ভার্চ্যুয়ালি সবসময় মিতুনের সঙ্গে থাকে । আজ সকাল থেকেও মিতুন ওর মায়ের নেগেটিভ ভাইব ফিল করেছে বারবার । গতকাল রমিতের লাঞ্চ টার ইনভাইটটা একসেপ্ট করার পর যখন মিতুন বাকিদের কাছ থেকে যখন শুনলো শুধুমাত্র মিতুনই ইনভাইটেড একা , তখনই অনেকটা ভালোলাগার আড়ালেও কেমন একটু গুটিয়ে গিয়েছিল মিতুন । যদিও সারা রাত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেও মিতুন বুঝতে পারেনি ও কুঁকড়ে গেছে কেন । নিজেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে ও তো রমিত কে পছন্দই করে , তাছাড়া চেষ্টা করলেও হয়ত এর চেয়ে ভালো সম্পর্ক মিতুন আর পাবে না , পেলেও রমিতকে না করার একটাও কারন হাজার ভেবেও মিতুনের মাথায় আসেনি । তাও কেন যেন মিতুনের বারবার কোথায় একটা বাধা আসছিল । বিরক্তির ভাবটায় কি করবে খুঁজে না পেয়ে ওর মা কে ফোন করেছিল । এখন বুঝলো মনে হয় ঠিক করেনি । সুদূর কলকাতা থেকে নেগেটিভ ভাইবটা ফোনেও চলে আসছে মনে হয় ।

(৩)

রমিত এগিয়ে আসছিল একটু একটু করে । চোখগুলো বড্ড রঙিন লাগলো মিতুনের , নাকি ছলছলে বুঝতে পারলো না । সবসময় ফিটফাট আর ওয়েল মেন্টেন রমিতকে এভাবে শর্টসে কোনদিনও দেখেনি মিতুন । টু বি এইচ কে এর কামরার আলতো রোদ এর মিষ্টি পরশে মিতুনের চোখে কি দেখলো রমিত কে জানে । ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি এনে মিতুনের দিকে এগিয়ে আসার গতিটা আরো একটু বাড়ালো মনে হয় । মিতুন প্রাক্টিক্যালি বুঝলো ক্লাস টেনের সেই বায়োলজি ক্লাসের জরুরিকালীন হরমোন চ্যাপ্টারটা । নিজের ঘাড়ের ঠিক নীচে আর কানের লতি বরাবর ল্যাকমি ফ্লোরা পারফিউমের ছিটে পড়ে তেতে থাকা জায়গাটার কাছে রমিতের নাকের গরম শ্বাস অনুভব করে মিতুন বুঝলো ও আর নিজের কাছেই নিজেই নেই হয়ত । রমিতের রঙিন জলের গরম শ্বাসটা নিজের ঠোঁটের একদম ওপর অনুভব করে চোখ বন্ধ করতেই মিতুন টের পেল ওর মায়ের মুখটা , অনুভব করলো সেই নেগেটিভ ভাইবটা , যেটা আজীবন মিতুনকে তাড়া করে বেড়িয়েছে মোক্ষম মুহূর্তে । আজকেও সেই নেগেটিভ ভাইবটাই কখন , কিভাবে রমিতের ওই দু কামরার মোহময়ী ফ্ল্যাট থেকে রমিতকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মিতুনকে নিজের কামরায় নিয়ে এলো তা এখনো বুঝে উঠতে পারে নি মিতুন । শুধু খালি মাথায় দু একবার ডুগরে কেঁদে উঠতে গিয়েও যখন কান্না বেরোলো না তখন মা কে ফোন টা লাগালো মিতুন ।
কোনরকমে বললো হ্যালো মা …..
হ্যাপী মাদার্স ডে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।