সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৪১)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৪১

অঞ্জলির মনের জ্বালাটা একটু প্রশমিত হয়। পুলিশের একটা গাড়ি সনাতনদের নিয়ে চলে যায়। অন্য একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায় তার সামনে। বাইরে থেকে আসা সেই অফিসার বলেন, তোমার মাকে নিয়ে তুমি চল সিউড়ি সদর হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। অফিসারের কথাটা শুনেই অসহায়ের মতো চারিদিকে তাকায় সে। শুধু মাকে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে যেতে তার সাহস হয় না। অভিযোগ লেখানো নিয়ে যা হলো তারপর পুলিশের সঙ্গে সে কোন ভরসায় একা মাকে নিয়ে যাবে ? কি করতে কি করবে তার তো কোন ঠিক নেই। তাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে মামলাটাই বানচাল করে দেবে না তো। শেষ পর্যন্ত সেই সাংবাদিক দুজনকে দেখে কাছে ডেকে বলে — আপনাদের একজন যাবেন আমাদের সঙ্গে ?
—- তারা বলে না যাওয়ার কোন ব্যাপারই নেই। আপনারা না ফেরা পর্যন্ত তো আমাদের এখানেই থাকতে হবে। তাই ঘুরে আসা যেতেই পারে। চলুন যাচ্ছি।
কিছুটা স্বস্তি পায় অঞ্জলি। মাকে নিয়ে সে ওই সাংবাদিকের সঙ্গে পুলিশের গাড়িতে গিয়ে ওঠে। সাংবাদিককে দেখে পুলিশ অফিসার একটু ভ্রু কুচকালেও কিছু বলেন না। খুব দ্রুত পরীক্ষাটা হয়ে যায়। পুলিশ অফিসার যখন হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন সাংবাদিক তার কাছে এসে খুব চুপি স্বরে বলেন , কোন চিন্তা নেই। রেজাল্ট পজিটিভ। আমি ডাক্তারের কথা রেকর্ড করে নিয়েছি। বলা যায় না পরে পালটি খেয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট লিখে দিতে পারে। সেই হিসাবে দেখতে গেলে আমার আসাটা ভালোই হয়েছে।
অঞ্জলির বুঝতে অসুবিধা হয় না রেজাল্ট পজিটিভ মানে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। তার খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু সেই রাতের কথাটা মনে পড়তেই দারুন বমি পায় তার। সেই রাতের সেই ঘটনার পর থেকেই এই উপসর্গটা জুটেছে তার। শুধুই বমি বমি পায়। ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু পুকুরের জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। খুব ক্লান্ত লাগে তার। গাড়িতে ওঠে মায়ের কাধে মাথা রেখে শিটে বসেই ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে দেয় সে। ওইভাবেই গ্রামে ফেরে তারা। গ্রামে ফিরতেই তাকে ছেঁকে ধরে সাংবাদিকরা। গ্রামে তখন লোকে লোকারণ্য। দফায় দফায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই তাকে পাকড়াও করেন রামবাবুরা। তাকে নিয়ে নাকি মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। রামবাবু এগিয়ে এসে বলেন , এত বড়ো একটা নারকীয় কাণ্ড কিছুতেই মুখ বুজে মেনে নেব না আমরা। দোষীদের উপযুক্ত সাজা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেব। তাই জনমত গঠনের জন্য তোমাকে নিয়ে আমরা আজ মিছিলের ডাক দিয়েছি।
—- অঞ্জলি মনে মনে ভাবে এতক্ষণে আপনাদের জনমত গঠনের কথা মনে পড়ল ? জরিমানা আদায়ের জন্য যখন আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল তখনই তো আপনাদের কাছে খবর পৌঁছেছিল। কিন্তু সে সময় কই আপনারা এসে একবার খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন নি তো। আর এখন তো ঘোলাজলে রাজনীতির মাছ ধরতে এসেছেন। কিন্তু মুখে সে কথা বলতে পারে না অঞ্জলি। এই দুঃসময়ে আর শত্রু বাড়াতে চাই না সে। রামববাবুদের মিছিলে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও যোগ দিতে হয় তাকে। ভ্যান রিক্সায় তাকে দাঁড় করিয়ে রামবাবুরা মাইকে কান গরম করা শ্লোগান দিতে দিতে সারা শহর ঘোরায়।
অঞ্জলি লক্ষ্য করে পথচারী মানুষজন , ব্যবসাদারেরা কেউই শ্লোগান কিম্বা বক্তব্য শুনছিল না , আজব দৃষ্টিতে কেবল তাকেই দেখছিল। কেউ কেউ আবার গিলছিল। আর লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছিল তার। মুখ তুলে তাকাতেই পারছিল না।মিছিল শেষে রামবাবুরা চলে যেতেই সুহাসবাবুরা তাকে এসে ধরে। তারাও নাকি দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে মিছিলের ডাক দিয়েছেন। রামবাবুদের মতোই সেই মিছিলে তাকে থাকতে হবে। কথাটা শুনেই তার কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। যারা অভিযুক্ত তারা তো সুহাস বাবুদেরই দলের লোক। তাহলে তাদেরই শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করবেন সুহাসবাবুরা ? রাজনৈতিক দলের কাছে এতটা সদিচ্ছা আশা করা যায় ? আর সত্যি যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে সুহাসবাবুদের আন্দোলন করতে হবে কেন ? শাসকদল হিসাবে আন্তরিক ভাবে চাইলেই তো শাস্তি অবধারিত। তার মুখে সংশয়ের চিহ্ন ফুটে উঠতেই সুহাসবাবু বলেন , এ নিয়ে আমরা বরং পরে কথা বলব। হাইকমাণ্ডের নির্দেশ এসেছে, বিষয়টিকে কোন বিরোধী দলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার সুযোগ দেওয়া চলবে না। অগত্যা সুহাসবাবুদের মিছিলেও যেতে হয় তাকে। রামবাবুদের মতো সুহাস বাবুরা তাকে ভ্যান রিক্সায় দাঁড় করিয়ে গোটা শহর পরিক্রমা করেন।আর তা দেখতে রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে যায়। রামবাবুদের মিছিলে যারা তাকে দেখতে পাননি, খবর পেয়ে সবার আগে ভীড় জমিয়েছেন তারা। আর কেউ সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজী নয়। সে যেন কোন মানুষ নয়, চিড়িয়াখানা থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ভাড়া করে আনা এক আজব জন্তু। চুক্তি শেষ হলেই চিড়িয়াখানা ফিরিয়ে নেবে। তাই একবার চোখের দেখা যেন সবার চাই ই চাই।
আর হাজারও দৃষ্টির সামনে তার বার বার মনে হচ্ছিল, মাটি ফেটে দু-ফাঁক হয়ে যাক। সে ঢুকে লজ্জা জুড়ায়। সে ভাবে, যদি নেতাদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটত তাহলে কি রাজনীতির হাটে তার মান-সম্ভ্রমকে এভাবে নিলামে চড়িয়ে দেওয়া হত ?
রাজনীতির কারবারিরা কবে বুঝবেন, এভাবে রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহির করা যায় , নির্যাতিতার গৌরব বাড়ে না। নেতাদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এহেন নগ্ন নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা দেখে তার খুব অবাক লাগে।
কিন্তু তার অবাক হওয়ার আরও কিছুটা বাকি ছিল। বাড়ি ফেরার পথে সেটাও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সুহাসবাবুই তাকে গাড়িতে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁচ্ছে দিতে আসছিলেন। আজকে তারাই যে প্রকৃত আন্দোলন নেমেছেন সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের নাকি ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়ে জানাতে হবে তাকে। উপরতলার নেতারা নাকি সেরকমটাই নির্দেশ পাঠিয়েছেন। তাই তাকেও বাড়িতে পৌঁচ্ছে দেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।সুহাসবাবুর সঙ্গে গাড়িতে যেতে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এই সুহাসবাবুদের চক্রান্তের জন্যই তো বাবাকে মোড়ল পদ হারাতে হয়েছিল। সুহাসবাবুদের চোখ রাঙানির ভয়েই তো কেউ বাবাকে কাজ দেয় নি। আর তাই পেটের দায়ে কাজ খুঁজতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে বাবা। একথা সে ভুলবে কেমন করে ? কিন্তু করবেই বা কি ? অসহয়তার সুযোগে সবাই তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে জেনেও মুখ বুজে সব মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু সুহাস বাবুর কথা শুনে আর সে চুপ করে থাকতে পারে না। মাঝপথে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে সুহাসবাবু বলেন, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি মন দিয়ে শোন।
হঠাৎ সুহাস বাবুকে ওই ভাবে কথা বলতে শুনে সে একটু অবাক হয়ে যায়।তাই চট করে সে কিছু বলতে পারে না। আর তা লক্ষ্য করে সুহাসবাবু বলেন, দেখ আমি বলি কি , যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। যাই করো না কেন , কিছুতেই তো আর কিছু ফিরবে না। মাঝখান থেকে আমাদের পার্টির কতগুলো লোকের বদনাম হবে।তাছাড়া পার্টি যখন শাসন ক্ষমতায় আছে তখন খুব বড়ো কিছু শাস্তি ওদের হবে না। তাই বলছিলাম কি সনাক্তকরণের সময় তুমি বলবে কাউকেই চিনতে পারছো না। রাতের অন্ধকারে কে কি করেছে তুমি দেখতে পাও নি। তাহলে আমাদের পার্টি থেকে তোমাকে একটা অঙ্গনওয়াড়ির চাকরি দেওয়া হবে

কথাগুলো শুনেই দপ করে মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে যায়। রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছা হয় তার। আবার বমি পেতে শুরু করে। কোন রকমে সামলে নিয়ে বলে — কি বলছেন আপনি ?
দোষীদের শাস্তির দাবিতে লোক দেখানো আন্দোলন করে এসে এখন এই ধরণের কথা বলতে আপনার লজ্জা করছে না ? কতগুলো ধর্ষকের বদনামের কথাই আপনার মনে হল, অসহায় একটি মেয়ের সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণার কথা আপনাদের মনে হলো না ?
— সে জন্যই তো বলছি – – -।
— কি বলছেন ? চাকরি দেবেন ? কে চেয়েছে আপনাদের কাছে চাকরি? আপনার বাড়ির কোন মেয়ের সঙ্গে যদি এমনটা হত তাহলে বোধহয় হয় চাকরির বিনিময়েই রফা করে নিতেন ? মেয়েদের মান-সম্মান আপনাদের কাছে চাকরি কিম্বা টাকার অঙ্কে বিবেচিত হয় ? ছিঃ আপনার সঙ্গে বসে থাকতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে, আমায় নামিয়ে দিন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।