ক্যাফে গদ্যে অন্তরা ঘোষ

খুঁজে ফেরা

বিকেলের আলো নিভে এসেছে। শূকলাল গামছায় মুখ মুছে জুতো পালিশের বাক্সটা সাইকেলের পিছনে রেখে সাইকেল চালিয়ে বইয়ের দোকানের সামনে এলো। আজ খুব বেশি কাস্টমার পায়নি। মাত্র পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়েছে। অভ্যাস মত আজকেও আড়াই টাকা দিয়ে বর্তমান কাগজ কিনলো। ছোট থেকেই কলকাতায় বাস তাই বাংলাটা অল্প অল্প পড়তে জানে শূকলাল।
বছর ষাটের কিছু বেশিই হবে শূকলালের বয়স। সামনের পার্কটায় বসে ঝোলা থেকে জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে জল গলায় ঢাললো। গামছা দিয়ে মুখ মুছে খানিক জিরিয়ে নিয়ে রোজকার মতো পেপারটা খুলে একটার পর একটা পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কি যেন খুঁজতে লাগল। চশমার মোটা কাঁচ.. আজকাল দেখতেও অসুবিধা হয়. ঝাপসা লাগে অনেক সময় লেখাগুলো। কিন্তু কি দেখে শূকলাল রোজ ! একটা কিশোরী মেয়ের মুখ খুঁজে বেড়ায়। বছর পঁচিশ আগে মিসিং ডায়েরি করেছিল থানায়। অনেক কষ্টে পয়সা জোগাড় করে বর্তমান খবরের কাগজে নিরুদ্দেশ কলমে মেয়ের ছবি ও পরিচয় দিয়ে সন্ধান দেওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছিল। সেই থেকে আজ অবধি শূকলাল বর্তমান কাগজ রোজ কিনে প্রতিটা পাতায় তার মেয়েকে খুঁজতে থাকে যদি কেউ সন্ধান দিয়ে থাকে তার মেয়ের।
গুলাবী ছিল শূকলাল ও রাধিকার একমাত্র মেয়ে। পরিষ্কার গায়ের রং ছিল বলে শূকলাল আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিল গুলাবী। মেয়ে ছিল শূকলালের প্রাণ। মেয়ে হাসলে শূকলালও আনন্দে থাকত। মেয়ে কাঁদলে শূকলালের সারাদিন মনখারাপ হতো। মেয়েও ছিল বাবা অন্ত প্রাণ। কখনো রিকশা চালিয়ে কখনো কুলি মজুরি করে মেয়ের আবদার মেটাতো শূকলাল।একটু বড় হতেই গুলাবী যখন অন্যদের স্কুলে যেতে দেখল তখন বাপের কাছে আবদার করল সেও স্কুলে যাবে। শূকলাল খুশি হয়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। নিজে সকালে চায়ের দোকানে কাজ করতো বিকেলে স্টেশনে কূলির কাজ করতো। রাধিকাও লোকের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতো। গুলাবী ছিল তাদের জীবন। চোখের সামনে গুলাবী বড় হতে থাকে । পড়াশোনায় কিন্তু খুব মাথা ছিল গুলাবীর। শূকলাল বলতো, দেখো , গুলাবীর মা , হামার বিটিয়া একদিন বহুত বড় হোবে, নোকরি করবে , হামাদের আর কোনো তকলীফ থাকবেনা।
চোদ্দো বছরের গুলাবীর যেন এই বয়সেই আগুনের মতো চোখ ঝলসানো রূপ আর সদ্য উঁকি দেওয়া যৌবন !
সেদিন ছিল গুলাবীর জন্মদিন। মায়ের হাতের জলজলে পায়েস খেয়ে গুলাবী স্কুলে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরোলো। বেরোবার আগে বলে গেল, –“মা আজকে কিন্তু পুরী আর আলুরদম খাব । আজ ভীষণ খেতে ইচ্ছে করছে। আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে খাবো কিন্তু ….”
রাধিকা লুচি ও আলুর দম বানিয়ে বসে রইলো। শূকলাল আজকে মজুরি করে যে টাকা পেয়েছে তা দিয়ে মেয়ের জন্য একটা জামা কিনে আনে ফুটপাত থেকে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায় গুলাবী আর ফেরে না। উদ্বিগ্ন শূকলাল ওর সহেলীদের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে গুলাবী আজ স্কুলেই আসেনি। চিন্তার ভাঁজ পড়ে শূকলালের কপালে। বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে ! বন্ধুর সাথে পুলিশের কাছে গিয়ে ডায়রিও করে।
সাত দিন হয়ে গেল গুলাবীকে পাওয়া যাচ্ছে না ! রাধিকা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিছানা নিয়ে নেয়। শূকলালেরও পাগল পাগল অবস্থা। বন্ধুর কথায় পয়সা জোগাড় করে সংবাদপত্রে নিরুদ্দেশ কালামে গুলাবীর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়।
রাধিকা কখনো কখনো কাঁদতে কাঁদতে বলে, গুলাবী আর বেঁচে নেই..হামার বিটিয়া আর ফিরবে না —
শূকলাল তীব্র চিৎকার করে বলে, —- “কেন অশুভ বাত করছিস গুলাবির মা। হামার বিটিয়া ওর বাপুকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ঠিক ফিরে আসবে।”
দীর্ঘ সময় চলে যায়। গুলাবীর মা গুলাবীর জন্য কেঁদে কেঁদে একদিন ইহলোক ত্যাগ করে। শূকলাল একা হয়ে যায়। এত শোকের মধ্যেও খবরের কাগজটা কিন্তু দেখতে কোনদিন ভোলেনা। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা যদি বিটিয়ার কোন খবর পাওয়া যায়। খুবই দুর্বল সান্ত্বনা ! বুদ্ধিমান মানুষ হয়তো রবি ঠাকুরকে কোট করে বলবেন “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা , ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা।”
কিন্তু শুধুমাত্র শব্দের মালা গেঁথে ছন্দ রচনা করেই বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো কি সম্ভব ? জীবন তো মানুষের সম্পর্ককে বাদ দিয়ে কোনো তর্ক হয় না !
আজ শূকলাল বয়সের ভারে ন্যুব্জ.. স্মৃতিশক্তিও সব সময় সাথ দেয় না। কিন্তু গুলাবী মন থেকে মুছে যায়নি। তাই আজও প্রতিদিনের মত কাগজের পাতা উল্টে শূকলাল খুঁজে যাচ্ছে তার গুলাবীকে। যে কটা দিন বাঁচবে হয়তো এভাবেই খুঁজে ফিরবে তার মেয়েকে শূকলাল। টপটপ করে দুফোঁটা জল পড়ল কাগজের ওপর। না না মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা নয় ..
এ হল এক হতভাগ্য বাবার ঝাপসা চোখে জমে থাকা উদ্বেল অশ্রুর ফোঁটা ! আজ শূকলাল বড়োই একা! সব কথা নীরব কান্নায় ভরা ! সঙ্গী বলতে কিছু স্মৃতি , কিছু বেদনা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।