সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ১৩)

সালিশির রায়

কিস্তি – ১৩ 

তাই এক রঙিন স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায় অঞ্জলি। ওইভাবেই সুখ স্বপ্নে কেটে যায় কয়েকটা মাস। দেখতে দেখতে এসে পড়ে বাদনা পরব।তাদের সমাজে মুলত চারটি পরব আছে। তার মধ্যেই বাদনা সব থেকে বড়ো।বাদনা মূলত শিকারের পরব।আদিবাসীদের খাদ্যাভাসে চল নেই এমন জীবজন্তু কমই আছে। আর আদিবাসীদের রক্তে পুরুষানুক্রমে রয়েছে সেইসব জীবজন্তু শিকারের নেশা। ছেলে- বুড়ো শিকারের নামে সবাই একপায়ে খাড়া। প্রতিবছর ২৫ পৌষ বড়োরা খাবার-দাবার নিয়ে শিকারে বেড়িয়ে যায়। ৫ দিন তারা এ জঙ্গল ,সে জঙ্গল করে ঘুরে বেড়ায়।জঙ্গলেই রাত কাটে তাদের। শিকার করা জীবজন্তু পুড়িয়ে খায়। ১ লা মাঘ শিকার করতে করতে বাড়ি ফেরে তারা।
গ্রামে ফিরে শিকার করে আনা জীবজন্তু ভাগ করে নেয় সবাই। গ্রামের মোড়লের বাড়িতে একটা ভাগ পাঠাতে হয়। আগে বাবাও যেত। তারপর দাদা যাওয়া শুরু করার পর বাবা আর যায় না। শিকার থেকে বাবা দাদা- না ফেরা পর্যন্ত সেই দিন গুলো তাদের চরম দুশ্চিন্তায় কাটে। এবারে বৌদি দাদাকে যেতে দেবে না বলে গোঁ ধরে বসে।সেই শুরু হয় চরম টানা পোড়েন। শেষ পর্যন্ত অঞ্জলি গিয়ে বৌদিকে ধরে — দাদা না গেলে কি করে হবে বলো তো ? পাড়ার লোক ছাড়বে ? শেষে সালিশি বসিয়ে আবার জরিমানা করবে।
বৌদি সাফ জানিয়ে দেয় – আমি অত সব জানি না। প্রয়োজনে বাবা যাক। জঙ্গলে কতরকম বিপদ আপদ আছে। আমি ওকে কিছুতেই যেতে দেব না।
—- বাঃ তুমি ভালো বললে তো। এই বয়সে বাবা জঙ্গলে যাবে শিকারে , দাদার বিপদ– আপদ আছে, বাবার নেই ?
—– বাবার তো তিনকালে গিয়ে একেকালে ঠেকেছে, ওর আবার বিপদ-আপদের ভয় কিসের। তাছাড়া বেশি চাপাচাপি করলে তোমার দাদাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব। বাবা তো বলেই রেখেছে —-।
বৌদির কথা শেষ হয় না। কিন্তু কেমন যেন পাড় ভাঙনের আভাস পায় অঞ্জলি। পাশে দাঁড়িয়ে দাদা একটি কথাও উচ্চারণ করে না। বাবা এসেই পরিস্থিতির সামাল দেয় — ছাড় তো—- এবার আমিই যাব। আমার শিকারে যেতে ভালোই লাগে। বাবু যেত বলে আমি সুযোগ পেতাম না। অনেকদিন পর আবার সেই সুযোগ পেলাম অঞ্জলি বোঝে বাবা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে।কিন্তু করারও কিছু নেই। মোড়ল ছাড়া প্রতিটি পরিবার থেকে কমপক্ষে ১ জন করে শিকার পরবে অংশ নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। তাই শেষপর্যন্ত অশক্ত শরীরে বাবাকেই যেতে হয় শিকার পরবে। আর তাদের দিন কাটে চরম দুশ্চিন্তায়। একে অশক্ত শরীর তার উপরে জঙ্গলে কতরকম বিপদ আপদ আছে, সাপ খোপ আছে, ঝড় বৃষ্টি, বজ্রপাত আছে। কতবার যে কতজন শিকারে গিয়ে আর ফেরে নি তার ঠিক নেই।
তবু শিকারের নেশা তাদের জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। ছোটরাও শিকারের নেশা্য পিছিয়ে নেই। আদিবাসী পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে দিনকতক গ্রামের প্রাইমারী স্কুল কিম্বা অঙ্গনওয়ারিকেন্দ্রে মিড-মিলের টানে যায়। তারপর যেদিন ছেলেমেয়েগুলো টুকটাক কাজ করে নিজেরাই মিড- ডে- মিলের সমপরিমান খাবারের সংস্থান করতে পারে সেদিনই স্কুল ছেড়ে দেয়। আসলে ভাষাগত সমস্যার জন্য প্রতিবছর ফেল করতে করেতে তারা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ে। তারপর একদিন পড়ার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলে।শিক্ষক–শিক্ষিকারাও ওইসব ছেলেমেয়ের সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বাবা-মা’য়েরাও সকাল থেকে কাজে বেরিয়ে যাওয়ায় অভিভাবকহীন ওইসব স্কুলছুট ছেলে-মেয়েরা সারা বছর দিনভর তীরধনুক আর গুলতি হাতে মাঠে-জঙ্গলে শিকার করে বেড়ায়।
শিকারের নেশায় প্রায়ই তাদের প্রান বিপন্ন হয়। গতবারই তো ঘটেছে সেই ঘটনা। সে দৃশ্যটা মনে পড়লে আজও যেন হাড়হিম হয়ে যায় তার। আজও সে যেন শুনতে পায় সন্তান হারা দুই মায়ের কান্না। পরব ছাড়াও আদিবাসীরা সারা বছরই শিকার করে। তার মধ্যে ছোটদের কাছে বর্ষার মরসুমে গোসাপ ধরাটা একটা প্রিয় নেশা। বছরের অন্যান্য সময় গোসাপেরা আল পগাড়ের গর্তে ঢুকে থাকে। বর্ষার মরসুমে সেইসব গর্তে জল ঢুকে যায়। বিপন্ন গোসাপেরা তখন বিকল্প আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি শুরু করে। কখনও জঙ্গলে কখনও বা সেচখাল কিম্বা কাঁদরের জলে শরীর ডুবিয়ে আত্মগোপন করে থাকে। ছেলেগুলোও তক্কে তক্কে ঘোরে। নির্ভুল নিশানায় জলে ঝাঁপ দিয়ে টুঁটি চেপে ধরে নিয়ে আসে একের পর এক গোসাপ।
কখনও বা ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা গোসাপ তাড়া করে বেড়ায়। আর প্রান বাঁচাতে ওইসব গোসাপ ছুটে গর্তে সেঁধিয়ে যায়। সেই সব গর্ত থেকে গোসাপদের টেনে বের করে আনতে গিয়েই গত বছর প্রান হারিয়েছিল দুজন। ভাইটাও সেই দলে ছিল। পরে ভাইয়ের মুখে ঘটনার কথা শুনে শিউরে উঠেছিল সে। ভাই বলেছিল , তাদের তাড়া খেয়ে একটা গোসাপ নাকি ছুটে মাটির গর্তে সেঁধিয়ে যায়। পাশাপাশি অনেকগুলো গর্ত দেখে তার কোনটাতে গোসাপটা ঢুকেছে তা ঠিক করতে না পেরে তারা একের পর এক গর্তে হাত ঢোকাতে থাকে। শেষে একটা গর্তে হাত ঢুকিয়ে কামড় খেয়ে ধরে নেয় সেখানে গোসাপটা আছে। ফের আর একজন হাত ঢুকিয়ে কামড় খায়। গোসাপের কামড় ভেবে কেউ গা করে নি। শেষে গর্তে লাঠি ঢুকিয়ে তারা ছুটে পালানোর আর পথ পায় না। লাঠির খোঁচা খেয়ে ফনা মেলে বেরিয়ে আসে বিশাল এক বিষধর সাপ। ততক্ষণে সাপের কামড় খাওয়া ছেলে দুটি নেতিয়ে পড়েছে। ছেলেদুটিকে কাঁধে নিয়ে পাড়ায় ফেরে বাকিরা।তখনও কয়েকজনের হাতে ধরা কয়েকটা গোসাপ।
গোটা পাড়া ভেঙে পড়ে ছেলে দুটিকে ঘিরে। ছেলেদুটির বাবা-মা তখন ছিল মাঠে। খবর পেয়ে ছুটে আসে তারা। ছেলেকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সুরমতী কাকী আর চামেলি জ্যেঠি। ছোটরাই নয় গোসাপ ধরতে গিয়ে সাপের কামড় খেয়ে মারা যায় বড়োরাও। সাপের কামড়কে গোসাপের ভেবে এড়িয়ে যায় সবাই। তিন বছর আগেই ওইভাবে মাঠে মরে পড়েছিল ঘোষাল কাকা। পাশেই পড়েছিল গোসাপের লেজ আর পায়ের নখে ছাঁদ লাগানো শিকার করা গোটা চারেক গোসাপ আর বেজি। দিনের শেষে খবর পেয়ে পাড়ার লোকেরা গোসাপের সঙ্গে তার শিকার করা ওইসব প্রানীগুলি নিয়ে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই সবাই সব ভুলে যায়।
জীবন সংশয় জেনেও বাবা মায়েরা ছেলেদের কিছু বলে না। বরং প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ই মেলে তাদের কাছে। ছেলের শিকার করে আনা গোসাপ ছাড়িয়ে রান্না করে দেয় মা। বাবা সেই মাংসের চাট করে মদ খায়। সবথেকে অমানবিক দৃশ্যটি আজও সে ভুলতে পারেনি। গতবছর ছেলে দুটিকে কাঁধে করে সৎকার করতে যাওয়ার সময় শ্মশানে পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য শবযাত্রীরা হাতে ঝুলিয়ে তাদের শিকার করা গোসাপগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। আর সুরমতী কাকী আর চামেলি জ্যেঠি কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়ছিল মাটিতে। দৃশ্যটা আজও ভুলতে পারে নি অঞ্জলি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।