সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৫৬)

সালিশির রায়
কিস্তি – ৬১
জ্যোৎস্না মেখে হোমে ফেরে দুজনে। সেদিন আর হোমের ভিতরে ঢোকেন না আলাপনবাবু। গেটের মুখে তাকে নামিয়ে চলে যান। তবুও ভালোলাগায় ভরপুর ওঠে অঞ্জলির মন। গুন গুনিয়ে সুর ভাজতে ভাজতে হোমে নিজের ঘরে ঢোকে সে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় তার।কোন কিছুতেই মন লাগে না। সেটা চোখ এড়ায় না সঞ্চিতার। তার দিকে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। শ্রাবণীর বিয়ের পর তার পাশের বেডে উঠে এসেছে সঞ্চিতা। সে ‘ও এবার মাধ্যমিক দেবে। হোম থেকে এবারে পাঁচ জন মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। সঞ্চিতা তাদের মধ্যে অন্যতম। শ্রাবণীর মতো সঞ্চিতাও তার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। সঞ্চিতা তার পাশের বেডে না এলে হয়তো শ্রাবণী অভাবটা সে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারত না। শ্রাবণীর মতোই এখন তারা দু’জনে অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। কোথাও আটকে গেলে অঞ্জলির সাহায্য নেয় সঞ্চিতা। তবে শুধু সঞ্চিতাই নয়, হোমের সব মেয়েকেই সাহায্য করে সে। কিন্তু আজ কিছুতেই পড়াতে মন বসাতে পারছে না। কেবলই তিলপাড়া ব্যারেজের ভালো লাগার মুহুর্তগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার।তাই তার অন্যমনস্কতা দেখে সঞ্চিতা বলে , কি গো দিদি আজ তোমার হলোটা কি ? ফিরে আসার পর থেকে দেখছি বেশ ফুরফুরে লাগছে তোমাকে। মনটা তোমার কোথাই যেন পড়ে রয়েছে। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করলে না , পড়াতেও মন নেই। কোথাই গিয়েছিলে গো আজ তোমরা ?
— সে তো এখনই বলা যাবে না রে ?
—- অন্য রকম ব্যাপার বুঝি ?
অঞ্জলি দেখে সঞ্চিতার চোখে মুখে উকি দিচ্ছে আলাপনবাবুকে ঘিরে অন্যরকম কৌতুহল। সেটা নিবৃত্ত করতে সে বলে, না রে সে রকম কিছু নয়। একটা বিশেষ কাজে গিয়েছিলাম। এখনই সেটা বলা যাবে না। ভাইফোঁটার দিন তোরা সবাই জানতে পারবি। এবার হোমে ভালো করে ভাইফোঁটা হবে। ধরতে পারিস আমরা তারই ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলাম।
ভাইফোঁটার কথা শুনেই বিষন্ন দেখায় সঞ্চিতার মুখটা। অজান্তে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে। তা দেখে অঞ্জলি জিজ্ঞেস করে – কি রে , ভাইফোঁটার কথা শুনে তোর মুখটা এমন কালো হয়ে গেল কেন ?
—- কি বলব দিদি , আমার তো সব থেকেও নেই। সেই কবে হোমে এসেছি , পাছে ঘাড়ে গিয়ে চাপি বলে কেউ দেখা করতেও আসে না।
—- নাই বা এলো নিজের মায়ের পেটের ভাইরা , তাই বলে কি আমাদের ভাইফোঁটা হবে না ? আমার দাদাও তো আসবে না , ভাই আসতে পারে , সাবিত্রীদির পাতানো ভাই তো আসবেই। যারা আসবে আমরা তাদেরই ফোঁটা দেব। তাছাড়া সাংবাদিক — প্রশাসনের লোকেরা তো থাকবেনই।
পুলিশ প্রশাসনের লোকেদের কথা প্রসঙ্গে একটা দুঃচিন্তা শুরু হয় অঞ্জলির। পুলিশ প্রশাসনের লোকেদের মধ্যে আলাপনবাবুও তো থাকবেন। হোমের সব মেয়েরা অন্যান্যদের সঙ্গে তাকেও ভাইফোঁটা দেবে। সে তখন কি করবে ভেবে কিছু কুল কিনারা পায় না অঞ্জলি। আলাপনবাবুকে ভাইফোঁটা দিতে যেমন তার হাত উঠবে না , তেমনি এড়িয়েও যেতে পারবে না। তাহলে সবার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়তে হবে তাকে। মুখে হয়তো কেউ কিছু বলবে না , কিন্তু সবাই অন্য চোখে দেখত শুরু করবে তাকে। সে বড়ো লজ্জার ব্যাপার হবে। কি করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে সে ? আলাপনবাবুকে বলবে কি ? এ ব্যাপারে আলাপনবাবুকে বলে বিশেষ লাভ হবে বলেও মনে হয় না তার। কারণ উনি খুব সরল মনের মানুষ। সংসারেরই এইসব সুক্ষ মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণা নেই। নাহলে সেদিন তিলপাড়ায় অমন আবদার করতেন না। ফেরার মুখে তার হাত ধরে অলাপনবাবু সেদিন বলেছিলেন – তুমি কি আমার আর একটুখানি কাছে আসতে পারো না ?
কথাটার মানে বুঝতে না পেরে আলাপনবাবুর দিকে অবাক চোখে চেয়েছিল সে।তা দেখে আলাপনবাবু হেসে বলেছিলেন – আরে না-না , তুমি যা ভাবছ তা নয়। আগে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াও তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে।
—- তাহলে ?
— আমাকে কি তুমি–তুমি করে কথা বলতে পারো না ?
আলাপনবাবুর কথা শুনে সেও হেসেছিল। নাঃ মানুষটা সত্যিই সরল। যা মনে আসে বলে দেন। পারিপার্শ্বিকতার কথা ভাবেন না। হাসতে হাসতেই সে বলেছিল — আপনি বড়ো অফিসার হলে কি হবে, আসলে আপনি একটি ছেলেমানুষ।
—- কেন ?
— তা নয় , আমার চেয়ে এমন কি আপনার চেয়েও বয়সে বড়ো হোমের মেয়েরা আপনাকে আপনি আপনি করে কথা বলে, আর আমি আপনাকে হঠাৎ তুমি তুমি করে কথা বললে সবার কানে অন্যরকম শোনাবে না ? তাছাড়া মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে হোম থেকে আসার সময় যাকে আপনি আজ্ঞে করে কথা বলেছি, ফেরার পর তাকেই তুমি বলি তাহলে সবার কৌতুহল হবে না ?
— তাই তো, আমি তো এদিকটা একবারও ভেবে দেখি নি।
—- তাছাড়া আপনার আমার সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলে আমি সহজ ভাবে কোন কাজ করতেও পারব না।
তার ওই কথা শোনার পর আর কিছু বলতে পারেন না আলাপনবাবু।
তাই এক্ষেত্রেও আলাপনবাবুর উপর ভরসা না করে যা করার তা নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু সে উপায় ভাবতে ভাবতেই এসে পড়ে ভাইফোঁটা। শ্রাবণীর বিয়ের মতোই হোমের সব আবাসিকদের বাড়ি , পুলিশ, প্রশাসন এবং সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শ্রাবণী আর সন্দীপকেও। আগের দিন ফল মিষ্টি সহ অন্যান্য বাজার করে দিয়ে গিয়েছেন আলাপনবাবু। হোমের সব মেয়েদের মধ্যেই চাপা আবেগ আর উচ্ছাস। কেবল যে ভাইফোঁটা নিয়ে তার এত উৎসাহ ছিল সেই ভাইফোঁটাই এখন তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তো হোমের মেয়েরাই নয় , কাল তো ভাইকে নিয়ে দিদিও আসবে। দিদির যা বুদ্ধি, ঠিক ধরে ফেলবে। অঞ্জলি মনে মনে চায় কাল একবেলার জন্য আলাপনবাবুর সামান্য জ্বরজ্বালা হোক। যাতে কাল তিনি আর হোমে আসতে না পারেন। তাহলে আর তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পড়তে হবে না।
কিন্তু তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে সকালেই হোমে পৌঁচ্ছে যান আলাপনবাবু। এসেই শুরু করে দেন তোড়জোড়। কিছুক্ষণের মধ্যে একে একে এসে পৌঁছোন জেলাশাসক, পুলিশসুপার , সাংবাদিকের দল। ভাইকে নিয়ে আসে দিদি।
বহুদিন পর ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরে অঞ্জলি। সন্দীপ –শ্রাবণীরাও এসে পৌঁছোয়। সবার শেষে পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে আসেন সাবিত্রীদির দুই দাদাও। কিছুটা আশ্চর্য হলেও সাবিত্রীদি যে মনে মনে খুব খুশী হয়েছেন তা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারে অঞ্জলি। মুখে অবশ্য সাবিত্রীদি এবং দাদারা কিছু বলেন না। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সার্থক হওয়ায় খুশী হয় অঞ্জলি। সবাই ভাইফোঁটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। প্রস্তুত হতে হয় অঞ্জলিকেও। ভাগ্যের হাতেই বিষয়টিকে ছেড়ে দেয় সে। ফোঁটা দেওয়া শুরু হতেই বুক দুরু দুরু করতে শুরু করে তার। শেষপর্যন্ত অবশ্য আলাপনবাবুই তাকে অস্বস্তির হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেন। অঞ্জলি ভাবতেও পারে না , আলাপনবাবু এমন একটা উপায় ভাবতে পারেন। সবাই লাইন দিয়ে বসলেও আলাপনবাবুকে সেখানে দেখতে না পেয়ে ডি,এম,সাহেব হাঁক পাড়েন — কই , আলাপন তুমিও এসো।
— স্যার, আমার তো এবার ভাইফোঁটা হবে না। আমার আত্মীয় বিয়োগের জন্য কালাশৌচ চলছে।
—- ও, তাই ? খুব খারাপ লাগছে। তুমিই অগ্রণী ভূমিকা নিলে, অথচ অংশ নিতে পারলে না।
—- না স্যার, অগ্রণী ভূমিকা আসলে অঞ্জলিই নিয়েছে।তবে এবারের ভাইফোঁটাটা একটা উপলক্ষ্য মাত্র। শ্রাবণীর বিয়ের মতোই হয়তো আজও হোমে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আমাদের সকলকে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আলাপনবাবুর কথা শেষ হতেই সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করেন। সবার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে একটা চাপা গুঞ্জন আর কৌতুহল। আর অঞ্জলি হাফ ছেড়ে বাঁচে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির হাত থেকে এইভাবে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য আলাপনবাবুকে সে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু আত্মীয় বিয়োগের কথাটা যে সত্যি নয় তা তো সে জানে ।কারণ আলাপনবাবু তো অনাথ ,আত্মীয় থাকলেও ওনার তো তাদের চেনার কথা নয় । তাই আত্মীয় বিয়োগের সত্যতা নিয়ে তার যথেষ্ট সংশয় আছে। অঞ্জলির মনে হয় আলাপনবাবুও তার হাতে ভাইফোঁটা নেওয়া এড়াতেই আত্মীয় বিয়োগের অজুহাতটা খাড়া করেছেন।
পরে বিষয়টি নিয়ে আলাপনবাবুকে চেপে ধরবে অঞ্জলি। তবে আলাপনবাবুর এই অজুহাতটার জন্যই সে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পায়। দ্বিগুন উৎসাহে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। একে একে সবাই ফোঁটা দেয়। শ্রাবণীর ফোঁটা দেওয়ার সময় হাসির ঘটনা ঘটে। নিজের কোন দিদি কিম্বা বোন না থাকায় শ্রাবণীর সঙ্গে ওর বরও এসেছিল ফোঁটা নিতে। তারা সবাই যেমন সবাইকে ফোঁটা দিচ্ছিল তখন শ্রাবণীও একটানে ওর বরের কপালে ফোঁটা দিতে যাচ্ছিনআর তখন সবাই হই-হই করে ওঠে — আরে করো কি, করো কি————- , শেষ পর্যন্ত বরের কপালে ভাইফোঁটা দেবে নাকি ? তখন সম্বিৎ ফেরে শ্রাবণীর, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার মুখ। অন্যান্যদের সঙ্গে হেসে ওঠে শ্রাবণী, সন্দীপও। সবথেকে আবেগঘন হয়ে ওঠে সাবিত্রীদির ফোঁটা দেওয়ার মুহুর্তটা। পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসেছিলেন তার দুই দাদাও। ফোঁটা দেওয়ার পর সাবিত্রী পায়ে হাত দিয়ে প্রণানকরতেই নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেন না দুই দাদা।
ক্রমশ…