T3 || সৌরভ সন্ধ্যায় || লিখেছেন অয়ন ঘোষ

তারাদের দেশে যাওয়ার এতো তাড়া ছিল!!!

সৌরভ, তোমাকে নিয়ে স্মরণিকা হবে, স্মৃতি কথা লেখা হবে এতো তাড়াতাড়ি আর তাতে আমাকেও যোগ দিতে হবে, আমার মনের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। এই বিরুদ্ধ সময়ের ১৭ই এপ্রিলের এক কাকডাকা দুপুরে তোমারই পোস্ট থেকে জানতে পারি তুমি নিয়ে গিয়ে ভর্তি হয়েছ বাঙ্গুর হাসপাতালে, কভিড পজিটিভ। ১৯ শে এপ্রিলের একটা দীর্ঘ পোস্টে তুমি ভালোবাসা ও বেদনা একসাথে উজাড় করে দিয়েছিলে। সেদিনও কিন্তু একটুও সংশয় ছিল না মনে, তোমার সুস্থতা নিয়ে। ৫ই মে এর বিকেল। আকাশ বাজছে বেসুরে, ঝরছে ভাসান জল। তুমি চলে গেলে সব মায়া কাটিয়ে। আজ ৬ই এপ্রিল লিখছি তোমার স্মৃতি কথা। এই যন্ত্রণা দেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল, বন্ধু?
গ্রামে থাকা লোক আমি। একটু আধটু লিখি টিখি। কলকাতার নিয়ন আলোয় খুব ধাঁধা লাগে। খুবই বেশি যাইও না। লেখার পরিচিত বৃত্তে ব্যক্তিগত আলাপ আছে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ভালোবেসে কেউ কেউ আলাপ করে, ডাকে তাদের সাথেই কথা চলে, কথা জমে। সামাজিক মাধ্যমে আলাপ ছিল বেশ ক’বছর, ‘এপার ওপাড়’ নামে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর থেকে। কিন্তু সেটা দেখাশোনা ছিল চেনা-জানা ছিল না। আকাশলীনা চলে গেলো একবুক অভিমান নিয়ে। তোমারই উদ্যোগে ওর স্মরণ সভা। আলাদা করে ডাক পাঠিয়েছিলে। কি করে জেনেছিলে জানি না, ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের কথা কারণ সেটা একান্তই ব্যক্তিগত স্তরে ছিল। এমনি করেই বোধহয় সকলের খোঁজ রাখতে! গত বছর লকডাউনের সময় তোমার কবিতা পাঠের আসরের নিয়মিত দর্শক ছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক কবির সাথে আমার পরিচয় তোমারই পাঠের মধ্যে দিয়ে। এক আকাশ আবেগ নিয়ে খুঁজে আনতে সেইসব মনি-মুক্তো। পাঠের আবেগ ও নাটকীয়তায় মুগ্ধ হতাম আমরা। আমিও আসতাম সপ্তাহে একদিন কবিতা নিয়ে। সেই আসরে তোমার কবিতা পড়ব বলে বার্তা পাঠাই। কবিতার সাথে এলো তোমার ফোন নং, আমারটাও দিলাম। যেদিন পড়েছিলাম তোমার কবিতা সেদিন কাজে ছিলে, শোনো নি। পরে শুনে ফোন করলে, সেই প্রথম কথা হলো আর তাও অনেকক্ষণ। চিরকালই কথা কম বলি, তোমার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনেক অনেক পরিকল্পনার কথা বললে কবিতা নিয়ে। ঘোর লেগে গেল, এতো আপন করে কেউ ভালোবাসতে পারে কবিতার ঘর বসতকে! সেদিনই আদায় করে নিয়েছিলে শ্রদ্ধা।
তারপর আলাপ গভীর হয়েছে। রাত বিরেতে তোমার ফোনগুলো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটা ঢেউ উঠল, সেই লকডাউনের মধ্যেই। কবিতার সংসারে তখন সামাল সামাল রব। ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গাগুলো ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে ঝুরঝুর করে। তখন এগিয়ে এলে, হাল ধরলে সাথে নিয়ে সম মনের কিছু অক্ষর শিল্পীকে। তৈরি হলো একটা দাঁড়ানোর জায়গা। যা পছন্দ হয়নি তার প্রতিবাদ করেছে মন থেকে, কোনো সমীকরণ না দেখে। সব জায়গায় চেষ্টা করেছ নতুনদের জায়গা দেবার। এখানে আপোষহীন ছিলে। যারা প্রতিবাদ করে, আপোষ করে না, যাদের শিকলে বাঁধা যায় না তারা যে সবার কাছে প্রিয় হবে না, এটাই স্বাভাবিক। প্রিয় হতে চাওনি তুমি, চেয়েছিলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে, কবিতার পাশে দাঁড়াতে। তোমাকে আমার থেকে বেশি চেনে এমন লোকের অভাব নেই। মাত্র এক বছরের আত্মিক আলাপ, তাতেই তোমাকে খুব চেনা লাগত। তোমাকে হিংসা করেছি জানো, কারণ আমি চাইলেও তোমার মতো হতে পারব না। নিজের কবিতাটুকু পড়ে চলে আসা লোক আমি, পারব কি করে তোমার মতো করে সবার কথা ভাবতে। তোমারই আগ্রহে তৈরি হলো “বাংলার লেখক শিল্পী মঞ্চ”। হৈ হৈ করে উতরে গেলো পাঁচ দিন ব্যাপী তার অক্ষর যজ্ঞ। কি করে সব হলো, কেমন করে করলে এতো কিছু, বারে বারে বিস্মিত হয়েছি! নিজের যোগদান বলতে একটু কবিতা পড়া ও অল্প সঙ্গতি নিয়ে পাশে দাঁড়ানো। সাথে আরো অনেকে ছিল কিন্তু জানি একটা অর্কেস্ট্রার ভালো ব্যান্ড মাস্টার যেমন গোটা আয়োজনটিকে এক সূত্রে গেঁথে রাখে, তুমিও ছিলে এই গোটা আয়োজনের সূত্রধর। এরপর এর কি ভবিষৎ তা জানি না, নিজেও। দেখেছি একের পর বর্ষীয়ান কবির পাশে দাঁড়িয়েছো। যখন কেউ নেই তাদের পাশে, তখন যে হাত দুটো শক্ত করে তাদের ধরে রেখেছিল তা তোমার হাত। এবার তো আমাদের থেকেও তারা অসহায় বোধ করবে। নন্দন গেলেই অনেক গাছ দেখা যায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছায়ালীন গাছটা ছিলে তুমি, তোমাকে হিংসা না করে থাকা যায়।
বলে জীবন দীর্ঘ না, বড় হওয়া প্রয়োজন – আজ মনে হচ্ছে কথাটা তোমার জন্যই সার্থক। আজ ফেসবুকের দেওয়াল উপচে পড়ছে কান্নায়, হতাশায়, বেদনায়। সার্চ করলেই এখনও তোমাকে দেখাচ্ছে, বন্ধু। তোমার দেওয়ালে তোমাকে ট্যাগ করে কতো বার্তা, আকুতি শুনতে পাচ্ছো না, দেখছ না। এতো কঠিন কি করে হতে পারছো? তুমি তো কঠিন বা ক্যালকুলেশন করে চলা মানুষ নও। বরং আবেগ তোমার বড্ড বেশি, তার চেয়ে বেশি প্রাণ শক্তি। ছেলে মানুষিও বেশ বেশি ছিল, মিশে যা বুঝেছি। “বাবা” কবিতায় লিখেছিলে, “এই গাছ আর আমার বাবা ছাড়া/ কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করবে না”- তিন সত্যি করে বলছি আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি। অপেক্ষা করে আছে সেই হলুদ ট্যাক্সি, তোমাকে রাতের কলকাতা ঘোরাবে বলে। আর আমরা অপেক্ষায় সেই দরাজ গলায় শুনব – “আহা ট্যাক্সি, ওহ ট্যাক্সি”। এতো তাড়া ছিল তারাদের দেশে যাওয়ার!! আটকাতে তো পারলাম না। সেই সাধ্যও নেই মানুষের। বাকি আলোটুকু না হয় দিও তারাদের দেশ থেকেই!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।