সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৪২)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৪২

ছিঃ, আপনার সঙ্গে বসে থাকতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে। আমায় নামিয়ে দেন। তার কথা শেষ হতে না হতেই অঞ্জলি দেখে গাড়ি পাড়ায় ঢুকছে। সে সুহাসবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাইভারকে তাদের বাড়ির কাছে গাড়ি থামাতে বলে দ্রুত নেমে পড়ে। সুহাসবাবু কি যেন একটা বলার চেষ্টা করেন , সে কানেই তোলে না। তাদের বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক। সাংবাদিকরা তো রয়েইছেন, রয়েছেন মহিলা সংগঠন, বুদ্ধিজীবি মহলের সদস্যরাও।সবাই সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনতে চান। জনে জনে একই কথা বলতে বলতে কথা বলার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলে সে। কিন্তু কথা তাকে বলতেই হয়। কেউ কেউ আবার কোথায় কোথায় ক্ষতচিহ্ন আছে জানতে চায়। ছবি তোলার জন্য ক্ষতস্থান দেখানোর আবদারও করে কয়েকজন। পারলে যৌনাঙ্গের ছবিও। যেন ইজ্জত নয়, বাক্স – প্যাটরা ভেঙে বাসনপত্র লুঠ হয়েছে। মহিলা সংগঠন আর বুদ্ধিজীবি মহলও তাকে নিয়ে মিছিল করতে চায়। সে হাত জোড় করে বলে , দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর পারছি না। যা করার আপনারা করুন।
অঞ্জলি লক্ষ্য করে তার ওই কথা শোনার পর অনেকের মুখচোখের ভাব পাল্টে যায়। মিছিল করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ বলেন, ঠিক আছে তোমার জন্যই আন্দোলন, সেই তুমিই যখন চাইছ না তখন না হয় থাক।
—- প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেন।
আমি চাইছি না, এমন কথা তো বলিনি। আসলে আমি আর পেরে উঠছি না। আমিও তো মানুষ। ভাবুন তো দু’পাশের মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু আমাকেই দেখবে। সেই দৃষ্টিতে শুধু সহমর্মিতাই নয় , থাকবে আরও অনেক কিছু। ওইসব মিছিলে আমার মনে হয়েছে আমি যেন শত–সহস্র চোখের সামনে বার বার উলঙ্গ হচ্ছি। তাই আমাকে রেহাই দিয়ে আপনারা নিজেদের মতো আন্দোলন করুন না। আপনাদের মধ্যে তো অনেকেই মহিলা রয়েছেন। আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভাবুন তো বিষয়টি কত মর্মান্তিক। ওই কথা শোনার পর আর কেউ কিছু উচ্চবাচ্য করেন না। সাংবাদিকদের ডেকে ক্যামেরার সামনে গরম গরম বক্তিতা দিয়ে একে একে পাড়া ছাড়েন তারা। সেই সময় সুহাষবাবুকে পেয়ে ছেঁকে ধরে সাংবাদিকেরা। সবাই সুহাসবাবুকে প্রশ্ন করে — অভিযুক্তরা তো সবাই আপনাদের দলের লোক। এজন্য আপনারা পুলিশকে দিয়ে অভিযোগ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। কি বলবেন আপনি ?
— কে বলল আপনাদের এসব কথা। অভিযোগকারিনী বিরোধী দলের। তাই সেই দলের নেতাদের কথায় আমাদের দলের লোকেদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়েছে। পুলিশ আসল অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার জন্যই প্রথমে সেই কারণে অভিযোগ নিতে চায় নি। পার্টি কোন হস্তক্ষেপ করেনি। আমরাও সেই জন্যই আসল অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছি।
— তার মানে আপনারা কি মনে করেন পুলিশ যাদের ধরেছে তারা নিরপরাধ।
— নিশ্চয়। আবার বলছি, রাজনৈতিক ভাবে এটে উঠতে না পেরে বিরোধীরা মেয়েটিকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছে। মামলাতেই তার প্রমাণ হয়ে যাবে। দেখবেন ওরা বেকসুর খালাস পাবে।
— এতটা নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন। এখন তো বিচার প্রক্রিয়া শুরুই হয় নি। আপনার এই বক্তব্য তো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
— এই তো আপনাদের দোষ। সব কিছুরই উল্টো ব্যাখ্যা করেন। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। সেই আস্থার জোরেই বলছি আদালতের ন্যায় বিচারে যাদের অভিযুক্ত হিসাবে ধরা হয়েছে তারা একদিন পুরোপুরি খালাস পাবে।
আর শুনতে পারে না অঞ্জলি। রাজনৈতিক নেতারা যে কি জিনিস তা ভালোই জানা হয়ে গেল তার। মনে হয় সাংবাদিকদের সামনে একবার গাড়িতে আসতে আসতে সুহাসবাবুর বলা কথাগুলো প্রকাশ করে দেয়। তারপর দেখে সুহাসবাবুর মুখের ভাবটা কেমন হয়। কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে। তাদের তো পাড়াতেই থাকতে হবে। এমনিতেই পাড়ার লোকেরা তাদের বিষনজরে দেখত ,তার উপরে পরিবারের লোকেরা গ্রেফতারের পর থেকে পুরোপুরি চক্ষুশুল হয়ে পড়েছে। ওইসব লোকেদের তাতিয়ে তাদের পাড়ায় বাসটাই তুলে দেবে। মাথার উপর কেউ নেই। এই পরিস্থিতিতে পাড়া ছেড়ে যাবেই বা কোথাই ?
তাছাড়া ওই কথাটা বলার কথা তো সুহাসবাবু স্বীকারই করবেন না। বলে দেবেন বিরোধীদের শেখানো কথা বলছে সে। তাই কথাটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় অঞ্জলি। ক্যামেরার সামনে আরও কিছু লম্বা–চওড়া কথা বলে অনুগামীদের নিয়ে সনাতনের বাড়ির দিকে চলে যান সুহাসবাবু। তারা চলে যাওয়ার পর এলেন আদিবাসী কল্যাণ সংগঠনের নেতারা। তারা তাকে সহমর্মিতা জানানোর পরিবর্তে এক রাশ জ্ঞান দিতে শুরু করেন। তাদের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় অঞ্জলি। সে ভেবেছিল রাজনৈতিক কিম্বা অন্য সংগঠনের নেতা নেত্রীরা আদিবাসী সমাজের সালিশি সভার নির্মমতার দিকটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে না পারলেও তাদের সমাজের ওইসব নেতারা নিশ্চয় তার যন্ত্রণাটা অনুভব করবেন। আন্তরিক ভাবেই তার পাশে দাঁড়াবেন। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ব্যাপারে সংগঠনের নেতারা তাকে সমর্থন জানাবেন। কিন্তু কোথায় কি ? কোন সমর্থন তো মেলেই না, উল্টে তাকেই দোষারোপ করেন তারা।
সংগঠনের নেতা বুধিরাম কিস্কু তাকে পাশে ডেকে বলেন , তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা চরম নিন্দনীয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তোমার এতটা বাড়াবাড়ি করাটাও ঠিক হয় নি।
—- মানে ? কি বলছেন আপনি ? আমি বাড়াবাড়িটা কি করলাম ?
— এই যে থানা–পুলিশ, মিডিয়ায় এতটা হইচই হলো , এতে তো আমাদের সমাজেরই মুখ পুড়ল।
— আমি কিন্তু হইচই কিছু করতে চায় নি। পুলিশের কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিলাম মাত্র।
—সেটাই তো বলছি , পুলিশের কাছে না গিয়ে আমাদের সমাজের মধ্যেই বিষয়টার নিস্পত্তি করে নিলেই ভালো হত।
— কোন সমাজের কথা বলছেন ? মোড়লের রায়কে যে সমাজের পাঁচগাও পর্যন্ত সমর্থন করে সেই সমাজের কার কাছে আমি যেতাম বলুন তো ?
— কেন , তুমি আমাদের জানালেই আমরা ব্যবস্থা নিতাম।
— কি ব্যবস্থা নিতেন ? আমার বাবা–মাকে এই পাড়াতেই বেঁধে রেখে নির্মমভাবে জরিমানা আদায় করা হয়েছিল। প্রতিটি আদিবাসী পাড়াতেই সালিশি সভার নামে একই ঘটনা ঘটে আপনারা জানেন না? কই কোথাই কি ব্যবস্থা নিয়েছেন বলুন তো ?
তার কথার তোড়ে আদিবাসী সংগঠনের নেতারা কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। সে নিজেও নিজের কথায় কিছুটা বিষ্মিত হয়। সেই রাতের ঘটনার পর থেকেই সে লক্ষ করেছে তার গলায় যেন অন্য কেউ কথা বলে। এমনি বাড়ি এবং স্কুলে বলিয়ে কইয়ে হিসাবে তার কিছুটা সুখ্যাতি ছিলই , সেটা যেন আচমকা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। এখন আর নেতা–পুলিশ কারো সঙ্গে কথা বলতে কোন আড়ষ্টতা নেই। বরং তার কথা শুনে বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই বিপক্ষের বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়।
বুধিরামের ও কিছুটা সময় লাগে ঘোর কাটতে। তারপর কর্কশ ভাবে — তোমার তো খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। ভেবেছিলাম আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কিছু একটা কর্মসূচি নেব। কিন্তু এখন দেখছি তার আর দরকার হবে না।
অঞ্জলিও হাত জোড় করে বলে — ঠিক ধরেছেন , এতদিন যখন অন্যান্য লড়াই গুলো কারও সাহার্য্য ছাড়া নিজেই লড়েছি , তখন আমার লড়াইটা আমাকেই লড়তে দিন। তাতে হারি জিতি যাই হোক না কেন , নিজের লড়াই করার ক্ষমতাটা একবার অনন্ত যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ দিন। কথাটা শুনে নেতাদের মুখগুলো ব্যেজার হয়ে যায়। পরক্ষণে সেই ভাব গোপন করে অন্যান্যদের মতো তারাও সংবাদ মাধ্যমে লম্বাচওড়া বিবৃতি দেন। নেতা বুধিরাম বলেন — এই ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা করছি। ধর্ষিতার পরিবারের পাশে আমরা শেষ পর্যন্ত আছি।
নেতাদের যত দেখছে তত অবাক হয়ে যাচ্ছে অঞ্জলি। এরা বলে এক, আর করে আর এক। এদের অধিকাংশের সহমর্মিতার কোন বালাই নেই , কেমন যেন অস্তিত্ব জাহিরের প্রতিযোগিতা। তাই তীব্র এক হতাশা বোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। তারই মধ্যে তাকে উজ্জীবিত করে তোলে এক অন্যরকম আশার আলো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।