গল্পেসল্পে অনুঋতা ঘোষ

নকলের পিছনে খাঁটি সোনা

রাগিনী ও নন্দিনী দুই বোন,নন্দিনী রাগিনীর থেকে দেড় বছরের ছোট।
নন্দিনী যখন মাধ্যমিক দেয় রাগিনী তখন টুয়েলভে পড়ে হঠাৎ করেই নন্দিনীর মধ্যে একটা change চলে আসে রাগিণীর যা কিনবে হুবহু একই জিনিস নন্দিনীর লাগবে রাগিনী কোন ড্রেস কিনলে নন্দিনী সেটাই চাই same design,same colour ই চাই।
এটা নিয়ে মাঝে মাঝে রাগিনী খুব বিরক্ত হতো মাকে গিয়ে বলত, মা বলতো -“ভয় পাস না বয়সটা কম তো তাই ওরকম করে আস্তে আস্তে বড় হবে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে”।
কিন্তু নন্দিনী যত বড় হচ্ছিল তত এই জিনিসটা বাড়ছিল।
রাগিনী তো একদিন মাকে বলেই ফেলল-” ওর আমার সব জিনিসই চাই এরপর কি বিয়ের পর আমার বরটাকে ও ওর চাই”।
দূরে দাঁড়িয়ে সেদিন নন্দিনী কথাটা শুনে ছিল।
******
এরপর রাগিণীর বিয়ে ঠিক হয় বিয়ে হয়েও যায়, বেশ সচ্ছল পরিবার এই বিয়ে হয় তার ।
স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই বেশ ভাল,তারা খুব ভালোবাসে রাগিনী কে, বিয়ের পর দুই বোনের সেরকম কথাবার্তা হত না কিন্তু জয়ন্ত(রাগিণীর বর) এর সাথে নন্দিনীর প্রায়ই ফোনে কথা হতো রাগিনী তার বোনের স্বভাব জানতো সেই জন্য সে সাবধান ও করে দিয়েছিল জয়ন্ত কে তাই জয়ন্ত নন্দিনীর সাথে সেভাবেই মিশতো যেভাবে একজন দাদা তার বোনের সাথে মেশে।
এরপর হঠাৎ একদিন জয়ন্তর ফোনে নন্দিনীর ফোন আসে জয়ন্ত সামনে ছিল না তাই রাগিনী ফোন ধরে,ও কিছু বলার আগেই নন্দিনী বলে ওঠে-” জয়ন্তদা তুমি আমাকে এখনো এমাসে টাকা পাঠাওনি কেন?”
রাগিনী অবাক হয়ে যায় ভাবে নন্দিনী জয়ন্তর কাছে কিসের জন্য টাকা নেয়!
রাগিনী বলে -“কিসের টাকা”?
নন্দিনী বলে -“দিদি !”
বলে ও ফোনটা কেটে দেয়।
এরপর জয়ন্ত এলে রাগিনী জয়ন্তকে বলে -“নন্দিনী তোমার থেকে প্রতিমাসে কেন টাকা নেয়?”
জয়ন্ত বুঝতে পারে যে রাগিনী সব জেনে গেছে তাই তার কাছে কিছু লুকোনো বৃথা।
তখন জয়ন্ত বলে -“একদিন নন্দিনী আমাকে ফোন করে বলে ও একটা সমস্যায় আছে ওর কিছু টাকা লাগবে প্রতি মাসে, আমি ওকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করি ,কী হয়েছে ?বাড়িতে কোনো সমস্যা কিনা,বাবা মা জানে কিনা? কিন্তু ও আমায় কিছু বলে না শুধু কাঁদতে থাকে আর বলে দিদিকে কিছু জানিও না তাই আমি তোমাকে বলিনি”।
রাগিনী বলে -“কত টাকা চায় ?”
জয়ন্ত বলে -“5000 টাকা”
রাগিনী ভাবে এত টাকা ওর কেন দরকার?
রাগিনী জয়ন্ত কে বলে -“তুমি নন্দিনি কে ফোন করে বলো যে তুমি এ মাসের টাকাটা ওকে সামনাসামনি দেবে”। জয়ন্ত সেইমতো নন্দিনীকে ফোন করে টাকা নেওয়ার জন্য দেখা করতে বলে, নন্দিনী প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে যায়।
সেদিন টাকা দিতে জয়ন্তর সাথে রাগিনী ও গেছিল কিন্তু রাগিনী নন্দিনী সামনে যায়নি ,নন্দিনী টাকা নিয়ে চলে গেলে জয়ন্ত আর রাগিনী ওকে ফলো করে, ওরা দেখে নন্দিনী একটা গলির ভেতর একটা টিনের চাল দেওয়া বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো টাকা নিয়ে।
রাগিনী মনে মনে ভাবতে থাকে এই বাড়িতে কে আছে যাকে নন্দিনী টাকা দিয়ে সাহায্য করছে নাকি ও কোনো খারাপ সঙ্গে পড়েছে।
*******
এই ঘটনার দু’দিন পর রাগিনী ওর বাপের বাড়ি যাচ্ছিল নন্দিনীকে সোজাসুজি সব জিজ্ঞাসা করবে বলে রাস্তায় রাগিণীর স্কুল লাইফের বন্ধু অর্ক র সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের মধ্যে টুকটাক কথা হতে হতে রাগিনী প্রশান্তর কথা জানতে পারে( প্রশান্ত রাগিনী কে স্কুল লাইফ থেকে পছন্দ করত ওর Schizophrenia নামক এক বিরল রোগ ছিল ও কানে কখনো কম শুনতো কখনো খুব বেশি আওয়াজ শুনতে পেত যা সবাই শুনতে পেত না আবার চোখেও কম দেখতো এইরোগ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে এক কথায় যাকে বলে হ্যালুসিনেশন)যে প্রশান্ত কিছুদিন আগে মারা গেছে এটা শুনে রাগিণীর খুব কষ্ট হয় কারণ রাগিনী জানত যে ওকে প্রশান্ত পছন্দ করে কিন্তু ও প্রশান্ত কে পাত্তা দিত না,এমনকি প্রশান্তর যে এত বড় রোগ আছে সেটাও রাগিনী জানত না।
এরপর দু এক কথায় অর্ক কে বিদায় জানিয়ে রাগিনী বাপের বাড়ি যায় সেখানে গিয়ে দেখে নন্দিনী বাড়িতে নেই বোনের সাথে কথা না বলে ও বাবা মাকে কিছু জানাতে চায় না,এসব শুনলে বাবা-মা চিন্তা করবে এই ভেবে।
পরেরদিন রাগিণীর কাছে একটা ফোন আসে নন্দিনীর বান্ধবী সৌমির।
সৌমি রাগিনী কে বলে-” রাগিনি দি তুমি নন্দিনীকে বোঝাও যা করছে তাতে ওর কোনো ভবিষ্যত নেই,জীবনটা তো কারো জন্য থেমে থাকে না ও সারাজীবন একা থাকবে কি করে?”
রাগিনী বলে -“নন্দিনী কি করছে? আমিতো এ ব্যাপারে কিছু জানিনা ”
সৌমি বলে -“আমি তো জানতাম ও কাকু কাকিমাকে কিছু বলেনি জয়ন্ত দার কাছ থেকে টাকা নিতে দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো কিছু জানো এখন তো দেখছি তোমাদের ও কিছু বলেনি”।
রাগিনী বলে -“সৌমি আমি তোর সাথে দেখা করতে চাই তুই আমাকে প্লিজ সব টা খুলে বল”।
এরপর সৌমি কে নিয়ে রাগিনী ওর বাপের বাড়ি যায় সেখানে গিয়ে মা-বাবাকে নন্দিনীর সব কথা জানায়।
তখন রাগিণীর বাবা-মা সৌমি কে সবটা বলতে বলে,সৌমি বলে -“নন্দিনী প্রশান্ত নামে একটা ছেলেকে ভালোবাসে, নন্দিনী মাধ্যমিক দেওয়ার পর জানতে পারে যে প্রশান্ত রাগিনী দি কে পছন্দ করে কিন্তু প্রশান্তর একটা রোগ আছে যার কারণে ও স্পষ্ট দেখতে পায়না,প্রশান্ত জানতো যে সে আর খুব বড়জোর দেড়-দু’বছর বাঁচবে তাই জন্য সবসময় প্রশান্ত জীবনের শেষ কটা দিন রাগিণী দি র সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিল। নন্দিনী প্রশান্তর একটা বন্ধুর কাছ থেকে এসব কথা শোনে, নন্দিনী মনে মনে ঠিক করে যে প্রশান্ত যা চাইছে তাই দেবে। যেহেতু প্রশান্ত চোখে খুব একটা ভালো দেখতো না এবং যতদিন যাচ্ছিল ওর চোখের দৃষ্টি আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
প্রশান্ত রাগিনী দি র সাজ পোশাক খুব পছন্দ করত ও সেগুলো কে অনুভব করতো,তাই নন্দিনী রাগিনী দির জামা কাপড় কিনতো যাতে সেটা পড়ে ও প্রশান্ত সামনে যেতে পারে কারণ রাগিনী দি প্রশান্ত কে পছন্দ করত না সেটা নন্দিনী জানতো।
প্রশান্ত যখন মারা যায় তখন রাগিনী দির বিয়ে হয়ে গেছে।
প্রশান্তর পরিবারে প্রশান্ত আর ওর মা থাকতো, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রশান্ত রাগিনী দি মনে করে নন্দিনীর ওপর ওর মার ভার দিয়ে গিয়েছিল কিন্তু নন্দিনী তো তখন রোজগার করতো না আর বাবা-মাকেও জানায়নি, তারা এই ব্যাপারটা মেনে নেবে না সেটা ভেবে তাই জয়ন্ত দা র কাছ থেকে টাকা নেবে ঠিক করে তাই প্রতিমাসে জয়ন্ত দার কাছ থেকে 5000 টাকা নিয়ে প্রশান্তর মায়ের সংসার চালায় ও চিকিৎসা করায়”।এতোটুকু বলে সৌমি থামে।
রাগিনী আর ওর মা বাবার চোখ দিয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে,ওদের মা বলে -“আমার মেয়েটা এত বড় হয়ে গেছে যে সে নিজে একটা সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে”।
রাগিনী বলে -“আমার ভুলের শাস্তি আমার বোন ভোগ করছে “।
তখন সৌমি বলে -“আজ নন্দিনীর একটা ফাইনাল ইন্টারভিউ আছে যেটাতে পাশ করলে ও একটা সেলস ডিপার্টমেন্টে চাকরি পাবে,নন্দিনী আমাকে বলেছিল চাকরিটা পেয়ে গেলে জয়ন্ত দার সব টাকা শোধ করে দেবে।
কিন্তু নন্দিনী আর কখনো বিয়ে করবে না বলে পণ করেছে কিন্তু তোমরাই বলো এইভাবে তো ও সারাজীবন থাকতে পারবে না প্রশান্তর মা আজ আছে কাল নেই তারপর ওর কি হবে?”
রাগিণীর বাবা বলে -“আমার মেয়েকে আমি চিনি ও যা করবে তা ভেবেই করবে,তাই আমি ওকে কোনদিন কোন কিছু নিয়ে প্রেসার দেইনি আজও দেবনা ও যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি তাতেই ওর সাথে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকবো।”
********

[ বিশেষ দ্রষ্টব্য:- আমরা অনেক সময় অনেকের কাজকে ভুল বুঝি কিন্তু মানুষটা সেই কাজটা কেন করছে আমাদের উচিত সেটা একবার খতিয়ে দেখা হতেও পারে আমরা যাকে নকল ভাবছি সে আসলেই খাঁটি সোনা]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।