সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ২৬)

সালিশির রায়

কিস্তি – ২৬

নিজের মনের সংগে বোঝাপড়া করতে মাঝে মধ্যে একা থাকাটাও জীবনের জন্য জরুরী। হৃদয়দা চলে যাওয়ার পর বাড়িতে ঢোকে অঞ্জলি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই বাবা-মা এগিয়ে আসে। তাদের মুখ দেখেই অঞ্জলি বুঝতে পারে ভাইয়ের কথা শোনার জন্য বাবা–মা এতক্ষণ তার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। সে তাদের আশ্বস্ত করে বলে , ভাইয়ের জন্য দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বড়োদের পাশাপাশি ভাইয়ের বয়সী তো বটেই, আরও ছোট ছোট ছেলেও রয়েছে হোস্টেলে। পুরোপুরি আদিবাসীদের হোস্টেল। দু’জন আদিবাসী সম্প্রদায়েরই শিক্ষক ওই হোস্টেল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। সে তাদের সঙ্গেও কথা বলে এসেছে। তারা জানিয়েছেন , দু-চারদিনের মধ্যে সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে গেলে ভাই নাকি বাড়ির কথা ভুলেই যাবে। দুঃশ্চিন্তার কোন কারণই নেই। তবুও সে অরুণস্যারের বাড়ির ফোন নম্বরটা দিয়ে এসেছে। স্যাররা জানিয়েছে , তেমন কিছু প্রয়োজন হলে তারা ফোন করে জানিয়ে দেবেন। হোস্টেলেও ফোন আছে। সে নম্বরটা লিখে এনেছে। মাঝে মধ্যে তারাও ফোন করে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।
তার কাছে সব শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ‘ বাড়ির কথা ভুলে যাবে ‘ কথাটায় ভ্রু কুঁচকে যায় মায়ের। বিষয়টি উপলব্ধি করে অঞ্জলি বলে, ওটা আসলে কথার কথা। ভাই বাড়ির থেকেও ওখানে ভালো থাকবে বোঝাতে গিয়েই ওই কথা বলেছেন ওরা। আর ভাই ভুলতে চাইলেই হলো? আমরা ওকে ভুলতে দেব ? চুলের মুঠো ধরে টেনে আনব না ? কথাটা বলল বটে, কিন্তু সে মনে মনে ভাবে সত্যিই কি সেই জোর খাটানো সম্ভব ? আর একজনের ক্ষেত্রে সেটা কি তারা পারল ? আসলে এটা হলো নিজস্ব মানসিকতার ব্যাপার। কারও যদি নাড়ীর টান না থাকে তাহলে হাজার চেষ্টা করেও কাউকে ধরে রাখা যায় না। দাদাই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। দাদার কথাটা আর বাবা-মা’কে বলে না অঞ্জলি। বলেই বা কি লাভ হবে ? শুধুশুধু ওদের কষ্ট বাড়বে। মায়ের তো ওই মানসিক অবস্থা। দাদার কথা শুনে কি হতে কি হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। কিন্তু দাদার কথাটা সে কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে দাদার কথাই ভাবে। সে যা আন্দাজ করেছিল , তাই সত্যি হলো শেষ পর্যন্ত। মায়ের জীবনের চেয়ে বৌদির গয়নাই দাদার কাছে বড়ো হয়ে গেল ?গয়না বাঁচাতে চুরির নাটক পর্যন্ত করতে হল ? নিজের বাড়ি ছেড়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে আশ্রয় নিতে হল শ্বশুরবাড়িতে ? আদৌ কি তারা আর দাদার প্রিয়জন আছে ? দাদার প্রিয়জন তো এখন শুধু বৌদি আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। দাদার কথা ভাবতে ভাবতেকিছুতেই ঘুম আসে না তার। নিজের মনের সংগে বোঝাপড়া করতে কিছুক্ষণ একা থাকতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সেই একাকিত্ব যেন তার গলায় কালফাঁস হয়ে এটে বসে। ছোট্ট ঘরটাকেও কেমন যেন বড়ো বড়ো লাগে। এর আগে একা তো কোনদিন এ ঘরে থাকে নি সে। দিদির বিয়ের আগে পর্যন্ত দুই বোনে থেকেছে। দিদির পর সে আর ভাই। গতকাল পর্যন্তও ভাই ছিল। আজ সে একেবারে একা। এ সময় কারও সঙ্গ পেতে খুব ইচ্ছে করে তার। সর্বাগ্রেতার হৃদয়দার কথা মনে হয়। কাল হৃদয়দার সঙ্গে তার দিনটা খুব ভালো ভাবে কাটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু একে ভাইয়ের জন্য মন খারাপ তার উপরে দাদার ওই কথাবার্তায় তার মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়। কে জানে হৃদয়দা বিষয়টা কেমন ভাবে নিয়েছে। সে নিশ্চয় তার সঙ্গে দিনটা আনন্দে কাটাবে বলে আশা করেছিল। আশাভঙ্গ হলে কারই বা ভালো লাগে ?
এই রকম বার বার ঘটলে ধৈর্যচুত্যি ঘটবে না তো ? হৃদয়দার সঙ্গে কথা বলতে খুউব ইচ্ছেকরে তার। কাল একবার নিশ্চয় আসবে হৃদয়দা। হৃদয়দার কথা ভাবতে ভাবতে শেষরাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুম ভাঙে বাবার ডাকে।চোখ কচলে দেখে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। মা উঠে বাসি কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাবা বলে , তোর বোধ হয় শরীর ভালো নেই। নাহলে তো তুই এতক্ষণ উঠে পড়িস। তোকে ডাকতামও না। কিন্তু রামবাবুরা সব এসেছেন। একটু চা করতে হবে। তোর মা তো ওসব ঠিক পারবে না। তাই —-।
বাবার কথায় খুব লজ্জা পেয়ে যায় অঞ্জলি। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে — না না শরীর ঠিক আছে। এতক্ষণ ডাকো নি কেন ? তোমরা গিয়ে বসো আমি চা নি যাচ্ছি।তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে চায়ের জল বসিয়ে দেয় সে। মায়ের হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে নিজেই কিছু সামলে রাখে। তারপর চা আর বিস্কুট নিয়ে হাজির হয় রামবাবুদের কাছে। রামবাবুরা এখন প্রায়ই পাড়ায় আসছেন। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই রাজনৈতিক দলগুলির ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠেছে। বিশেষ করে রামবাবুদের দলের তো ফুরসত ফেলার অবকাশ নেই।কারণ দলের নেতাদের স্বজনপোষন, দূর্নীতি , অহংকারের পাশাপাশি দলে নাকি অনেকে বিভীষণ হয়ে উঠেছে। বেনোজলও ঢুকেছ।তাই তাদের এবার সামনে কঠিন পরীক্ষা।
বাবার সঙ্গে আলোচনার সময় রামবাবুদের ওইসব আশঙ্কার কথা তার কানে এসেছে। সুহাস কবিরাজরাও নাকি গোপনে গোপনে আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সব দলই দেদার মদ , টাকা আরও সব জিনিসপত্র বিলোচ্ছে আদিবাসী পাড়াগুলিতে। আর আদিবাসীরাও সব দলের কাছেই ভোট দেব বলে ওইসব জিনিসপত্র হাতাচ্ছে।অঞ্জলি জানে , আদিবাসীরা একসময় এই রকম ছিল না। এই রকম চালাকি জানত না। সরল সিধে হিসাবেই তাদের পরিচিতি ছিল। নিজে ঠকেছে, কিন্তু অন্য কাউকে কিভাবে ঠকানো যায় সেটাই জানত না। আসলে কাজের সূত্রে ধান্ধাবাজ মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়েই ছোঁয়াচের মতো রোগটা তাদেরও সংক্রামিত করে ফেলেছে। বিষয়টা তার একটুও ভালো লাগে না। যে কেউ স্বাধীন ভাবে তার পছন্দের দলকে ভোট দিতেই পারে , তার জন্য এত হানাহানি , ঘুষ দেওয়া নেওয়া কেন ? কিন্তু তার ভালো লাগা মন্দ লাগাতে কি’ই এসে যায় ? বাবা তার মনোভাবের সঙ্গে একমত কিনা তা জানতে খুব ইচ্ছে করে তার। কিন্তু সেই সু্যোগ আর হয় না। কারণ প্রায় প্রতিদিনই সকালে বাবাকে নিয়ে রামবাবুরা আদিবাসী গ্রামগুলিতে ভোটের প্রচারে বেড়িয়ে যায়। ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। সন্ধ্যে হলেই মা ঘুমিয়ে পড়ে। তার একা সময় আর কাটে না।
মাঝে মধ্যে অবশ্য হৃদয়দা আসে। কিন্তু বাড়িতে কেউ থাকে না বলে তাকেও বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না অঞ্জলি। পাড়ার লোকেদের তো তার চিনতে বাকি নেই। তিল থেকে তাল করতে কতক্ষণ। তাই বাবা না ফেরা পর্যন্ত একাকী বইয়ের পাতা উল্টে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবে আর দুটো বছর পড়াশোনাটা চালিয়ে একটা পাশ দিতে পারলে চাকরী-বাকরী কিছু একটা হলেও হতে পারে। সেদিন রামবাবু নিজে থেকেই বাবাকে বলছিলেন , আদিবাসীদের জন্য তো আমাদের সরকার চাকরির কোটা বেঁধে দিয়েছে।তোমার মেয়েটা একটা পাশ দিয়ে বেরোতে পারলেই অঙ্গনওয়ারি , আশা কিম্বা ওই ধরণের কোন একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখব। কথাটা শুনে তার মনে মনে , একটা আশা জাগে। চাকরিটা হয়ে গেলে হৃদয়দার সঙ্গে বিয়েতে তার আর খুব একটা বাধা থাকবে না। চাকরিওয়ালা বৌ’দের বিয়ের বাজারে দারুণ কদর। তখন আর কেউ জাত-বেজাত নিয়ে অত মাথা ঘামায় না। পণ নিয়েও দরাদরি করে না।এই ধরণের বিয়ে নিয়ে একটা কথা প্রায়ই শুনতে পায় অঞ্জলি। ছেলেপক্ষের লোকেরা বলে দুধ দেওয়া গাই , ডিম পাড়া হাসই যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন খামোকা দুধ কিম্বা ডিম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি ? সারা জীবন ধরে দুধ-ডিম খাও কেন যত পারো।
কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগে অঞ্জলির। মেয়েরা যেন মানুষ নয় , সব জীবজন্তু। প্রায়ই কানে আসে কথাটা। পরানকাকাদের বাড়িতেই তো শুনেছে কথাটা। তাদের বাড়িতেই তো ঘটেছে ওই ঘটনা। পরানকাকারা মোড়ল , কিন্তু তার এক ভাইপো অন্য জাতের এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকাকে বিয়ে করেছে ভালোবেসে। বাড়ির লোকেরা কোন উচ্চবাচ্য তো করেই নি , উল্টে ঘটা করে বৌভাতে বিরাট ভোজ করেছে। বাইরে থেকে দেখে বিষয়টিকে যতটা ভালো মনে হয় তা কিন্তু নয়। ওই মেয়েটি যদি চাকরি না করত তাহলে তখন জাতপাতের অনুশাসন তীব্র হয়ে উঠত। কয়েক বছর আগেই তো পরানকাকারই ছোট ভাই নিচু জাতের একটা মেয়েকে ঠাকুর তলায় সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে ঘরে তুলেছিল।কিন্তু তখন বাড়ির লোকেরা মেনে নেয়নি তাকে। বাড়ির মেয়েরাই সেই সিঁদুর ঘষে তুলে দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর তড়িঘড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেয়। এ রকম ঘটনা তো কতই ঘটে। খুব চাপে পড়লে মেয়ের পরিবারের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে ছেলের বাড়ির লোকেরা। ছেলেটাও কেমন সুবোধ বালকের মতো পরিবারের লোকের কথা শুনে ছাতনাতলায় গিয়ে বসে পড়ে। একবারও ভাবে না মেয়েটির কি হবে। এইসব কথা ভাবতেই ভাবতেই সময় কেটে যায় অঞ্জলির। কিন্তু সেদিন সময় আর কাটে না। সন্ধ্যা থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পাড়ার লোকেরা সবাই ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সেই কেবল চিমনি জ্বালিয়ে বাবার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। সেই সময় দরজার কড়াটা নড়ে ওঠে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।