সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৪৮)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৪৮

তখন ওদের দেখে কে বলবে সব হারিয়েছে ওরা। সত্যি করেই পাথরকুচি কুড়িয়ে ঘুটিং খেলতে বসে যায়। দিব্যি একে একে মনে পড়ে যায় দান নেওয়ার ছড়াগুলো। ওদের কান্ড দেখে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ভাবে মেয়ে দুটোর হল কি ? ওরা কিন্তু দান শেষ না করে খেলা ছাড়ে না। তার মধ্যেই একসময় সন্ধ্যা নামে। যে যার নিজের নিজের ঘরে ফেরে। ওরা দুজনেও খেলা ভেঙে হাত – পা ধুয়ে ঘরে ফেরে। অঞ্জলি লক্ষ্য করে হোমের অনেকেই আজ যেন তাকে একটু অন্য রকম চোখে দেখছে। তারা হয়তো ভেবে পাচ্ছে না যে মেয়ের কাছে আজ শয়তানের ডাক এসেছে সেই মেয়ের মধ্যে কি করে এত ফুরফুরে ভাব ? তাহলে কি মেয়েটাও ওই প্রকৃতির ? এটা অবশ্য তার মনের ভুলও হতে পারে।খাওয়া দাওয়ার পর অবশেষে আসে সেই মুহুর্ত। বড়দি এসে আর একবার মনে পড়িয়ে দিয়ে যায় শয়তানের ডাকের কথা। সে বলে , চিন্তা নেই মনে। ঠিক সময়মতো চলে যাব। বলে বটে কিন্তু ক্ষণেকের জন্য হলেও কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় পড়ে অঞ্জলি।

                    বাইরে সুস্মিতদারা এসে পৌঁচেছে তো ? সমস্ত ব্যবস্থা করতে পেরেছে তো ?  তার চিন্তাগ্রস্থ মুখ দেখে শ্রাবণী এসে হাত দুটো ধরে। জিজ্ঞেস করে , তুমি কি ভয় পাচ্ছ দিদি ?  

—- না রে , ভয় আর আমি পায় না। সব তো হারিয়েই বসে আছি , নতুন করে হারানোর তো কিছু নেই। আমার চিন্তাটা অন্য কারণে।
—- কি কারণে ?
—- যদি আজকের এই পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে না পারি , তাহলে আর সুযোগ পাব না। তখন আরও যেসব মেয়ে আসবে তাদেরও শয়তানটার কাছে নিজেকে বলি দিতে হবে। সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
—– নিজের জন্য না ভেবে যাদের তুমি চেন না , জানো না তাদের জন্য এত চিন্তা তোমার ?
—- চিনি না , জানি না ঠিকই। কিন্তু যন্ত্রণাটা যে সবার একই রে।
—- তোমার সবার জন্য এত চিন্তা, দেখো আমি বলছি তুমি ঠিক শয়টানটাকে শায়েস্তা করতে পারবেই পারবে।
—– তাই যেন পারি, ঠাকুরের কাছে সে প্রার্থনাই কর। এবার আমি আসি রে।
—- হ্যা এসো। দরকার হলে চিৎকার করে ডেক।
—- বেশ, তাই হবে। রেডি থাকিস প্রয়োজনে ডেকে নেব।
বলে আস্তে আস্তে দোতলার সিড়িতে পা রাখে অঞ্জলি। যেতে যেতে কেবল মনে একটাই আশঙ্কা হয়, আরও নানা কাজের ঝামেলায় সময়টা গুলিয়ে ফেলেনি তো সুস্মিতদা। আবার পরক্ষণেই মনে হয় এই কয়েকদিনে সে তাদের যতটুকু চিনেছে তাতে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলিয়ে ফেলার মতো ছেলে তারা নয় বলেই মনে হয়েছে।

                           দোলাচলের মধ্যেই সে পৌঁছে যায় অখিলেশবাবুর ঘরের সামনে। অখিলেশবাবু যেন জানোয়ারের মতোই তার প্রতীক্ষাতেই ওঁত পেতে বসেছিলেন। তার যেন আর তর সই ছিল না। খপ করে তার হাতে ধরে টেনে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই হাত ছাড়িয়ে সপাটে এক চড় বসিয়ে দেয় সে।

তীব্র শ্লেষের সঙ্গে বলে , লজ্জা করে না আপনার অসহায় মেয়েদের সঙ্গে এরকম আচরণ করতে। দেবতুল্য বাবার নামটা এভাবে ডোবাচ্ছেন ? চড়টা খেয়েই কেমন যেন হতভম্ব হয়ে যায় জানোয়ারটা। ভাবতেই পারে নি তারই হোমে আশ্রিতা একটি মেয়ে এভাবে তার গালে চড় বসিয়ে দেবে। এতদিন প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি , কান্নাকাটির পর সবাই ধরা দেয়।তাই শিকার ফসকানো বাঘের মতো তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ার উপক্রম করতেই ফের এক থাপ্পড় কসিয়ে দেয়। তারপরই তারস্বরে কে কোথাই আছো বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করে দেয়।
শয়তানটা হিসহিসিয়ে ওঠে — হারামজাদী মাগী, এই নিশুতি রাতে হোমে বাঁচাতে কেউ আসতে পারবে না। তোকে লুটে পুটে খেয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে চিলেকোঠার ঘরে ঝুলিয়ে রাখব। হোমের মেয়েরা বলবে তুই আত্মহত্যা করেছিস। ল্যাঠা চুকে যাবে।
—- সে সুযোগ আর তুই পাবি না শয়তান। তোর পাপ ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।আজই তোর শেষদিন।
—- আমার না তোর ? চিল্লা না তোর কোন ভাতার আছে বাঁচাতে আসুক দেখি।
আর চিৎকার করতে হয় না অঞ্জলিকে। সজোরে নড়ে ওঠে মেন গেটের কড়া। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে অঞ্জলির।ততক্ষণে হোমের মেয়েদের অনেকেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে তখন কড়া নাড়ার আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। জানোয়ারটাকে কেমন যেন চিন্তিত দেখায়। নিচে নামার আগে তাকে শাঁসিয়ে যায় — ফিরে আসি দাঁড়া হারামজাদী। তারপর তোর ব্যবস্থা করছি।

                                তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে বলে , নিজের ব্যবস্থা করগে আগে। পিছনে পিছনে নিচে নেমে আসে অঞ্জলিও। হোমের মেয়েদের  চোখে মুখে তখন বিষয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে । হোমের ইতিহাসে এ ধরণের নাটকীয় ঘটনা তো এর আগে ঘটতে দেখে নি তারা। শয়তানটা প্রথমে গিয়ে বড়দি কি সব বলে গেটের সামনে পাঠায়। বারন্দা থেকেই অঞ্জলিরা শুনতে পায় বড়দি গেটের ফুটো দিয়ে বাইরে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন , কে আপনারা ? এত রাতে কি চান ?

উত্তর আসে — আমরা সাংবাদিক , গেটটা খুলুন একবার হোমের ভিতরে যেতে চায়।
বড়দি এবারে শয়তানটার দিকে তাকান। শয়তানটা এবারে দ্রুত ফুটোর কাছে গিয়ে বলে — প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া হোমে সাংবাদিকদের ঢোকার কোন নিয়ম নেই। তার উপরে রাতের বেলা পুরুষদের হোমের ত্রিসীমানাও ঘেঁষতে দেওয়া হয় না।উল্টো দিক থেকে এবারে ভারি গলায় জবাব আসে, আমরাও সেটাই দেখতে এসেছি রাতের বেলা মেয়েদের হোমে পুরুষের গলা কেন ? নিন , খুলুন আমি ডি,এম বলছি। নাহলে এরপর কিন্তু আমাদের গেট ভাঙতে হবে। আর তার ফল হবে আরও মারাত্মক।ওই কথা শোনার পরই শয়তানটা কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে। চোয়ালটাও ঝুলে পড়ে এক মুহুর্তেই। এগিয়ে এসে বারন্দায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় শয়তানটা বলে , আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে তোমরা ওদের কাছে মুখ খুলো না যেন।

                                             তারপরই গেট খুলতে চলে যায় সে। অঞ্জলি লক্ষ্য করে শয়তানটার ওই কথা শোনার পরই মেয়েদের চোখে মুখে দোটানার ছাপ।

মন থেকে কিছুতেই শয়তানটাকে ক্ষমা করে দিতে পারছে না। আবার ভাবছে মুখ খোলার পরই শয়তানটার কিছুই যদি না হয় , যদি ওরই দয়ায় আবার হোমে থাকতে হয় তাহলে কি হবে ? অঞ্জলিও উপলব্ধি করে দোটানায় পড়াটাই স্বাভাবিক। তাই সে তাদের আশ্বস্ত করার জন্য বলে , আপনারা কোন রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। নির্ভয়ে সত্যি কথাটাই বলবেন। আজ থেকে শয়তানটা আর হোমে নয় জেলে থাকবে।
তার কথা শেষ হতে না হতেই গেট খুলে যায়। আর অঞ্জলি দেখতে পায় প্রায় সমস্ত মিডিয়ার সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসনের লোক ঢুকে আসছে হোমের ভিতর। প্রথমেই একজন পুলিশ শয়তানটার জামার কলারে চপ করে ধরে। আর একজন মহিলা পুলিশ এসে ধরে বড়দিকে। তারপর সবাই ছেঁকে ধরে তাকে। সে ঘটনার কথা সমস্ত খুলে বলে। বলে , শয়তানটা হোমের প্রতিটি মেয়েকে নিজে ভোগ করার পর অন্যদের কাছে ভাড়া খাটিয়েছে। একজন পুলিশ অফিসার তার বয়ান লিখে নিয়ে সই করিয়ে নেয়। তারপর একই ভাবে অন্যান্য মেয়েদেরও বয়ান লিখে নেন ওই অফিসার। নিজের লাঞ্ছনার কথা গোপন করেন নি কেউ। টিভি ক্যামেরার সামনেও সবাই একই কথা বলেন। হাফ ছেঁড়ে বাঁচে অঞ্জলি। যেন তার একটা পরীক্ষা পার হলো। সবকিছু মিটে যাওয়ার পর ডি,এম সাহেব শয়তানটাকে বলেন, ছি : একজন নামী লোকের ছেলে হয়ে আপনি এই ধরণের কাজ করতে পারলেন ?
শয়তানটা মিউ মিউ করে বলে, পায়ে ধরছি স্যার। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।
—- আপনি ক্ষমারও অযোগ্য। অসহায় মেয়েগুলো যখন আপনার পায়ে ধরেছিল তখন আপনি কি করেছিলেন ? কই তখন তো অসহায় মেয়েগুলোকে দেখে রেহাই দেন নি তাদের। একে নিয়ে গিয়ে তোল গাড়িতে।

                     তাকে নিয়ে যেতেই কাঁদতে শুরু করেন বড়দি। এবারে যেন গর্জে ওঠেন ডি,এম -- একদম  মায়া কান্না কাঁদবেন না। অসহায় মেয়েগুলো যখন কান্নায় গুমরে মরত একজন মেয়ে হয়েও তখন কি করে আপনি বছরের পর বছর অপকর্মে মদত যুগিয়েছেন।

হোমের চার দেওয়ালে বন্দী একটি মেয়ে যা করে দেখাল আপনি চাইলে তা আরও অনেক আগে করতে পারতেন। তাহলে আজ আর এতগুলো মেয়েকে লাঞ্ছনার জীবন বইতে হত না।এই কে আছো একেও নিয়ে যাও।তারপর হোমের মেয়েদের দিকে ঘুরে ডি,এম সাহেব খুব মোলায়েম গলায় বলেন — শুনুন সবাই , আর আপনাদের কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। আজ থেকে এই হোমের দায়িত্ব পুরোপুরি প্রশাসন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। আজই আপনার বিনোদনের জন্য একটি টিভি লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফোনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার নম্বর দিয়ে যাচ্ছি, যখনই কোন সমস্যায় পড়বেন জানাবেন। পর্যায়ক্রমে দুজন করে পুলিশ কর্মী ২৪ ঘন্টা হোমের গেটে মোতাইন করা হচ্ছে। শীঘ্রই জেলা স্তরের একজন অফিসারকে এই হোম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। ততদিন আপনারা একজনকে সামনে রেখে চালিয়ে নিন। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় অঞ্জলিই সেই দায়িত্ব নিলে ভালো হয়। আপনাদের সব কি মত ?
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে — হ্যা, ঠিক বলেছেন স্যার। সবাইকে হাতের ইশারা থামার অনুরোধ করে আবার ডি, এম সাহেব বলেন , এতদিনের একটা দুষ্টু চক্রের সন্ধান দেওয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যম সর্বোপরি অঞ্জলিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ততক্ষণে টিভি ফিট হয়ে গিয়েছে। চালু হয়ে গিয়েছে ফোনও। কৃতজ্ঞতায় অঞ্জলিরা হাত জোড় করে সাংবাদিক, পুলিশ – প্রশাসন, ডি,এম সাহেবকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। পরস্পর পরস্পরকে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। গেটের বাইরে পা রাখার আগে ডি,এম সাহেব তার মাথায় হাত রেখে বলে যান — তোমার কথা আমার মনে থাকবে। তারপরই বন্ধ হয়ে যায় গেট। তবুও দীর্ঘদিনের জমে থাকা দমবন্ধ করা গুমোট আবহাওয়াটা কেটে হোমে যেন বইতে থাকে স্বস্তির সুবাতাস।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।