সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৪৬)

সালিশির রায়

কিস্তি - ৪৬

শুরু হয় অঞ্জলির এক নতুন জীবন। হোমের গেট বন্ধ হয়ে যেতেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে অঞ্জলির। মনে হয় ছুটে মা-দিদির কাছে চলে যায়। কিন্তু ততক্ষণে গেটে পড়তে শুরু করেছে একের পর এক তালা। অফিস ঘরে সইসাবুদের পর সে জিনিসপত্র নিয়ে পৌঁছোয় তার ঘরে। সেই ঘরে আরও পাঁচ জন বিভিন্ন বয়সী মেয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে শ্রাবণী নামে একজন তারই বয়সী। সে যেচে এসে তার সঙ্গে আলাপ করে। অন্যদের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেয়। মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। শ্রাবণীর পাশেই তার বেড। তাই মাঝে মধ্যেই তারা একই বিছানায় শোয়। অনেক রাত্রি পর্যন্ত গল্পগুজব করে। শ্রাবণীর জন্য হোমের নিসঙ্গতা কিছুটা ভুলে থাকে অঞ্জলি। সে শ্রাবণীকে তার হোমে আসার কাহিনী খুলে বলেছে।
শ্রাবণীও বলেছে তার কথা। সেই কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে অঞ্জলি। মনে মনে ভাবে মানুষ এরকমও হয় ? ছোটবেলায় শ্রাবণীর বাবা মারা যায়। বাবা ছিল জেলে। একদিন মাছ ধরতে গিয়ে মরে পড়েছিল ক্যানেলের জলে। অনেকে বলেছিল মা’ই নাকি সমীরমামাকে দিয়ে বাবাকে খুন করিয়েছিল। কিন্তু সব ধামাচাপা পড়ে যায়। তারপরই সমীরমামাকে বিয়ে করে মা। তার আরও তিন ভাই বোন হয়। কিন্তু শ্রাবণী সবার চক্ষুশূল হয়ে পড়ে।

                               সৎ বাবা তো বটেই , নিজের গর্ভধারিণী মা,ও তাকে উঠতে বসতে খোঁটা দিত। স্কুল ছাড়িয়ে তাকে দিয়ে ছাগল চড়ানো, কাঠ কুড়ানো থেকে সংসারের সমস্ত কাজ করানো হত। আর পান থেকে চুন খসলেই চুলের মুঠি ধরে চড় থাপড় চলত। ছোট ভাইবোন গুলোও বাবা - মায়ের আশকারা পেয়ে পেয়ে তার গায়ে হাত তুলত। অনেক সময় তার চোখের জলে ভাত-মুড়ি মাখামাখি হয়ে যেত। ওই সময়টুকুই সে কাদার জন্য পেত। তাকে কাঁদতে দেখলেই মৃত বাবাকেও তুলোধোনা করতে ছাড়ত না মা।শ্রাবণী ভেবে পেত না , সৎবাবার না হয় সে মেয়ে নয়, তাই তার কোন টান না'ই থাকতে পারেকিন্তু মা তো তাকে অন্য ভাইবোনেদের মতোই গর্ভে ধারণ করেছে। তাহলে সব সময় তাকে বিষ নজরে দেখে কেন ? বাবার কথা তার খুব মনে পড়ে।

মাছ ধরে এসেই তাকে কোলে নিয়ে আদর করত। তাকে নিয়ে খেতে বসত। কাটা বেছে বেছে তুলে দিত পেটির মাছ , মাছের মাথার ঘিলু। কাছে পিঠে মেলা খেলা হলেই কাঁধে নিয়ে চলে যেত তাকে। শোনপাপড়ি – পাপড়, সস্তার খেলনা কিনে দিত। পুতুলনাচ, ম্যাজিক, বায়োস্কোপ কিম্বা মরণকূপের খেলা দেখাত। আবদার রাখতে তাকে কোলে নিয়ে নাগরদোলাতে চড়ত।
মাকে সাধ্যসাধনা করলেও মা তাদের সঙ্গে যেত না। পড়ে শুনেছে , সেসময় মা নাকি সমীরমামার সঙ্গে গল্প করত। তখন থেকে তার প্রতি তেমন একটা টান ছিল না মায়ের। কিন্তু বাবা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। এক কথা চাদর ছেঁড়া আদর ছিল বাবার।তাই বাবার মৃত্যুর পর বাড়িটাই তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তবু লাথি ঝাঁটা খেয়ে দিনগুলো চলে যাচ্ছিল।তারপর যে ঘটনাটা ঘটল সেটাই তার জীবনটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিল।

                                            তেরো পেরিয়ে সবে তখন চৌদ্দতে পা রেখেছে সে। একদিন বিকালে তাদের বাড়িতে আসে ভোম্বলমামা। ভোম্বলমামা বাইরে ঘোরাফেরা করে। বাবা--মায়ের সঙ্গে নিচুস্বরে কিছুক্ষণ কিছু আলোচনা করে চলে যায়। সে চলে যাওয়ার পর মা বলে, ভোম্বল কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করেছে তোর জন্য। ভালো খাবি - পড়বি , টিভি-সিনেমা দেখবি, কত মজা। শুনে তার একটুও ভালো লাগে না। এই গ্রামে সে ছোট থেকে মানুষ হয়েছে , বাবার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তাই কিছুতেই শহরে যেতে তার মন চায় না। সে বলে , মা আমি গ্রামেই থাকি না, এখানেই তো কত কাজ।

তার কথা শুনে মা মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে — বাবা তো আদর দিয়ে দিয়ে একটা বাঁদর তৈরি করে দিয়ে গ্যাছে। তাই যা বলি তাতেই না করা চায়। ওকে খাওয়াতে গিয়ে আমার অন্য ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে মরুক আর কি! ওরা যেন সব বানের জলে ভেসে এসেছে। কোন বাহানা চলবে না।আমি ভোম্বলকে কথা দিয়ে ফেলেছি। ও কাল সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। তুমি তৈরি থেক।
সে আর কোন কথা বলতে পারে না। বাবার সম্পর্কে কেউ কিছু বললে তার খুব কষ্ট হয়। সে রাতে আর ঘুম হয়নি তার।সারারাত শুধু বাবার কথা ভেবেছে আর চোখের জল ফেলেছে।মায়ের কথাগুলো তাকে যেন তিরের মতো বেঁধে। সে মনে মনে ভাবে , মা থাকলেও তার তো আর বাবা নেই। মাও কি আছে তার ?
খুব সকালেই এসে পৌছে যায় ভোম্বল মামা। বেশ কিছুক্ষণ বাবা-মায়ের সংগে ঘরের দরজা বন্ধ করে কি সব আলোচনা করে। তারপর তাকে নিয়ে ট্রেনে সোজা কলকাতা। একটা হোটেলে তাকে নিয়ে গিয়ে তোলে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে — কই , মামা কাদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলেছিলে, যাবে না ?

                                  মামা তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে -- যাব যাব, অত তাড়া কিসের ? একটু জিরিয়ে নিয়েই চলে যাব। তুই ওই খাটে একটু বোস। আমি চট করে একবার নিচে থেকে আসি। ভোম্বল মামার আচার আচরণে তখন থেকেই কেমন সন্দেহজনক মনে হয় তার। প্রায় বাবার বয়সী লোকটার দৃষ্টিটা কেমন যেন লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোম্বল মামা একটা বোতল আর গ্লাস নিয়ে ফিরে আসে। তার পিছনে পিছনে একজন দুটি থালায় রুটি আর মাংস দিয়ে যায়। লোকটি চলে যেতে ঘরের ছিটকানি তুলে দেয় ভোম্বল মামা। তারপর বোতল থেকে হলুদ রঙ এর কিছু একটা গ্লাসে ঢেলে ঢেলে খেতে থাকে। প্রথম দিকে বুঝতে না পারলেও পরে গন্ধে সে বোঝে সেটি আসলে মদ। তার সৎ বাবা যখন খেত তখন এরকম গন্ধ ছড়াত সারা বাড়ি।  ভোম্বল মামা বলে, নে রুটি মাংস খেয়ে নে। তার খিদে পেলেও কিছুতেই খেতে পারে না। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করেই হাত ধুয়ে নেয় সে। ভোম্বল মামা অবশ্য তারিয়ে তারিয়ে সব খায়। মদের নেশায় তখন তার চোখ লাল।হাত ধোওয়ার পরই আচমকা ভোম্বল মামা খুব জোড়ে টিভি চালিয়ে দেয়। তারপরই সে কিছু বোঝার আগে ঝাপিয়ে পড়ে তার উপরে। সে প্রথমে  প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। তারপর ভোম্বল মামার পায়ে ধরে বলে , তুমি আমার বাবার মতো।

আমার এতবড়ো সর্বনাশ তুমি কোর না।
ভোম্বল মামা বলে , আমি আবার তোর কোন কালের মামা হলাম রে। সর্বনাশের পথে তো তোর মা আর তার ভাতার ঠেলে দিয়েছে রে। গুনে গুনে পঁচিশটি হাজার টাকা মিটিয়ে নিয়েছে। সেটা কি শুধু তোর মুখ দেখে দিয়েছি ?

                                        ওই কথা শোনার পরই সে কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার সমস্ত পোশাক টেনে খুলে ফেলেছে ভোম্বল মামা। তারপরই ঝাপিয়ে পড়ে তার উপর। তীব্র যন্ত্রনার ককিয়ে ওঠে সে। পায়ের ফাক গলে বিছানার গড়িয়ে পড়ে গরম রক্ত স্রোত। টিভির আওয়াজে চাপা পড়ে যায় তার কুমারীত্ব হারানোর বোবা কান্না। তারপর কতবার যে জানোয়ারটা তাকে খুবলে খেয়েছে তা মনে নেই।ভোরবেলায় তার ঘুম ভাঙায় শয়তানটা। তারপর বলে -- তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। কাজের জায়গায় যেতে হবে এবার। সে চেয়ে দেখে তখনও তার শরীরে সুতোর চিহ্নমাত্র নেই। সর্বাঙ্গ রক্তে চটচট করছে। সে বাথরুম থেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বেড়িয়ে আসে। যত দ্রুত সম্ভব সে এই জানোয়ারটার হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে চায়। কিন্তু নিস্কৃতি তার মেলে না।শয়তানটা তাকে নিয়ে গিয়ে ৫০ হাজার টাকায় সোনাগাছির এক মাসীর কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর রাতের পর রাত বীভৎস অভিজ্ঞতা। একদিন তার ঘরে খদ্দের ঢোকানোকে কেন্দ্র করে দুই দালালের মধ্যে ঝামেলার জেরে একজন খুন হয়ে যায়। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। সে পুলিশকে সব খুলে বলে। ভোম্বল মামার কীর্তির কথা বললেও বাবা -- মায়ের নামে কোন অভিযোগ করে না। তারা তাকে বিক্রি করে দিতে পারে, কিন্তু মেয়ে হয়ে সে কি করে তাদের জেলে ঢোকায় ? সব শোনার পর পুলিশ তাকে নিজের জেলায় পাঠিয়ে দেয়।


                                     বিচারে ভোম্বল মামার ৭ বছর জেল হয়। তার ঠাই হয় এই হোমে। বাবা - মা অবশ্য বার কয়েক তাকে নিতে এসেছে। কিন্তু সে যায় নি। লজ্জা কিম্বা ঘৃণা নয়, সে যায় নি  ভয়ে। বাবা--মার প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। সুযোগ পেলে বাবা - মা যে তাকে আবার বেচে দেবে সে সম্পর্কে কোন সংশয়ই ছিল না তার! সেই থেকেই সে হোমে আছে। মর্মস্পর্শী ওই কথা শুনতে শুনতে কখন ভোরের আলো ফুটে ওঠেছে তা কেউ টের পায় নি। চোখের জলে দুজনের দৃষ্টি তখন ঝাপসা। সে মনে মনে ভাবে , শ্রাবণীর তুলনায় সে কত ভাগ্যবতী। তার বাবা - মা তো শত অভাবেও তাকে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবে নি। তার লড়াইয়ে অনেকেই পাশে রয়েছেন। কিন্তু শ্রাবণীকে তার লড়াইটা একা লড়তে হয়েছে। তার যদি কোনদিন সুদিন ফেরে তাহলে শ্রাবণীকে সে সমাজের মুলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করবে। শ্রাবণীই জানায় , শুধু সে একাই নয় , এই হোমের ৩০ জন ভাগ্য বিড়ম্বিত মেয়ের  জীবন কাহিনী প্রায় একই রকম। কেউ ভয়ে বাড়ি যায় না , আবার কাউকে বাড়ির লোকেরা ফিরিয়ে নিয়ে যায় না। শ্রাবণীর কাছেই সে শোনে অখিলেশবাবুর নাম।


 ক্রমশ
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।