ছোটগল্পে অগ্নিমিতা দাস

দাগ

# ইস্! যা ভেবেছে তাই, লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছিল, কিন্তু উঠতে গিয়েই স্কার্টের পিছনটা দেখেই বসে পড়ল!
ফিজিক্স টিউশনের এই ব্যাচে মেয়ের সংখ্যা মোটে পাঁচ! আজ তিনজন এসেছিল! দেবাদৃতা, তিলোত্তমা আর টিনা ক্লাস শেষ হতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল! পায়েলের এখন ডেট নয়, দেরি আছে! তবে স্কুলেই পেটটা ব্যাথা ব্যাথা করছিল, কিন্তু ও পাত্তা দেয়নি! এখন বুঝতে পারছে ম্যাসাকার হয়েছে! তাছাড়া বাথরুমের কাবার্ডে মাকে পই পই করে রাখতে বলে, কিন্তু মা সেটা সব সময় আলমারি বন্দী করে রাখবে, কি না দাদা দেখতে পাবে!
# মা দাদা মেডিকেলের থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট!
# এর মধ্যে এত লুকোছাপার ব্যাপার কি!
শত বলাতেও পায়েলের কথায় ওর মা কর্ণপাত করে নি,আলমারি বন্দী থাকার জন্য আজকে বেরোনোর সময় একবার প্রিকোশন হিসেবে নেবে ভেবেও আলমারির চাবি খুঁজে পেল না কারণ মা বাড়িতে ছিল না! এটা একটা টিউটোরিয়াল হোম! অসীম স্যার এখানে সপ্তাহে দুদিন পড়ান! উনার বাড়ি নয় যে বাড়ির মেয়েদের খুলে বলা যাবে! বাথরুম আছে! কিন্তু পায়েল উঠলেই দাগ দেখতে পাওয়া যাবে!
# হাই, সুইটহার্ট! মুখ শুকনো কেন!
হ্যান্ডসাম আর মাসলম্যান অয়ন হাসিহাসি মুখে ওকে প্রশ্ন করলো!
# এনিথিং রং!
# চুল টা আজ বেশ কায়দা করতে পারিস নি বলে , না না বুঝেছি রিসেন্ট ইন্সটাগ্রামে দেওয়া ওই মারকাটারি ছবিতে কম লাইক পেয়েছিস!
# নাহলে ,মায়ের কাছে ডায়েটিং এর জন্য উদোম ঝাড় খেয়েছিল!
# ফালতু বকিস না! কোনটাই নয়! পায়েল অসহায় চোখে অয়নের দিকে তাকালো, যদি অয়ন ওর সিচুয়েশনটা একটু বোঝে!
# অয়ন তোর গাড়িতে আজ লিফট দিবি! বলতে বলতেই অয়নের মোবাইল বেজে উঠলো!
#হাই মা বলো! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ বেরোচ্ছি এক্ষুনি ক্লাস শেষ হলো তো! আমি ডট সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছে যাবোই!
#হ্যাঁ এখন রাখছি!
#তাহলে মিস ডিপপ্রেস তুমি থাকো! এই আজকে না প্লিজ কিছু মনে করিস না। আমি ওই রাস্তায় তো যাচ্ছি না আজকে আমার মায়ের বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে রে, এটা এটেন্ড না করলে পুরো কেস খেয়ে যাবো! অয়ন তড়িঘড়ি নিজের স্কাই ব্যাগ পিঠে নিয়ে ওকে টাটা করে ক্লাস থেকে পার্ক এভিনিউয়ের ভুরভুরে গন্ধে ক্লাসরুম ভরিয়ে বেরিয়ে গেল! অয়ন কে আজকে খুব সুন্দর লাগছিল দেখতে! ব্লু টর্ণ জিন্সের ওপর জিম করা শরীরে ব্ল্যাক গেঞ্জিটা দুর্দান্ত লাগছিল! অয়ন পায়েল এর সঙ্গে একই স্কুলে ক্লাস টুয়েলভে পড়ে! ডিবেট, গিটার বাজানো, খেলাধুলা স্কুলের সমস্ত অ্যাক্টিভিটিতেও প্রথম স্থানে থাকে! তাই অনেক মেয়েদের ও হার্ট থ্রব! তবে অয়নের হার্ট থ্রব পায়েল! অয়ন বিত্তশালী পরিবারের ছেলে! বাবা পুলিশের ওপরতলায় চাকরি করে, মা সমাজসেবী! টিউটোরিয়াল হোমে নিজস্ব গাড়িতে আসে! তাই পায়েল আজকের দিনটার জন্য লিফট চেয়েছিল কারণ অয়নের বাড়ি যাবার পথেই ওর বাড়ি পড়ে! এখন পায়েল উঠবে কি করে! পাড়ার মোড়েই মেডিকেল স্টোর আছে, কিন্তু সেখান থেকে ন্যাপকিন কিনে এনে বাথরুম যাবে সে ক্ষমতা ওর নেই!
#স্যার বললেন সব আলো নিভিয়ে দিতে আজকে উনার আর ব্যাচ নেই, তাই………
#হ্যাঁ মানে বেরোচ্ছি মানে পায়েল অনিমেষের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না! ফর্সা একহারা উস্কোখুস্কো চুলের এই ছেলেটার দিকে পায়েল অন্য কারণে তাকাতে পারছিল না! কিছুদিন আগে অয়নের দলের সঙ্গে অনিমেষের একটা ঝামেলা হয়ে গেছে!
ঝামেলার জন্য দায়ী পায়েল! একদিন পায়েলের ক্লাস থেকে বেরোনোর সময় ওর খাতা থেকে কিছু একটা পড়ে গেছিল, অনিমেষ সেটা কুড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে বড় রাস্তার মোড় অবধি আসে পায়েলকে দিতে, যেখানে ও অপেক্ষা করে অটো ধরার জন্য! পায়েল তখন অনিমেষকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করে এই কাগজটা ফেরত দিতে আসার জন্য! পায়েল অস্বীকার করে যে কাগজটা ওর নয়! কারণ ছিল! বেশ কয়েক মাস আগে একটা ইম্পোট্যান্ট নোট পায়েল অনিমেষের কাছে চেয়েছিল! পায়েল সেদিন অ্যাবসেন্ট ছিল অয়ন ও তাই! কিন্তু অনিমেষ সেদিন ওর মুখের উপর বলে আমার কাছে নেই রে নোটস টা! অথচ পায়েল খুব ভালো করেই জানতো সেদিন অনি ক্লাস এটেন্ড করেছিল! তারপরই ছুটতে ছুটতে ওর কাগজ দিতে আসাতে পায়েলের মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল! ওর মতো সুন্দরী অ্যাট্রাক্টিভ মেয়েকে অনিমেষের এইভাবে মুখের উপর অপমান মনে মনে মেনে নিতে পারছিল না!
ব্রাইট স্টুডেন্ট বলে এত দেমাক! অয়ন কে বলে ওর দলবলকে দিয়ে অনিমেষকে আচ্ছা করে শাসানি দেওয়ায়! আসলে সেদিন পায়েল জানতো এই কাগজটা ওর বাংলার নোটস তবু ইচ্ছে করেই ওর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিল! অবশ্য পরে দেবাদৃতা ওকে বলেছিল।
# তুই ফালতু অনি কে কেস খাওয়ালি! ও তাড়াহুড়োতে নোট লিখেছিল তো, হাতের লেখা খারাপ তাই তোকে দেয়নি পরে ফেয়ার করে তোর জন্য রেডি করে রেখেছিল তুই তার আগেই এতদূর জল গড়িয়ে দিলি! পরে পায়েলের খুব খারাপ লেগেছিল! অয়ন কে বলাতে ও বলেছিল।
#ছাড়তো ক্যাবলা ছেলে! ও তোকে ট্রাই করেছিল! বুঝছিস না!এসব ছেলেরা সামনে ভ্যাবলা সেজে থাকে আসলে ভেতরে ভেতরে চিজ! আমারও ওর উপরে হেব্বি ক্ষার আছে! আরে সেদিন তোতন ,স্যার আসার আগে বোর্ডে স্যার ম্যামদের মজার মজার কাটুন আঁকছিল! ক্লাসে ঢুকেই মালটার কি হম্বিতম্বি! কি না টিচার গুরুজন এদের নিয়ে এসব করা ঠিক নয়, এখনই যদি স্যারের চোখের সামনে পড়ে যায়! কি জ্ঞান মারলো মাইরি! তাতে আবার অনেক স্টুডেন্টরা সায় দিল! আসলে মালটার মা দিদিমনি কিনা তাই গায়ে ফোস্কা পড়ে!
# ছাড় তো! একটু ইনোসেন্ট চেহারা,ভালো স্টুডেন্ট,একটু আধটু লেখালেখি করে, ছবি আঁকে, ভালো গান গায় বলে তোর সাথে ওর টক্কর হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স! ভুরু নাচিয়ে পায়েল কথাগুলো বলে অয়নের গায়ে হেসে লুটিয়ে পড়ল! আজ তাই অনির দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পায়েল পারছে না!
#এনি প্রবলেম পায়েল! পায়েলের সামনে চেয়ার টেনে টেবিলটার উপর হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে অনি নরম সুরে বলল।
#কোন প্রব্ থাকলে, তুই আমাকে বিশ্বাস করে শেয়ার করতে পারিস, আমি যতটা পারবো হেল্প করার চেষ্টা করবো!
#অনি মানে, তোকে কি করে বলবো বুঝতে পারছি না, আমার পিরিয়ড হয়ে গেছে, তাই আমি উঠতে পারছি না, এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই ফেলল!
অনি মিনিট পাঁচেক একদম চুপ করে ছিল! তারপর ধীরে ধীরে বলল #কাগজে নামটা লিখে দে আমি সামনের মেডিসিন স্টোর থেকে কিনে আনছি! পায়েল চটপট খাতা থেকে কাগজ ছিঁড়ে নাম লিখে অনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল #তাড়াতাড়ি আনিস, স্যার যখন তখন চলে আসবে!
#আমি সাইকেল নিয়ে যাব আর আসব!
#টাকাটা নিয়ে যা অনি
#আছে পরে দিয়ে দিবি! ঝড়ের গতিতে অনি ফেরত এলো! পায়েল ওকে দেখতে বলল আশেপাশে কেউ আছে নাকি! অনি হোয়াইটট গেঞ্জির উপরে ব্লু শার্ট পড়ে এসেছিল! সেটা খুলে দিয়ে পায়েলের দিকে এগিয়ে দিল! পায়েল ওটা কোমরে বেঁধে নিল, দাগটা দেখা যাচ্ছিল না! বাথরুম থেকে ঘুরে এসে দেখল আলো নিভিয়ে অনি বাইরে ওর জন্য ওর ব্যাগটা নিয়ে অপেক্ষা করছে!
অনির বাড়ি কাছাকাছি তাই ও সাইকেল নিয়ে আসা যাওয়া করে!
#আমি তোকে নেকস্ট ডেতে শার্টটা ফেরত দেবো ! তোকে থ্যাংক ইউ বলে ছোট করবার সাহস আমার নেই, তবে আন্টি কিছু বলবে না তো শার্টটার জন্য!
# আমার মা, আমার মা খুব খুশি হবে আজকে আমি তোকে শার্টটা দিয়েছি বলে! কথাগুলো বলার সময় সদ্য হালকা দাড়ি গোঁফগজানো অনির চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল!
#আচ্ছা আসি হ্যাঁ বাই! সাবধানে যাবি আর ,পৌঁছে একটা কল করে দিস!
#তোর নাম্বারটা দিবি!
# ওকে বলছি! পায়েল সঙ্গে সঙ্গে নিজের মোবাইলে ওর বলা নাম্বারটা সেভ করে নিল! পায়েল অটো ধরার জন্য বড় রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে একবার পেছন ফিরে স্টীট্র লাইটের আলোয় দেখলো অনির সাইকেল চালিয়ে যাওয়া শিল্যুটটার আস্তে আস্তে গলির মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া !
# মিতার কলমে অগ্নি
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।