সাপ্তাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে অমিতাভ দাস (চতুর্থ পর্ব)

কাশী-বিশ্বনাথ

ইতিমধ্যেই আমরা পৌঁছে গিয়েছি সংকটমোচন হনুমান মন্দিরে। লোকশ্রুতি, এখানেই তুলসীদাস গোস্বামী হনুমানজীর দেখা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই মন্দিরটিও তিনিই নির্মাণ করান। প্রতিদিন প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। ড্রাইভার সাহেব বললে, শনি-মঙ্গলবার খুব ভিড় হয়। ভক্তেরা হনুমানজীর সামনে প্রদীপ জ্বালায়। হনুমান চালিশা পাঠ করেন। গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই বহু ভক্ত একাগ্র চিত্তে হনুমান চালিশা পাঠ করছে। আকাশে-বাতাসে ধূপ গন্ধ । দূর থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি। মৃদু স্বরে শ্রদ্ধালু মানুষের কথা। সব মিলিয়ে চমৎকার এক অপার্থিব পরিবেশ রচিত হয়েছে। আকাশে মেঘ। মনে হয় বৃষ্টি নামবে।
আমি কোনো মন্দিরে গেলেই সুযোগ পেলে একবার মন্দির প্রদক্ষিণ করে নিই। এই রকম মন্দির প্রদক্ষিণ বা পরিক্রমা করা নাকি ভালো। অনেক সাধুসন্তের মুখেই শুনেছি। হনুমান মন্দির পরিক্রমা কালে এক ভদ্রলোক হাতের ইশারায় দেখালেন যে আমি ভুল পরিক্রমা করছি। চমকে উঠলাম। সত্যিই আমি ভুল পরিক্রমা করছিলাম। তারপর আমি লোকটির পিছু পিছু মন্দির পরিক্রমণ করতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার কিছু পরেই লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথাও তাকে আর দেখতে পেলাম না। মুহূর্তে লোকটা গেল কোথায়? আমি বহু সময় লোকটিকে খুঁজেছি, পাইনি। লম্বা মতন, ছিপছিপে গড়ন, মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়ি, সৌম্য দর্শন পুরুষ– দেখলেই শ্রদ্ধা জন্মায়। এই ঘটনাটি আজো আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে। যুক্তি দিয়ে এর ব্যখ্যা চলে না। দৈবিক অথবা আধিদৈবিক ব্যাপার বলেছিল কেউ কেউ, ঘটনাটা শুনে।
অনেকটা সময় পেরিয়েছে। আমাদের সকলের বেশ খিদে পেয়েছে। পেটে ছুঁচোর ডন-বৈঠক শুরু হয়েছে । ড্রাইভার সাহেবকে বললাম, একটা ভালো পুরী-সবজির দোকানের সামনে দাঁড় করাতে। তবে তেমন পছন্দসই দোকান পেলাম না।
কিছু সময় পর চলে এলাম বেনারস হিন্দু বিশ্ব বিদ্যালয়ে। বিরাট বড় ক্যাম্পাস। মুগ্ধ হতে হয়। গাড়িতে বসে চলতে চলতে আমার শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ছিল। ঢুকেই দেখলাম মদনমোহন মালব্যের মূর্তি বসানো। দেখে খুব ভালো লাগল। পরিচ্ছন্ন ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। বহু পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। কাশীরাজ প্রভুনারায়ণ সিংহ, দ্বারভাঙার রাজা রামেশ্বর সিং বাহাদুরের আর্থিক সাহায্যে এবং মদনমোহন মালব্যের ঐকান্তিক চেষ্টায় কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত ১৯১৬ সালে। এখানে চমৎকার একটি শিব মন্দির আছে। ২৫২ ফুট উঁচু। সাদা পাথরে নির্মিত । স্থানীয়রা বলেন বিরলা মন্দির। এখানেও সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন দিয়ে শিবকে দর্শন করতে হয়। মন্দির থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল বিরাট পাথরের নন্দীজির মূর্তি। মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরা বালতি বালতি জল ঢালছে নন্দীজির গায়ে। ভক্তরাও সে জলে স্নাত হচ্ছে। নন্দীজির কানের কাছে ফিসফিস করে বলে আসছে তাঁদের অভাব-অভিযোগ ও সমস্যার কথা। এমনটা কাশী-বিশ্বনাথ মন্দিরেও দেখেছি। শুনলাম এটি এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতবড় ক্যাম্পাস ভারতে আর কোথাও নেই।
মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা একটা খাবারের দোকানে গিয়ে বসলাম। এখানে বেশ কিছু ভালো খাবারের দোকান আছে। আমি আমার পছন্দ মতো পাওভাজি আর কোল্ডকফি খেলাম। দুটোর স্বাদ ছিল অসামান্য । আজো সে স্বাদের স্মৃতি লেগে আছে। অন্যরা কেউ ধোসা কেউ পুরী-সবজি খেলো। খেতে গিয়ে এখানে আমাদের অনেকটা সময় কেটে গেল।
পেটকে শান্ত করে আমরা পৌঁছলাম রামনগর ফোর্টে। কাশীরাজের রাজবাড়ি। ওখানে এখনো কাশীরাজের বংশধরেরা বাস করেন। আরেকটা অংশে মিউজিয়াম। কাশীরাজাদের তৈলচিত্র, তাঁদের ব্যবহৃত জিনিস পত্র, পুরোনো দিনের যানবাহন, নানারকম পালকি, বিভিন্ন রকম তরবারি–এই রকম নানা সামগ্রী নাকি মিউজিয়ামে আছে । বিরাট দুর্গ প্রাসাদ । বাইরে বড় বড় দুটি কামান সাজানো। দুর্গ প্রাসাদে ঢোকার মুখে নিরাপত্তারক্ষী। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। আমাদের হাতে ভেতরে ঢোকার সময় ছিল না। ঢুকলে অনেকটা সময় কেটে যাবে। আমাদের সারথি বললে, তাহলে আর সারনাথ যাওয়া হবে না। ফলত, আমরা বাইরেটা এক ঝলক দেখে, ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম রামনগর ফোর্ট থেকে। বাইরে বেরতেই আমার পিতৃদেব একটি লস্যির দোকানে ঢুকে পড়লেন। বললেন, বেনারসের সেরা লস্যি নাকি এই দোকানেই পাওয়া যায়। সেই সেরা লস্যি আমাদের সকলের-ই খাওয়া উচিত। সারথি ভদ্রলোকের সম্মতিও পাওয়া গেল এই ব্যাপারে। যদিও কেউ লস্যি খেল না। বাবা একাই খেলেন। আমি আর মেসো ঘন দুধের মালাই চা খেলাম।

আগামী পর্বে সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।