হৈচৈ ছোটদের প্রবন্ধে অংশুদেব

লোকসাহিত্য আর সৃষ্টি হবে না
লোক সাধারণের বংশ পরম্পরায় অর্জিত সামাজিক জ্ঞান, প্রথা,আস্থা -বিশ্বাস, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ,আচার- আচরণ সব কিছু নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় ,তাই হল লৌকিক সাহিত্য বা লোকসাহিত্য। লোকধারার শুরু কোথায় বলা দুষ্কর । বাঙালি জাতি হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকে লোকধারা চলে আসছে। তবে ভৌগোলিক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য লোকধারায় অকৃত্রিম ভাবে বয়ে চলে । যেমন খাদ্যাভ্যাস,চাল চলন, সামাজিক মেলামেশা, সমাজ কাঠামো, সামাজিক মর্যাদার স্তর বিন্যাস, পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক সম্পর্ক, কিছু প্রথা , রীতি নীতি ইত্যাদি। যেকোনো ভাষা সৃষ্টির আগে থেকেই লৌকিক উপাদানগুলো বংশপরম্পরায় চলতে থাকে । দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভাষাভাষীর ধ্বনি রসায়নে ও অর্থবোধে নতুন ভাষা সৃষ্টি হয়।তাই বাংলা ভাষার লোক সাহিত্য যে বাঙালির সৃষ্টি এ দাবি অমূলক । তবে বঙ্গদেশের লোক সাহিত্য বললে কিছুটা মেনে নেওয়া যায়। দেশ রাজ্য গড়ে ওঠার আগে থেকে ভৌগোলিক অঞ্চল ভিত্তিক জীবন চর্চা শুরু হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক ও মহামারীর কারণে মানুষ পরিযায়ী। কখনো কখনো বহিঃশত্রুর আক্রমণ মানুষ ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে নির্মুল হয় । জীবিকার জন্যও হয় । যেমনটা ঘটেছিল সুন্দরবন অঞ্চলে এখনও ঘটছে।
লোক সাহিত্য হতে গেলে অনেক কিছু প্রায় এক রকম হতে হবে। যেমন (১) অর্থনীতির ভিত্তি এক এবং বন্টন বৈষম্য, (২) শাসন কাঠামো স্পষ্ট, (৩) শ্রেণী বিভক্ত সমাজ, (৪) উচ্চ শ্রেণীকে মান্য করার প্রবণতা, ( ৫) সর্বজন স্বীকৃত প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই , (৬) লড়াইয়ে নায়কের জয়, (৭) অলৌকিকত্বে বিশ্বাস,(৮) যুক্তি তর্ক গুরুত্ব লাভ করবে না ,(৯) পরিশেষে একটা শিক্ষা থাকবে ইত্যাদি । নিচে তেমন একটা রূপকথার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করা হল ।
এখানে “নির্মল বুক এজেন্সী” থেকে প্রকাশিত উজ্জ্বলকুমার দাস সম্পাদিত ” ঠাকুমার ঝুলি” -র একটা গল্পের সংক্ষিপ্ত রূপ।
রূপকথা : সুন্দরী পুষ্পবতী
এক দেশে এক রাজা ছিলেন, তাঁর ছয় রানি। কিন্তু রাজার মনে শান্তি নেই। কেননা তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। একদিন এক সন্ন্যাসী তাঁর রাজ দরবারে এসে রাজার মনে অশান্তি দূর করার জন্য আরও একটা বিয়ে করতে বলেন। শুরু হলো রাজার উপযুক্ত পাত্রীর খোঁজ। এদিকে সেই রাজার রাজ্যে মহামন্ত্রী, রাজপুরোহিত ও প্রধান সদাগরের মেয়ের সঙ্গে এক ভিখারিনীর মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। তারা একজায়গায় বসে গল্প করছিল তার সঙ্গে যার বিয়ে হবে , তার কি কি উপকার হবে। শেষে ভিখারীনির মেয়ে বলল , আমার বিয়ে হলে যমজ সন্তান হবে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটা কপালে রাজটীকা আর হাতে থাকবে শুকতারা চিহ্ন। মেয়েটা হবে অপরূপা সুন্দরী। সেই কথা আড়াল থেকে রাজার লোক শুনে রাজাকে জানাল । রাজা সেই ভিখারীনির মেয়েকে বিয়ে করেন । কিছুদিনের মধ্যে ছোটরানি সন্তান সম্ভবা হলেন। এই সময় দূর দেশে বিশেষ কাজের প্রয়োজনে চলে যেতে বাধ্য হলেন । যাবার সময় ছোটরানিকে একটা সোনার ঘন্টা দিয়ে যান । সন্তান প্রসবের সময় সেটা বাজালে রাজা ঠিক শুনতে পাবেন ।এই কথাটা বাকি ছয় রানি শুনতে । তারা এবার ছোট রানি রাজার চক্ষুশূলে পরিণত করার জন্য ভুল বুঝিয়ে দুবার ঘন্টা বাজিয়ে রাজাকে নিয়ে আসে। তাতে রাজা ছোটরানির প্রতি ক্ষুব্ধ হন । এদিকে সন্তান প্রসবের সময় ঘন্টা বাজালেও রাজা আসেন না । ওদিকে ছয়রানি দাইকে ডেকে এনে প্রসব করাবার পর দুটো বাচ্ছাকে সরিয়ে দুটো কুকুর ছানা রেখে আসে ।আর দাইকে বাচ্ছা দুটোকে মেরে ফেলার দায়িত্ব দেন ।দাই তাদের না মেরে এক কুমোরের মাটি হাঁড়ির ভেতর রেখে আসে । সেই মাটির হাঁড়ি পোড়াতে এসে তারা দুটো ছেলে ও মেয়েকে পেয়ে যান। তারাই বাচ্ছা দুটোকে পালন করেন । কিন্তু কুমোর ও তার স্ত্রী বেশিদিন বাঁচলেন না । বোনের দায়িত্ব এসে পড়ল দাদার ওপর । সে জঙ্গলে পশু শিকার করে বাঁচার উপায় খুঁজে নেয় । একদিন একটা শূকর শিকারের জন্য ঘোড়া ছুটিয়ে যাবার সময় রাজার চোখে পড়ে ছেলেটার কপালে রাজটীকা। ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না । খুব মন খারাপ । প্রাসাদে ফিরে ছয় রানিকে কথাটা জানান । রানিদের সন্দেহ হয় ,তারা দাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করে। সে অস্বীকার করে । কিন্তু সত্যটা জানার জন্য কুমোরের বাড়িতে যায় । সেখানে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়েকে দেখতে পায় । তার সঙ্গে আলাপ করে মেয়েটা রূপের প্রশংসা করে বলে তোমার দাদাকে কেতকী ফুল এনে দিতে বলো, তাহলে আরো সুন্দর দেখতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে? সাত সমুদ্র পাড়ে রাজকন্যা পুষ্পবতী থাকে ,সেই কেতকী ফুলের সন্ধান জানে । দাদার কাছে আবদার করতে সে বেরিয়ে পড়ল । রাক্ষসদের সন্তুষ্ট করে রাজকন্যা পুষ্পবতীর সন্ধান পায়। সেই রাজকন্যাকে উদ্ধার করে এবং কেতকী ফুল নিয়ে ছেলেটা বাড়ি ফেরে। বোনের খুব আনন্দ । এদিকে রাজকন্যা ছেলেটার হাত শুক্রবার ও কপালে রাজটীকা দেখে রাজকন্যার সন্দেহ হয় ।সে তখন তাদের রাজাকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা বলে। সেই মতো বনের মধ্যে আবার রাজার সঙ্গে দেখা হল । ছেলেটা রাজাকে তাদের বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করে। রাজা রাজি হয়ে যায় । পরের দিন রাজা এলে রাজকন্যা তাঁকে ছেলে ও মেয়েটা জন্ম বৃত্তান্ত শোনালে রাজা রেগে ছয় রানি এবং দাইকে চরম শাস্তি দেন । ছোট রানিকে প্রাসাদে নিয়ে আসে ছেলে, মেয়ে ও পুষ্পবতীকে পুত্র বধূ করে সুখে বাকি জীবন কাটায় ।
এই রূপকথার মধ্যে যে লক্ষণগুলো রয়েছে তার নিম্নরূপ ।
(১) ছয় রানি কিন্তু বংশে প্রদীপ জ্বালাবার কেউ নেই। ( বহু বিবাহ পুত্র সন্তান কামনায়)
(২) জটাধারী সন্ন্যাসীর আগমন।( দৈব বিশ্বাস)
(৩) সন্তান বা পুত্রলাভের উদ্দেশ্য বিয়ে। ( যৌন বাসনা)
(৪) ভিখারিনী অপরূপ সুন্দরী কন্যা। ( নিম্ন শ্রেণীর সম্পদ )
(৫) ভিখারিনীর কন্যার সঙ্গে মহামন্ত্রী, সওদাগর, রাজপুরোহিত কন্যার বন্ধুত্ব ।( কল্পিত সমাজিক সমন্বয় )
(৬) অলৌকিক ক্ষমতা। ( যা বাস্তব নয়,অথচ চাহিদার মতো)
(৭) অবিবাহিতা কন্যাদের স্বামী চিন্তা। ( সুপ্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা। দেহ সুখ নয় জীবন সুখ ভোগ )
(৮) রাজার অনুচর বা গুপ্তচর। ( খবর সংগ্রহ)
(৯) রানিদের চক্রান্ত । ( মেয়েলি হিংসা।এর অন্তরালে আছে সতীন জনিত অবহেলা, বঞ্চনা )
(১০) ভুল বোঝাবুঝি জনিত দুর্ভোগ। ( এটি সাধারণত আমোদ বা কৌতুক থেকে সৃষ্টি হয়)
(১১) সন্তান বা ওই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চক্রান্ত মূলক বদল। (সমস্যার মূল কারণ)
(১২) চক্রান্তে চাকর বা চাকরানীর ভুল পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া। ( পরিত্রাণের ক্লু যা দৈব সংযোগ মূলক )
(১৩) দ্বিতীয় স্তরের সূত্রপাত। বিপর্যস্ত বালক বা বালিকা বা ব্যক্তির সমস্যা মুক্তির উপায়। ( সমস্যা সঙ্কুল জীবন থেকে অব্যাহতি পাবার কল্পিত পন্থা)
(১৪) নির্দোষ ব্যক্তির শাস্তি। ( অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগ। এটা কিন্তু সেই ব্যক্তির সামান্য ভুলের খেসারত। )
(১৫) চক্রান্তের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয়। ( দুর্ভোগ কাটিয়ে ওঠার কল্পিত উপায়। তবে অবাস্তব নয় , সম্ভাবনা মূলক )
(১৬) মিলন প্রক্রিয়া শুরু। ( প্রত্যাশা পূরণের পথ বা পথের আভাস )
(১৭) স্মারক বা চিহ্ন হয়ে ওঠে পরিচয়ের মাধ্যম । ( শকুন্তলাকে দেওয়া দুষ্মন্তের আঁটি যেমন)
(১৮) চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়া । (দোষী প্রমাণ ও শাস্তি )
(১৯) চক্রান্ত চাপা দেওয়ার জন্য তৃতীয় স্তরের গল্প শুরু হতে পারে বা হয়। কেননা প্রমানের একটা প্রসঙ্গ এসে পড়বেই এবং তা যুক্তিসম্মত হওয়া চাই। এখান থেকে গল্পের নায়ক অথবা নায়িকার আবির্ভাব ঘটে। ( মানুষের মধ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করার বাসনা এখান থেকে শুরু)
(২০) প্রতিকূল পরিবেশ এবং সংগ্রাম। ( মনের গভীরে সুপ্ত বীরত্ব মূলক বাসনা এবং বুদ্ধি কৌশল প্রয়োগ)
(২১) বীরত্ব প্রকাশের চূড়ান্ত পর্যায় । যেখানে সাফল্য লুকিয়ে। সেটা দুর্গম ও রহস্যময় । এটাই শেষ পরীক্ষা ।( সহজ প্রাপ্তির মধ্যে পৌরুষ নেই। মানুষ তা চায় না। সে চায় বীরত্বের মর্যাদা। তাই করুনা ,দয়া, সাহায্য ছাড়াই নায়ককে এগিয়ে নিয়ে যায়। সুপ্ত মনের বাসনা।)
(২২) লক্ষ্য পূরণ ( যে উদ্দেশ্য যাত্রা তা সফল ,তার সঙ্গে প্রাপ্তি । বেশিরভাগ রূপকথায় রাজকন্যা লাভ। সিনেমাতে নায়ক নায়িকার মিলন দেখানো হয়। এই মিলনটা জৈবিক। যদি জৈবিক না ভাবি তাহলে সাধনার ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ বা ঈশ্বর লাভ। বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার। )
(২৩) সত্য উদঘাটন । ( চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে পড়বেই। সাধারণত হয় না। তা চাপা পড়ে যায় এই গণতান্ত্রিক শাসনে । রাজতন্ত্রে তা বেরিয়ে পড়ত এবং চক্রান্তকারীরা সাধারণত পরাজিত হোক এটা লোকের মনের চাহিদা। বাস্তবে চক্রান্তকারীদের জয় হয় ।)
(২৪) মিলন ।( মানুষ কখনো বিচ্ছেদ চায় না বলেই লোককথায় সার্বিক মিলন দেখানো হয়। আধুনিক সাহিত্য প্রেম বা কীর্তি স্মরণীয় করার জন্য বিচ্ছেদ গুরুত্ব লাভ করে — বড় প্রেম কেবল কাছে টানে না,দূরেও ঠেলে দেয়। পদাবলী সাহিত্যে তাই মথুরায় গমনের পর কৃষ্ণ রাধার কাছে ফিরে আসেনি। কোনো খোঁজ খবরও নেয়নি । এটাই বাস্তব ।)
প্রাচীন সাহিত্য বা কথা সাহিত্যে কতকগুলো সাধারণ উপাদান থাকে । তখনকার সমাজ ছিল পুরুষ তান্ত্রিক বলেই রাজা কিম্বা গৃহকর্তা প্রাধান্য পায়। রাজপুত্র কিম্বা কোনো পুত্র নায়ক হয়ে সমস্যা দূর করে। মা বা রানি বা রাজকন্যা বা সাধারণ কন্যা অবহেলিত। তাই তাদের মধ্যে থেকে চক্রান্ত উঠে আসে। নয়তো লোভী কোনো বহিরাগত চক্রান্ত সৃষ্টিকারী প্রতিপক্ষ শয়তান রূপে আবির্ভূত হয় । এটাই মূল সংঘাত । অবশেষে নির্দোষ জয়ী হয় । এটাই রাজতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন কাঠামো তাই ওই সময়ের লোক সাহিত্য বা কাহিনীগুলো সব প্রায় ওই ধরনের। গণতান্ত্রিক শাসন কাগজে কলমে ঘোষিত হলেও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় চলছে রাজতান্ত্রিক শাসন। তাই পরিবার বা কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানে আধুনিক মানুষ গণতান্ত্রিকও দেখতে পাচ্ছে না, রাজতন্ত্রও দেখতে পাচ্ছে না, সবটাই যেন সামন্ততান্ত্রিক। তাই এ যুগে লোকসাহিত্য ঠিক মতো গড়ে উঠলেও লোক মনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। পরিবারে বাবার স্থানটা রাজা বা সামন্ত প্রভু বা মালিক । সংসারে চক্রান্তকারী কে মা না পিসি না ঠাকুরদা ঠাকুমা না বাবার ভায়েরা না প্রতিবেশী না রাজনৈতিক দল — চক্রান্তকারী শয়তানের অস্তিত্ব অনুভব করলেও তাকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। Aim বা লক্ষ্য অনির্দিষ্ট। আমরা বেশিরভাগ মানুষ সমস্যা বোঝার আগে সমস্যায় জড়িয়ে থাকি । সেই নাগপাশ ছিঁড়ে বের হবার আগে আরও সমস্যা। শেষপর্যন্ত যা হোক গোছের জীবন নিয়ে বিয়ে থা করে গলা পর্যন্ত পাঁকে হাবুডুবু খাওয়া । তাই আমরা কখনো রোমান্টিক, কখনো অ্যাকশন মুভি পছন্দ করি । আগে দেবদেবীর সিনেমা জনপ্রিয় হত, তারপর রোমান্টিক প্রেম, এখন থ্রিলার খুব জনপ্রিয় । তার মনস্তাত্ত্বিক কারণ মানুষ প্রতিকার মুখী কিন্তু সঠিক পথ বা পন্থা খুঁজে পাচ্ছে না।
যেকোনো সাহিত্য রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ , রূপকথা বা পশুকথা আগে লোক অভিজ্ঞতা অর্জিত বানানো লোক কথা বা কাহিনী, তারপর সাহিত্য।
মানুষ থাকলেই লোক হয় না। লোক হল একটা ব্যবস্থার সামগ্রিক লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত জনগণ। এই ব্যবস্থা বলতে বোঝায় একটা সময়ের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো, সামাজিক সহবস্থানের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি , বিশ্বাস ও শিক্ষা । রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শাসন ব্যবস্থার বহু ধরণ এসেছে — গোষ্ঠীপতি, দলপতি, সর্দার, মণ্ডল,রাজা, সামন্ত, জমিদার থেকে দলতন্ত্র। অনেক ধরণ হলেও সামাজিক বিন্যাসের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। একজন শাসক সর্বোচ্চে, তাকে পরামর্শ দেবে একজন বা কয়েকজন, সর্বোচ্চ শাসককে শাসন কার্যে সাহায্য করবে কয়েক জন এবং তাদের ক্রম নিম্ন স্তর বিভাজন থাকবে। শাসকের রাজ্য রক্ষার জন্য থাকবে যোদ্ধা বা সৈন্য আর আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলার জন্য পুলিশ বা পেয়াদা। শাসকের ঘনিষ্ঠ আর্থিক সাহায্য ও সহায়তাকারী কিছু বণিক থাকবে । সমগ্র সমাজের সেবার জন্য থাকবে মেথর , চাষী , কুমোর,কামার ,জেলে , ঘরামী/রাজমিস্ত্রি,ছুতোর, ডাক্তার প্রমুখ। এইসব শাসনতান্ত্রিক ও সামাজিক কাঠামোয় সামাজিক সম্পর্কের রূপটা ভিন্ন । সেখানে চার ধরনের মানুষ থাকবে – উপকারী,অপকারী, উদাসীন এবং অসহায়। অসহায়দের দলে টানার জন্য সেই আদিম যুগ থেকে উপকারীর সঙ্গে অপকারীর লড়াই চলে আসছে ।
কৃষি অর্থনীতিতে যে সামাজিক মূল্য , আদর্শ , নৈতিকতা, শিক্ষা,শাসন- শোষণের ধরণ ও সামাজিক সম্পর্ক, আশা , প্রত্যাশা, প্রতিবাদ গড়ে উঠে ছিল; তার ভিত্তিতে লোককাহিনী, লোক কথা ও সাহিত্য, মহাকাব্য, পুরাণ গড়ে উঠেছে। সেই সময়ের জনগণের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার ভিত্তিতে উক্ত কথা ও কাহিনীগুলোর সৃষ্টি । কৃষি থেকে শিল্পে পরিবর্তন পর্যন্ত পুরাতন সমাজ মানসিকতা, সম্পর্ক ও সংস্কৃতিগুলো বজায় ছিল । অর্থনীতি যখন সম্পূর্ন শিল্প নির্ভর হয়ে পড়ল সর্বপ্রথম আঘাত এল মানুষের নিজের মনে – নির্বিচারে মেনে নেওয়ার স্থলে আবির্ভূত হল যুক্তি , যুক্তি হাত ধরে এত বাস্তবতা, বাস্তবতার পথ ধরে এল মনস্তত্ত্ব। বদলে গেল মানুষের মন ও রুচি । ভেঙে পড়ল শাসনতান্ত্রিক ধরণ। ক্ষমতার হস্তান্তর। পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ থেকে রাজা,রাজা থেকে সামন্ত ,সামন্ত থেকে জমিদার, জমিদার থেকে বণিক, বণিক থেকে রাজনৈতিক নেতা বা দল ।
ইতিমধ্যে শিল্প অর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতিতে। শাসন কাঠামো না বদলালেও শাসক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে গেছে । আগে রাজা রানি রাজপুত্র বা রাজকন্যাদের চোখে দেখা সাধারণ মানুষের কয়েক জন্মের সৌভাগ্য ছিল। এখন যিনি মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী,বা রাষ্ট্রপতি, তিনি একটা সময় ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিলেন। তাকে ভালো মতো চিনি কিন্তু এখন চিনতে পারি না । এই এখন আর তখনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। তখন রাজা বা রাজপরিবার , এমনকি রাজকার্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ধারে কাছে যাওয়া যেত না, মানুষ যেতেও চাইত না । এই মানুষগুলোর অস্তিত্ব আছে কিন্তু চোখে দেখা যায় না, এরফলে তাদেরকে নিয়ে নানান গল্পকথা এবং কাহিনী গড়ে উঠবে স্বাভাবিক। তখন দেব দেবী শয়তান রাক্ষস পিশাচ এইসব কল্পিত শ্রেণীর ধারণা গড়ে উঠেছিল । তাই ভালো বলতে দেবতা তূল্য, আর শয়তান বলতে ঘৃণ্য অসামাজিক । কৃষি নির্ভর অর্থনীতির যুগে শয়তান শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটত। তাই হয়তো শয়তান,অত্যাচারী, শোষক, হিংস্র, নিষ্ঠুর, নির্মম চরিত্র সম্পর্কে সেকাল ও একালের লেখকদের লেখনী এত ধারালো ।
কি লোক সাহিত্যে, কি কথা সাহিত্যে ভালো চরিত্রগুলো আজো কাল্পনিক মনে হয়। মহাকাব্য,পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্যে একটাও চরিত্র বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা ভারতীয় সমাজ উদার বৈষম্যহীন খোলামেলা ছিল না । বরং আজকের দিনে ইউ টিউবে কিছু সর্ট ফ্লিম ও সিরিজের চরিত্রগুলো বাস্তব মনে হয়। বিশেষ করে যে চরিত্রগুলো ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাদানের সমন্বয়ে দেখা যায়। যাইহোক লোক সাহিত্যে যত প্রকার চরিত্র দেখা যায়, সেই সব চরিত্র সেই সময়ে সেই সমাজে ছিল । শিল্প বিপ্লবের পর থেকে চরিত্রগুলো কিছুটা পরিবর্তিত হল । রাজা, সামন্ত প্রভু, জমিদার হল মালিক ।নায়েব হল ম্যানেজার, তোষামোদকারীর দল হল দালাল। নতুন চরিত্রের উদ্ভব ঘটল ইউনিয়ন লিডার ও ইউনিয়নের সদস্যরা । এরা শুধু পরভোজী নয় পরশ্রমভোগী এবং উপরি আয়ভোগী। মালিকের পরেই এরা ক্ষমতার অধিকারী। ওদিকে রাজা না থাকলে রাজ্য আছে,প্রজা না থাক ভোটদাতা জনগণ আছে। জনগণের ভোটে যে দল সরকার গঠন করে তার প্রধান হল মুকুটহীন রাজা। তার দলের নেতা, মন্ত্রী,এম এল এ, সাপোর্টার সকলে হুকুম জারি ও কৈফিয়ৎ নেওয়ার অধিকারী । এরাও অচেনা প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত নতুন চরিত্র । এদের সামাজিক পরম্পরা নেই। ভাই মানে তো রামের ভাই ( কৃষি অর্থনীতিতে) , শিল্প অর্থনীতিতে ভাই মানে বিয়ের পর ব্যবসার অংশীদার। প্রযুক্তির যুগে পরিচিত প্রতিদ্বন্দ্বী। আত্মীয় স্বজন সেই যুগে মা বাবার বিকল্প ছিল, শিল্পের যুগে শুভাকাঙ্ক্ষী শুভানুধ্যায়ী , প্রযুক্তির যুগে পরিচিত আকস্মিক আত্মীয়। বিনিময় সম্পর্কে সামাজিক পরিবেশীরা নানান অস্থায়ী আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকত । তাদের বহিঃপ্রকৃতি ও মনোপ্রকৃতি সবটাই প্রায় ধরা পড়ত। তাই লোক সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণে অসুবিধা হত না। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানুষ ক্রমশ বিষয়ী হতে শুরু করল ।শহর ও গ্রামের মানুষের পার্থক্য সৃষ্টি হতে থাকল । চাষী , শ্রমিক, শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল সব পৃথক মর্যাদায় ভেঙে যেতে থাকল । অভিজাতদের মধ্যে উচ্চ মধ্য নিম্ন ভেদ দেখা দিল। অনভিজাতদের মধ্যে আরো ক্লাস ভাগ হতে থাকল। রাজনীতিটা অভিজাতদের অধিকারে চলে গেল । সেখানে যার যত লোকবল পার্টিতে তার গুরুত্ব ততখানি। ভালো মন্দ, শিক্ষিত অশিক্ষিত এসব বাদ বিচার নেই । অথচ শাসন ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা এবং দাপট রাজতন্ত্রের মতো সামন্ততান্ত্রিক ।
দল সরকারি ক্ষমতায় থাকলে রাতারাতি রাজা হয়ে বিশ পঁচিশটা রেফ , পাঁচ দশটা খুন করলে পার্টি ঠিক বের করে নেবে। এখানে মানুষের চরিত্রকে বিশেষ কোনো ভাবে ভাগ করা যায় না। ছেলে বাবাকে টাইট দিচ্ছে, বাবা ছেলেকে। স্ত্রী থাকার সত্ত্বেও পরকীয়া।আগে সেটা ছিল পুরুষদের একছত্র, এখন মহিলাদের আধিপত্য দ্রুত বাড়ছে । ( অবশ্য এটা ভালো যৌন সঙ্গী অপেক্ষা মনোসঙ্গী বৃদ্ধি। ) আগে সমাজ ছিল মুখোমুখি সম্পর্কের। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে তা কমে আসতে থাকলো। দেখা দিল উৎকট স্ট্যাটাস মেনটেন রোগ। মানুষের সঙ্গে নিজের দূরত্ব বাড়ানোর বদ অভ্যাস। আড্ডা মারা , গল্প করা শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতিতে কমতে থাকল। পরিবর্তে অর্থ আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমণ দেখা দিল। প্রযুক্তির যুগে এসে আত্মীক ও সামাজিক সম্পর্ক লোপ পেতে থাকলো । এটা অনেক বেশি যন্ত্র নির্ভর প্রয়োজন ভিত্তিক সম্পর্কের যুগ।
এখন অনেক গল্প কিন্তু কোনো গল্প সার্বজনীন নয়। যেমন আমার এই মত কেউ গ্রহণ করবে কিন্তু বেশিরভাগ জন বিরোধীতা করবে। কেননা এখন আর সাধারণ বলে কিছু নেই, সব বিশেষ এবং বিশিষ্ট । যেমন জনৈক ট্রাক একটা শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি হতে বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ লেগে গেল। তিনি একটা যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হলেন, তাঁর নির্দেশে যুদ্ধ স্থগিত বা সিজ ফায়ার হল দাবি করছেন, কেননা তিনিই নোবেল শান্তি পুরস্কারের একমাত্র দাবিদার। তাঁর নাম প্রস্তাব করেন যে নাকি হিন্দু নিধনের মাস্টার মাইন্ড । হয়তো ট্রাক নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন । যে দলের আমলে ল কলেজে গণধর্ষণ হয় , সেই দলের নেতারা গলা ফাটায় এই রাজ্যের মতো অন্য কোথাও ল এন্ড অর্ডার মাফিক শাসন দেখা যায় না। যে রাজ্যে বেশিরভাগ স্নাতক কোনো ভাষাই ভালো পড়তে পারে না, সেই রাজ্যের ইউনিভার্সিটি শিক্ষামানে দেশে প্রথম হয় । যে ব্যক্তির নাম শুনলেই ছাত্র ছাত্রীরা গালাগাল ভাষা, মনস্তত্ত্ব, মূল্যবোধ, সংগ্রামদেয় তিনি সেরা শিক্ষকের পুরষ্কার পান। কোনো কিছুই যেখানে সাধারণী নয় , সেখানে লোক সাহিত্য বা সঙ্গীত সার্বজনীন হতে পারে না।