।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অপরাজিতা চিত্রলেখা ঘোষ

বিভাবরী

তখন তার হাতে সর্বক্ষণ টুং- টাং করত চুড়ি।আমার সকালের ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে দিত ঐ চুড়ির আওয়াজ। খুব বিরক্ত লাগত।তবু আমার কাছে তখন সকাল নিয়ে আসত টুং-টাং চুড়িগুলো, এক কাপ চা হাতে, নরম রোদ্দুর মেখে।
“এই সব গয়নাগাটি কেন যে পরো তোমরা মেয়েরা?”
“সে তুমি বুঝবে না। এগুলো আমাদের এয়োস্ত্রী হবার চিহ্ন”
হ্যাঁ, এয়োস্ত্রীর সব চিহ্নই ভারি যত্ন করে বহন করত সে।সিঁথিতে লম্বা সিঁদুর, কপালে চাঁদের মত টিপ, দু হাতে শাঁখা, পলা, চুড়ি—–
সাদা রঙ আমার বরাবর পছন্দ। একবার শখ করে একটা সাদা রঙের ঢাকাই কিনে দিয়েছিলাম। একবারও অঙ্গে তোলে নি সে। সরিয়ে রেখেছিল আলমারির এক কোনায়। তার কাছে সাদা ছিল বৈধব্যের রঙ।
আমি বলতাম, “এসব কুসংস্কার তোমার”
সে বলত, “তাহলে তা-ই। আমি সাধারণ মেয়ে। আমার সবকিছুই সাধারণ। তোমার যাতে মঙ্গল হয়, তার জন্য আমি সব করব”
“সাদা শাড়ি পরলে কারো বর মরে না”
“চুপ করবে? সাদা শাড়ি ধ্বংস হোক্। জীবনে কক্ষনো যেন পরতে না হয় আমায়”
দিনটা ছিল চৈত্র মাসের শেষ দিন। আমাদের ছোট্ট এক কামরার সংসারের কাছেই ছিল ছোট একটা আইসক্রিম পার্লার। ওখান থেকে একটা চকলেট আইসক্রিম কিনে এনে বিভার হাতে দিয়ে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে বিভা হঠাৎ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা তুমি আমাকে সত্যি ভালবাসো?”
আমি জবাব দিলাম না। তখন বিভার সব কথার জবাব দেওয়া আমি জরুরি বলে মনে করতাম না। ব্যস্ত রইলাম ফেসবুকে।
সে আব্দার করল, “এই শোনো না!”
“কাজ করছি বিভা”
“একবার শোনো”
“আচ্ছা বলো কি হয়েছে?”
“তুমি আমাকে সত্যি ভালবাসো?”
“রাস্তায় মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে হবে?”
বিভা জবাব দেয় না। তার চোখ দুটো খুব শান্ত হয়ে যায়। আমি কখনো তাকে ‘ভালবাসি’ বলিনি। কখনো নয়। তার শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে বলি, “তুমি তো জানো আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না”
“যদি থাকে, বোঝা যায়”
“তাহলে, বুঝেই নাও”
এর কিছুকাল পরে আমি বেছে নিয়েছিলাম নিজের পথ।একদিন খুব ভোরে ঘুমন্ত বিভাবরীকে ফেলে রেখে, এক কামরার সেই ঘরে আমাদের লাল-নীল সংসারকে ফেলে রেখে, আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের ছেলে ফিরে গিয়েছিলাম ঘরে। মোবাইল ফোনের সিমকার্ড বদলে ফেলেছিলাম। আমার বাড়ির ঠিকানা বিভার জানা ছিল না।
দরজার কলিং বেল-এ চাপ দিয়ে অপেক্ষা করছি। এত বছর বাদে আমি আবার তার দরজায়। দরজা খুলল বিভা। আমি তাকিয়ে দেখি তার দিকে। নাহ্, তার হাতে কোনো চুড়ি নেই।কপালে চাঁদের টিপও নেই।কেবল সেই কোমর ছাপিয়ে নামা চুলগুলো আছে।বিভাবরী আমাকে দেখে চমকে উঠলো না। তীব্র কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তার। যেন জানাই ছিল যে একদিন না একদিন আমি ঠিক এসে দাঁড়াব তার দোরগোড়ায়। যে চোখ গুলো আমাকে বছরের পর বছর ঘুমোতে দেয়নি, সেই চোখ দুটোকে শেষ একবার দেখার জন্য আমাকে যে আসতেই হতো।অথচ আমি মূর্খ, তখন ভাবতাম, এই মেয়েটার শরীরটাই আমি চাই।ভালবাসা-টালবাসা আদতে কিছু নয়।
খুব সহজ ভঙ্গিতে দরজা ছেড়ে বিভা সরে দাঁড়ায়।আমি ভেতরে ঢুকি। ছিমছাম বসার ঘর। বিভাবরীর মতই গোছানো আর সাধারণ।
“চা খাবে?” বহুদিন বাদে তুমূল বর্ষনের মত রিমঝিম করে বাজল তার কন্ঠস্বর।
আমি ইশারায় “হ্যাঁ” বলে একটা বেতের চেয়ারে বসে এক বুক স্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করি চায়ের। মনে হচ্ছে যেন বহুকাল বাদে ফিরে এসেছি ঘরে, নিজের ঘরে। স্ত্রী-পুত্র পরিবার সহ নিজের আসল বাড়িটাকে তো কখনও এত আপন মনে হয় না!
“চিনি কতটা দেব?”
“ঐ আগের মতই”
আমার চায়ের কাপে চিনি মিশলো দু চামচ। মনে রেখেছে বিভাবরী।
“বিয়ে করেছ বিভা?”
“তুমি জানো না?”
“না, জানি না। জানার চেষ্টা করিনি। তোমার বিয়ের খবরে আমি খুশি হতাম না”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই।খুশি হতে না কারণ আজীবন তুমি আমাকে তোমার একটা জিনিস ভেবেছ।আর জিনিস হাতছাড়া হলে কার ভালো লাগে!”
“এটা সর্বাংশে ঠিক নয়”
“এটাই সর্ব অংশে ঠিক। জিনিস ভেবেছ বলেই ইচ্ছে মত ফেলে রেখে পালিয়ে গেছ” বিভাবরী সরাসরি আক্রমণ করে আমাকে।
“সম্পূর্ণ ঠিক হলে কি আর ফিরে আসতাম?আবার তো ফিরে এসেছি তোমার দরজায়”
“ফিরে এলেই কি সব ঠিক হয়ে যায়?”
“আমি তোমাকে ভালবাসি বিভা” আমি বলে ফেলি একটুও দ্বিধা সংকোচ না করে।“আর এটা বুঝতে আমার গোটা জীবন লেগে গেল। তুমি বিশ্বাস কর, আমি কখনও তোমাকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি”
“এটা কি খেলা? কখনো না জানিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলে ভালবাসনা বলে! কখনো ফিরে এসে বললে ভালবাস!” তীব্র একটা তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে তার চোখে, মুখে, ঠোঁটের বাঁকে।সে আরও বলতে থাকে,”তুমি, তোমাদের মত পুরুষেরা জীবনে কারো হতে পারবে না।তুমি আমার হওনি, যে মেয়েটাকে বিয়ে করে স্ত্রী বানিয়েছ, তার হওনি,অগুনতি প্রেমিকাদের হতে পারো নি, এখন আবার এসেছ আমার হতে?”
“এসেছি, কারণ আমি জানি তুমি কারো হওনি।জেনেছি যে তুমি আজও একা।এসেছি, কারণ আমি জানি যে তুমি এখনো আমার, অন্য কারো নও”
হঠাৎ সে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে।হৃৎপিন্ডে ঝংকার তোলা হাসি।
“‘যদি বলি,আমি অন্য কারো, কিংবা অন্য অনেকের, তোমার বন্ধুদের, কেমন লাগবে মিস্টার শুভব্রত মজুমদার?আমার জন্য তোমার এই সুগভীর ভালবাসা আবারো নেই হয়ে যাবে তো?”
ধুকপুক করে ওঠে হৃদযন্র সহ গোটা শরীর।
“মানে?”
“মানে খুব সহজ। যে এক কামরার ঘরে আমরা লাল-নীল সংসার পেতেছিলাম, সেটা তোমার বন্ধুরা চিনত। কত এসেছে সবাই, কত আড্ডা হয়েছে। কত রেঁধে খাইয়েছি সবাইকে ! তুমি আমাকে কিছু না বলে, না জানিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলে।আমি পাগলের মত তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি।।একটা মানুষও তোমার ঠিকানা দেয়নি কিংবা দিতে চায়নি—আমি মাসের পর মাস ঐ বাড়িতে বসে অপেক্ষা করেছি, তোমার ফিরে আসার—“
তার হাত দুটো আমি নিজের হাতের মধ্যে নিই, “এসব আমি জানি”
“যেটা জানো না সেটা তাহলে শোনো! একদিন সন্ধ্যায় তোমার চার বন্ধু এল। তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চার বন্ধু।এসে বলল, তোমার খোঁজ পেয়েছে ওরা। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেবে তোমার, তারপর—–”
“তারপর?”
“তারপর তোমার বন্ধুরা ভাবনা-চিন্তা করে দেখল, তোমার খেয়ে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার ওরা একটু ভাগাভাগি করে খেলে তেমন অন্যায় কিছু হবে না। আমি তো নষ্টই।তুমি আমাকে নষ্ট করে রেখে গেছ। ওরা আর নতুন করে কি নষ্ট করবে!বেবুশ্যে না হলে কি আর তোমার সঙ্গে থাকতাম ওভাবে?”
“কি বলছ এসব তুমি?”
“ঠিকই বলছি। তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা, যাদের সঙ্গে এখনো প্রতিদিন তোমার ওঠা-বসা — সন্দীপ, রনিত, বিভাস, মৈনাক—- দুদিন ছিল ওরা, এক কামরায়, একসঙ্গে সবাই। একসঙ্গে চারজনে মিলে আমার শরীর নিয়ে খেলেছে। তারপর, যখন সাধ মিটেছে, চলে গেছে”
“তুমি পুলিশের কাছে যাও নি?”
“কি লাভ হত গিয়ে? পুলিশও আমাকে সেটাই বলত, যেটা তোমার বন্ধুরা বলেছিল, –‘বেশ্যা’ তোমার সঙ্গে এক ছাদের নীচে ঘর পেতেছিলাম, পুতুল খেলার বিয়ের ঘর নয়, ভালবাসার ঘর। পুলিশ কি সেই ভালবাসার ঘর বুঝত?।তোমার বন্ধুরা তো বোঝেনি! তুমি নিজে কি বুঝেছিলে?”
নিজের অজান্তেই আমার হাত দুটো ছেড়ে দেয় তার হাত।চোখের সামনে কেবল কল্পনা ভাসে। ‘কি কি করেছিল ওরা বিভাবরীর শরীরের সঙ্গে! আমার বিভা আর আমার নেই! দশটা পুরুষ ছিঁড়ে খেয়েছে তাকে—-” অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠে তার হাতটা ছেড়ে দিই।
ছেড়ে দেওয়া নিজের হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বিভাবরী, “যাও, তুমি যাও। আমার হাত ধরার মত পুরুষ তুমি নও।কখনো ছিলে না। ফিরে যাও নিজের স্ত্রীর কাছে। অন্ততঃ একজন মেয়ের কাছে তো বিশ্বস্ত থাকো”
আমি দ্রুত পায়ে নেমে আসি রাস্তায়।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে চাই। ভুলে যেতে চাই, সবকিছু। আমি জানি,এটাই শেষ দেখা বিভার সঙ্গে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটছি। কানে বাজছে বিভাবরীর তাচ্ছিল্যভরা রিনরিনে হাসি—-
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।