অলিভিয়াকে প্রথম থেকেই ভালো লাগতো সেবেস্টিয়ানের, তাই বিয়ের জন্য ওকেই প্রথম প্রপোজ করল স্যাবি। ওকে নিরাশ করেনি অলিভিয়া, মিষ্টি হেসে জানিয়েছিল সন্মতি। প্রথম বার দেখেই মায়েরও পছন্দ হয়ে গিয়েছিল নরম চেহারার অলিভিয়াকে। অল্প দিনের মধ্যেই অতি অল্প আয়োজনে বিবাহসূত্রে বাঁধা পড়েছিল অলিভিয়া আর সেবেস্টিয়ান। আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই ইহলোককে টা টা করে মা ঢুকে পড়েছিল কফিনের মধ্যে। তবে মায়ের অভাব পূরন করেছিল পামকিন। অলিভিয়ার কোল আলো করে এসেছিল ও, ঠিক যেন একটা অ্যাঞ্জেল। অলিভিয়া নিজের নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিল অ্যাডেলিনা।
কিন্তু স্যাবির কপালে সুখ টেঁকে না। তাই ছোট্ট পামকিনকে ওর কাছে রেখে অকালে চলে গেল অলিভিয়া, লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। তারপর থেকেই রোবটের মতো জীবনযাপন করছে সেবেস্টিয়ান। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্রেকফার্স্ট বানানো, হয় নুডলস নয়তো স্যান্ডউইচ। তারপর পামকিনকে রেডি করা, ওকে প্লে-স্কুলে ছেড়ে আসা। ফিরে একটু হাঁফ ছাড়ে স্যাবি, এবার কিছুটা মি-টাইম, তবে দাড়ি কাটতে আর স্নান সারতে গিয়ে সেটাও যে কখন শেষ হয়ে যায় তা বুঝতেই পারে না ও। তারপর অফিস, ফেরার পথে পামকিনকে ডে-কেয়ার থেকে নেওয়া। পামকিনের প্লে-স্কুলের সাথেই ডে-কেয়ার, উইদাউট এনি টেনশন সকাল ন’টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি সেখানেই রাখা যাবে ওকে, সমবয়সীদের সাথে নানারকম অ্যাকটিভিটিতে বাচ্চাকে এনগেজ রাখা আর তার সাথে সময়মতো বাচ্চার পছন্দের হেলদি ফুড, সবই প্রোভাইড করে এই প্লে-স্কুল কাম ডে-কেয়ার সেন্টার; ওয়ার্কিং পেরেন্টদের জন্য একেবারে ‘অন্ধের যষ্টি’। পামকিনকে নিয়ে ঘরে ফিরেই আবার যন্ত্রের মতো কাজ করে সেবেস্টিয়ান; ডিনার বানানো, পামকিনকে খাওয়ানো, তারপর গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো। মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগে স্যাবির; মনে হয় সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। ওর যেমন মনের কথা বলার জন্য একজনকে দরকার তেমনই পামকিনেরও তো দরকার মাতৃসমা কাউকে।
অনেক আশা নিয়ে সামনে বসা দেবাঙ্গীর দিকে তাকায় সেবেস্টিয়ান। যার মুখে এতো মায়া, তার মনে কি একটু দয়া থাকবে না?
_____
অ্যালার্ম বাজেনি তবু আজও ঠিক সাড়ে ছ’টাতেই ঘুম ভেঙে গেল দেবাঙ্গীর। কোকিলাবেন রিন্দানী মারা যাওয়ার পর থেকে আর মোবাইলে অ্যালার্ম সেট করে না দেবাঙ্গী। মা নেই তাই সংসারের কাজের চাপও নেই। রোগ সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাওয়াতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অফিস তাই নেই সময়মত অফিস যাওয়ার তাড়া। এখন আর কোনো শিকল নেই দেবাঙ্গীর পায়ে, ও এখন মুক্ত বিহঙ্গ।
জানালায় গাঢ় রঙের মোটা পর্দা থাকার জন্য সকালের স্বাভাবিক আলোর ঘরের ভেতর ঢোকার স্বাধীনতা নেই। মোটা পর্দা আর জানালার ফ্রেমে আঁটা কাচের স্লাইডিং, দুটোকেই ঠেলে একপাশে সরিয়ে দেয় দেবাঙ্গী। সকালের ঠান্ডা বাতাস রাত-পোষাকের অলিগলি দিয়ে ছুঁয়ে যায় ওর শরীর। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় দেবাঙ্গী। মুক্তির আনন্দে চনমনে হয়ে ওঠে ওর শরীর, মন।
যতদিন মা বেঁচে ছিল ততদিন জীবন ছিল নিয়মে বাঁধা, অনুশাষনের বেড়ি পরানো। ছোটবেলা থেকে দেবাঙ্গীকে কোনোদিনই তেমন ভালোবাসেনি ওর বাবা,মা; সব ভালোবাসা সব আদর-যত্নের ওপর একচেটিয়া অধিকার ছিল ওর দাদা জিগনেশের। স্কুলে পড়ার সময় জিগনেশ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে মা চেনাজানা সবাইকে ছেলের কৃতিত্বের কথা বলে বেড়াতো। বাবা ওর পছন্দের গিফট এনে দিতো। দেবাঙ্গীও ভালো ফল পেতো পরীক্ষায়, অনেক সময় জিগনেশের থেকেও ভালো, কিন্তু তাতে বাবা, মা কারও কিছু এসে যেতো না। মেয়ে স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলো কি না পেলো তাতে কি আসে যায়; সেই তো বিয়ের সময় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি করে দহেজ নিয়ে তবেই এই বাড়ি থেকে বিদায় হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না দেবাঙ্গীর, ছিল না মুখ ফুটে কিছু বলার অধিকার। সব অন্যায়, সব অবিচার মেনে নিয়েছিল ও, ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছিল নিজেকে।
সায়েন্সের সাবজেক্টগুলোতে জিগনেশের থেকে বেশি নম্বর পাচ্ছে দেখে দেবাঙ্গীকেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার করার কথা নীতিন রিন্দানীর মাথায় এসেছিল একবার। কিন্তু সে প্রস্তাব শোনামাত্রই নাকচ করে দিয়েছিল কোকিলাবেন, বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘কি দরকার মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে একগাদা পয়সা খরচ করে, ওকে দেখতে-শুনতে ভালো, একটা কলেজ পাশ দিলেই ওর জন্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পাওয়া যাবে।’
খুব একটা ভুল কথা বলেনি কোকিলাবেন। ভালো চাকরি করা ছেলেরা এখন আর শুধু অতীব ফর্সা, পরমা সুন্দরী স্ত্রী পেলেই সন্তুষ্ট হয় না, তাদের প্রয়োজন আদব-কায়দা জানা, বন্ধুসমাজে মেলামেশা করার উপযুক্ত ভদ্র, শান্ত, শিক্ষিত মেয়ে; যে একদিকে শাশুড়ির জন্য লেখাপড়া জানা দাসী হবে আর অন্যদিকে সন্তানদের জীবনের প্রথম পাঠ শেখানোর জন্য ধৈর্যশীলা মাষ্টারনি।
কোকিলাবেনের কথা মনে পড়লে আজও মন খারাপ হয়ে যায় দেবাঙ্গীর। সেই সময় দায়িত্ব নিয়ে ওর কেরিয়ার বরবাদ করে দিয়েছিল কোকিলাবেন। তারপর যখন জিগনেশ মুখে লাথি মেরে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল, বাবা অকালে সংসারের মায়া কাটিয়ে ওদের ছেড়ে চলে গেল তখন সেই দেবাঙ্গীকেই আঁকড়ে ধরল কোকিলাবেন, নিজের পঙ্গু শরীরের দায়িত্ব চাপিয়ে দিল ওর ঘাড়ে। দেবাঙ্গী ভাবে, মানুষ এতো স্বার্থপর হয় কি করে???
আবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয় দেবাঙ্গী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অজান্তেই সমর্থন করে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থাকে। ভালো খাবার, নতুন জামা, দামী রিস্টওয়াচ, রেসিং সাইকেল এ সবই ছিল জিগনেশের জন্য, কারন ও ছিল নীতিন রিন্দানীর বংশধর। এই সব দেখতে দেখতে নিজের জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল দেবাঙ্গীর। ও বার বার প্রশ্ন করতো ভগবানকে, কেন ওকে নারীজন্ম দিলো?
তারপর কিশোরীবেলায় ওর জীবনে এলো আশিষ, সে ও জিগনেশের মতোই ‘মা কা লাডলা’, ‘বাপ কা বেটা’। আশিষের সাথে সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল ততই আশায় বুক বাঁধছিল দেবাঙ্গী। যে পরিবারের পরোয়া না করে ওকে প্রেম নিবেদন করেছে, সমাজের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সম্পর্ক সে নিশ্চয় একদিন ওকে এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে যাবে, ঘর বাঁধবে, শুরু করবে নতুন জীবন।
তবে মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মেঘনাকে ঘরের বউ করে আনলো জিগনেশ। মেঘনা খারাপ মেয়ে ছিল না, লেখাপড়া জানা, দেখতে-শুনতেও ভালো, জিগনেশের সাথে ভালোই মানিয়েছিল ওকে। কিন্তু মা কিছুতেই ওকে মেনে নিল না মেঘনাকে, কারন ও শাকাহারি গুজরাটি নয়; মাছ, মাংস খাওয়া মারাঠি। আমিষ খাওয়া মেয়েটাকে দেখলেই না কি মায়ের বমি পেতো, যদিও জিগনেশকে বিয়ে করার পর নন-ভেজ খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল মেঘনা।
রোজই ছুতোয়-নাতায় অশান্তি হোতো ওদের সংসারে। একটু সুযোগ পেলেই মেঘনাকে এক ঝুড়ি কথা শোনাতো কোকিলাবেন। প্রথমদিকে চুপ করে সব মেনে নিলেও ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করলো মেঘনা। আর তারপর শুরু হল নিজস্ব স্বামীদের সাক্ষী রেখে শাশুড়ি-বউয়ের লঙ্কাকান্ড। নিরন্তর বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে পুনা ছাড়লো জিগনেশ, মেঘনাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে শুরু করলো সুখের সংসার।