ধারাবাহিক গল্পে আলিনূর চৌধুরী (পর্ব – ৬)

তুলির অন্তর্ধান

নৌকা যখন চাপাতলা ঘাট ছাড়লো, তখন বিকেল চারটে। বাতাস নেই। বাদামে বায়ু ভরের কোনো আসা নেই, তাই দাঁড়ের বইঠা ছাড়া কোনো ভরসাও নেই। দুই জন দাঁড়ে বসে গেলো, কাসেম হালের কুঠিতে বসলো। বসেই দাঁড় টানাদের বললো- দে টান, সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে পৌঁছানো চাই। দুজনে জান প্রাণ দিয়ে দাঁড় টানছে, যত শক্তি খাটিয়ে জোরে জোরে টানছে তবুও মনে হয় প্রবল স্রোতের ধাক্কায় বইঠা উগলায়া দেয়, জলে জোরপায় না। নৌকা আগাতে চায় না, মনে হয় জলে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

দাঁড়ে কাজ হবে নারে গাদু, এক কাজ কর ; গাঙের পুব পাড় দিয়া গুন ধর, তুই আর নাতু। দুজনে জোঁড়া ধইরা টানবি , তয় জোর পাবি – কাসেম বললো।

নৌকা গাঙ্গের পুব পাড়ে ভিড়ায় দিলো। মস্তুলের সাথে লম্বা গুনের কাছি বেঁধে দিলো।

গাদু ও নাতু খালি গায়ে লুঙ্গি মালকাছা মেরে গামছা কোমরে খিঁচা গিট্টু মারলো ; যাতে লুঙ্গি খুইলা না যায়। হনহন কইরা গাঙ্গের পাড়ে নামলো।কিনার দিয়া কাঁদা নাই, শুকনা মাটি। শুকনাই বা থাকবো না ক্যা,কাঠফাঁটা রোদ, গা ছনছন করে, রোদের তেজে গা পুইড়া যাওনের অবস্থা। গুন টানতে জোর খাটাইতে হয়। এই জোর খাটাইতে যায়ে যদি পায়ে জোর না পায়, তয় টানতে কষ্ট হয়। কাঁদা থাকলে পা গাইড়া যায়, জোর মেলে না। মাটি শুকনা আছে তাই সস্থি, পা গাড়ে না, জোর পায় পুরা ধমে।

ধুমচে গুনের টানে নাও কলকল করে আগাতে লাগলো। নাওয়ের আগারিতে জলের ঢেউ খেলে তরতর করে জলে ফাড়ি ভাঙে। জামতলিতে নদী অনেকটা সরু তাই স্রোত বেশি। জামতলি পার হলেই চওড়া নদীতে পড়বি স্রোতও কম,তহন অত জোর লাগবো না – কাসেম গাদু আর নাতুকে বললো। হ! দাদা। পরায় আইসা গেছি মরগাঙ্গে।হের পরেইতো ব্রহ্মপুত্র।

মরগাঙ্গ পার হয়ে যখন নৌকা ব্রহ্মপুত্র নদে পড়লো তখন দক্ষিণা দমকা হাওয়া বইতে শুরু হলো। আকাশেও কয়েক ফালি কালো মেঘ ভাসলো। মনে হয় মেঘের আলামত। কেননা অনেক দেখা গেছে,বেশী গরম পড়লে বৃষ্টিসহ ঝড় বাদলা হয়।

হাছেন শেখ বললো- এই কাসেম,বাতাস উঠছে, বাদাম তুইলা দে। গুন খুইলা ফালা। মনে হয় বিষ্টি অইবো। গুন খুলে বাদাম তুলতেই চুম্বকের মত চললো নৌকা। কাসেম আনন্দে হই হই করে উঠলো। সস্তি পেলো মনে।

তমেজ বললো- হাছেন ভাই ; সবায় কয়,দেশে নাহি যুদ্ধ হবো,শেখ মুজিব নাকি আন্দোলনের ডাক দিছে!

হ। আমিও তো তাই হুনছি।

তয়, কিসের জন্য যুদ্ধ? কিছু জানো কি তুমি? তমেজ জিগায়।

বেবাক তো বুঝিনা, তয় হুনছি – পাকেরা নাকি আমাদের ঠকায়,আমাদের সম্পদ তাদের দেশে নিয়া যায়।

এইটা তো অন্যায়। আমার জিনিস আমার ঘরে থাকবো, তারা নিবো ক্যা! এইটাতো মাইনা নেবার মতো না। যদি যুদ্ধ লাইগা যায়। তাইলে কি অইতে পারে হাছেন ভাই।

সবায় তো কয়,দেশ স্বাধীন হইবো।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।