T3 ক্যাফে কলমে – আবির চক্রবর্তী

“আন্দোলনরত শিক্ষককে পুলিশ লাথি মেরেছে”
এই ঘটনার বিরোধীতা করতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের একটা শ্রেণী পাল্টা বিবৃতি বা নিদান দিচ্ছেন যে কোনো শিক্ষক শিক্ষিকা যেন ওই পুলিশে কর্মীর সন্তানদের না পড়ান।
এটা আপনাদের কাছে কতোটা যুক্তি সঙ্গত?
সম্প্রতি কয়েকদিন আগে, সুপ্রিম কোর্টের এক বিশেষ আদেশবলে, বাংলার শিক্ষা জগতে নেমে এসেছে অভাবিত ভীষণ দুর্যোগ। এক লহমায় প্রায় ছাব্বিশ হাজার স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকা কর্মচ্যূত হয়েছেন। ফলস্বরূপ স্কুলে স্কুলে পঠনপাঠন সমস্যার মুখে, ওদিকে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদলও জীবন ও জীবিকা রক্ষার লড়াইয়ে পথে নেমেছেন, মরণপণ আন্দোলন।
স্কুলশিক্ষা দপ্তরে, জেলায় জেলায় প্রতিটি ডি.আই.অফিসে, ধর্মতলায় চলছে বিক্ষোভ, জনজীবনে বিপর্যয়। ইতিমধ্যে গত বুধবার অবস্থানকারী শিক্ষকদলের বিক্ষোভ সমাবেশে একাধিক জায়গায় (বিশেষতঃ তমলুক, বারাসত, কসবা…) তাদের ওপরে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে নির্মমভাবে লাঠি চালিয়েছে, লাথি মেরেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষকের রক্তে ভেসে গিয়েছে একটি গনতান্ত্রিক দেশের মাটি। সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি সেসব ভয়ঙ্কর ছবি। বেশ কয়েকজন অতি উৎসাহী আক্রমণকারী পুলিশ অফিসারের ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল, তাঁদের নিয়ে তৈরি ছিছিক্কার, মিমিক্রি, কার্টুনে ভরে উঠেছে ফেসবুক, সংবাদপত্রের পাতা। অনেকের পক্ষ থেকে দাবী উঠছে, ঐসব পুলিশ অফিসারদের সন্তান সন্ততিদের কোন শিক্ষক শিক্ষিকা যেন পাঠদান না করেন। পক্ষে বিপক্ষে জমে উঠছে নানাবিধ মতামত।
মাননীয় TECH TOUCH টক. সাহিত্য CAFE আমাদের সুযোগ দিয়েছেন এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের।
সে প্রসঙ্গেই বলি, একটি শিশু জন্মগ্রহণের পরে মানুষ হওয়ার পাঠ প্রথম নেয় কিন্তু মা-বাবার পরে শিক্ষকের কাছেই। পরে পরে সমাজ,পরিবেশ এবং সময় তাকে আরও ঋদ্ধ করে।
ছিলাম শিক্ষক কন্যা, পরবর্তী জীবনে নিজেও শিক্ষক হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছি বলেই বুঝি, শিক্ষকতা কোন পেশা নয়, ব্রত। মানুষ তৈরি করার ব্রত। হয়তো নিজের গায়ে লাগেনি, তবু সন্তানসম অথবা ভাতৃসম শিক্ষকদের ওপরে পড়া প্রত্যেকটি মার অথবা লাথি, আমাদের মনে লেগেছে। সে বিষাদক্ষরণ এতো তাড়াতাড়ি বন্ধ হওয়ার নয়।
তবুও বলবো, যিনি বা যাঁরা অতি উৎসাহী হয়ে ক্ষমতালোভীদের পদলেহন করা অথবা আনুগত্যের প্রমাণ দেওয়ার জন্য নিরস্ত্র শিক্ষকদের ওপরে বলপ্রয়োগ করেছেন, তা তাঁর নিজস্ব মনোভাব অথবা স্বার্থসিদ্ধির জন্যই করেছেন, তার দায় তাঁর বা তাঁদের সন্তানদের ওপরে বর্তাবে কেন? দস্যু রত্নাকরের গল্প কি আমরা ভুলে গেছি?
প্রকৃত শিক্ষিত সমাজের অংশীদার এবং মানুষ গড়ার কারিগর ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই দায় আছে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা ও শিক্ষিত করা।তা নাহলে, এই প্রবণতা তো বন্ধ হবার নয়। কোন বিশেষ পেশাই সর্বাংশে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারেনা। তাই বিশেষ কয়েকজনের পাপের দায় অপরাপর ঐ পেশার সমস্ত মানুষ এবং কয়েকটি নিরীহ শিশুর ওপরে চাপিয়ে আমরাও তাদের ওপরে অন্যায় করবো কেন?
বরং আরও যত্ন ও হৃদয়বত্তার সঙ্গে যদি আমরা সেই সব না-মানুষদের সন্তান সন্ততিদের প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারি, এবং মানুষ হয়ে ওঠা সেই সব তরুণ প্রজন্ম পূর্বজ না-মানুষদের প্রতি ঘৃণার কটাক্ষ হানে, জবাব চায়, সেই হবে এনাদের অপরাধের সঠিক শাস্তি।
মনে রাখতে হবে, শিশু ভুলতে পারে আদরে, কিন্তু তরুণ গ্রহণ করে আদর্শ। সেইটুকুই কাজে লাগাতে হবে এই ঘনায়মান অন্ধকারে আলোকবর্তিকার দিশা দেখানোর উদ্দেশ্যে।
সবশেষে, হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকেই চাই, সমস্যার সমাধান হোক, যোগ্য মেধাবী মানুষগুলি আপন কর্মক্ষেত্রে সসম্মানে ফিরে গিয়ে আপনব্রত পালনে সক্রিয় হোক; ঝলমল করে উঠুক শিক্ষা প্রাঙ্গণ।
এবং অবশ্যই দোষীদের চুড়ান্ত শাস্তি হোক, কারণ, দুর্নীতি কখনও শেষ কথা বলতে পারে না। কবির ক্রান্তদর্শণেই বলি,
IF WINTER COMES, CAN SPRING BE FAR BEHIND!
প্রতীক্ষা করি মঙ্গল প্রভাতের। শুভমস্তু।