অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৬)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

তখন অরণ্য চুপ রাতের গভীরে
আমার সামনে আমি শুধু
চিলতে আয়নায় দেখি যে অচেনা মুখ
অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ ধুধু…

অমলেন্দু অনেক চেষ্টা করেও মেঘলাকে ফোনে ধরতে পারছিল না। উঠোনের হিমে দাঁড়িয়ে বারকয়েক চেষ্টা করলো।আউট অফ রিচ বলছে।মেঘলা আজকের রাতটা ঝাড়গ্রামে কাটাবে।কাল সকালের গাড়িতে উড়ে যাবে কলকাতার দিগন্তে। ওর বন্ধু অনামিকার গোটা দিনটা হয়তো কাটবে কলকাতা ফেরৎ স্বামীর প্রতীক্ষায় ।কবি শুভব্রত ফিরে গেছে ফুলকুশমায় । অমলেন্দু স্যারকে বাসে তুলে দিয়ে প্রলয় গুটি গুটি বেলপাহাড়ির বাড়িতে ফিরে গেছে । সেখানে ওর মা বাবা স্ত্রী আর একমাত্র সন্তান হয়তো ওর ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে জমিয়ে মুড়ি-পেঁয়াজ-চায়ের আসরে বসেছে । শুনছে কবি সম্মেলনের জানা অজানা গল্প। রাত বাড়ছে। উন্মনার কথা হঠাৎ মনে পড়লো । কিন্তু ইচ্ছে করেই ফোন করলো না। শুভ আর প্রলয়কে বলা আছে , ওরা উন্মনার খবরাখবর রাখবে । এতক্ষণে সে-ও বোধহয় ছোট্ট মেয়ে আর মায়ের কাছে উপুড় করে দিয়েছে আঁচল ভরা সর্ষে ফুলের মতো স্মৃতি। লেখার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বাসি বিড়ি সিগারেট দেশলাইয়ের দিকে ওর অভ্যস্ত হাত চলে যায় , কিন্তু নিজেকে সংযত করে। বাইরের হিমভেজা শুকনো পাতার ওপর একটু যেন শব্দহীন শব্দ উঠেও মিলিয়ে যায় । অবশ্যই সেই চেনা বুড়ো দাঁড়াশ সাপটা নয় ; কারণ, অন্তত পয়লা ফাল্গুন পর্যন্ত সে শীতঘুমে লগ্ন হয়ে থাকবে। তবু সেই শব্দটা যেন কবিতার নারী হয়ে ওর হাত চেপে ধরে। একটানে নেশার সব জিনিসগুলোকে আবর্জনার দিকে দ্বিধাহীন ছুঁড়ে ফেলে দেয় অমলেন্দু। তারপর আবার সব চুপ। এই সেই স্তব্ধতা , এই সেই আশ্চর্য প্রহর, যখন হয়তো কবি জীবনানন্দের মেধা থেকে , খাতার কাগজে উঠে আসতো‌ বনলতা সেন, ধূসর পান্ডুলিপি , রূপসী বাংলা। নিজের অনিশ্চিত ও বয়স্ক আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে অমলেন্দু । এই প্রথম , কবি না হতে পারার যন্ত্রণা তাকে আমূল বিদ্ধ করে যায়। বহুবার সে কবিতা লিখতে গিয়ে হৃদয়ের সবটুকু উপুড় করে দিয়েছে খাতার পাতায়। কিন্তু শেষে সেই কবিতার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে , যা লিখতে চাইলো ,তার এক শতাংশও ফুটিয়ে তুলতে পারলো না। মনে হয়, লাইনগুলো যেন আগে কেউ লিখে দিয়েছে । মহাকবি বাল্মীকির প্রথম শোক বা শ্লোক –মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমোগম শাশ্বতী সমঃ যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুন দে কমবধি কাম মোহিতম্ …
সেই থেকে মাইকেল হয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়ে আজকের তরুণতম কবির শত সহস্র কবিতা অমলেন্দুর কন্ঠস্থ।লোকে তাকে স্মৃতিধর বলে সম্মান দেয় । বাংলা ছন্দের বিন্যাস-বৈভব শিখতে আসে। তবু , নতুন কবিতা ওর কলমে ধরা দেয় না। তবে , সে নিজের অবস্থান নিয়ে অসুখী নয় । সে জানে , আমৃত্যু তাকে কবিতার পথরেখা ধরে চলতে হবে। জীবনকে কবিতার মতো সুন্দর করে তুলতে হবে। তাইতো , কবি শুভব্রত ও প্রলয় তার দুটি প্রিয় কবি-মুখ। শব্দ কিভাবে কবিতা হয়ে ওঠে ,তা আজও অমলেন্দুর কাছে গভীর বিস্ময় । আজ বেলপাহাড়ি বাসস্ট্যান্ডে সবাই চলে যাওয়ার পরে , সন্ধের ঘোর লাগা একটা ফাঁকা চায়ের দোকানে বসে , কবি শুভব্রতর অনিশ্চিত জীবন নিয়ে প্রলয়ের সঙ্গে অনেক কথা হল। ফিরে যাওয়ার আগে , প্রলয় বারবার অমলেন্দুকে অনুরোধ করেছিলো ,ওর বাড়িতে আজকের রাতটা কাটিয়ে যেতে । অমলেন্দুর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না , কারণ, রাত পোহালেই সোমবার । সকাল থেকে আধ পুরোনো স্কুটি নিয়ে খবরের পেছনে পেছনে ছুটতে হবে । রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক,বধূ নির্যাতন , শিশুমৃত্যু , লোকালয়ে ঢুকে পড়া হাতির তান্ডব …
সারাদিন কোথা দিয়ে কেটে যাবে। তারপর ঘরে ফিরে এসে‌ রবিঠাকুরের বাঁশি কবিতার মতো–নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।

‌ এক টুকরো রান্নাঘরে গ্যাস ওভেনের পাশে সাজানো রয়েছে প্রায় ঘাসের মতো হয়ে যাওয়া মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, একটু ছোলার ডাল আর খান তিনেক চামড়া হয়ে যাওয়া রুটি। নাঃ , খেতে আর ইচ্ছে করছে না। একটু জল খেয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো অমলেন্দু। কিছু ফেলে রাখা রিপোর্ট আজ শেষ করতে হবে । তাহলে কালকের চাপ কিছুটা কমবে।
একটা ঠ্যাং একটু নড়ে যাওয়া কাজের টেবিলে বসে অমলেন্দু প্রাণপনে কবি শুভব্রতর কোমল ও নিষ্পাপ মুখটা মনে মনে আঁকার চেষ্টা করছে। প্রলয়ের মুখে আজ টাটকা শুনেছে, শুভব্রত একটা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে । বাঃ! দারুণ খবর ! প্রেম করলে শরীর মন তাজা থাকে। নতুন কবিতা ফুলের মতো ফুটে ওঠে। অমলেন্দু মনে মনে হিসেব কষতে থাকে,একটু কৃচ্ছ্বসাধন করে বছর পাঁচেক টাকা জমাতে পারলে , ওর নিজের ঘরের উঠোনেই সবুজ গাছপালা ঘেরা একটা কবিতার আখড়া গড়ে তুলতে পারবে। মদ ভাঙ গাঁজার নেশা থেকে শতহাত দূরে বসে সেই আখড়ায় বিশুদ্ধ কবিতা যাপনই হবে শুধু । দুবেলা দুমুঠো ভাত রুটি ঠিক জুটে যাবে।
থমথমে রাত বারোটা পেরিয়ে কুড়ি মিনিট এগিয়ে যায় । একটা দিন অতীত হয়ে আরেকটা দিনের সাথে মিশে যায়। মুখে ডটপেনের পিছন দিকটা কামড়ে, অমলেন্দু ভাবছে–কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর লেখা “আমার নীরবতা, আমার ভাষা” কাব্যগ্রন্থ’ র সেই অনিবার্য আশাবাদের কবিতাটির কথা ,যার নাম — “একদিন হবে “। অমলেন্দু মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে কবিতার লাইনগুলো–
আজ নয়। কালও নয়।
একদিন হবে।
সেদিন তুমি বা আমি কেউ থাকব না।
তবু হবে।
সব রক্ত আর জল মিলে মিশে
প্রণামের মত
রক্তিম ভোরের দিকে যাবে।
আজ নয় । কালও নয় ।
তবু জেনো , একদিন হবে।

তখন আমার ছেলে ছুঁড়ে ফেলে হননের ছুরি
নীল অন্ধকারে
তোমার মেয়ের বুকে খুঁজে পাবে সঠিক কস্তুরী
গোপন প্রহরে,
একাকার হয়ে যাবে
ধান আর গান ,
সাগরে পাহাড়ে বনে
আলো দিয়ে লেখা হবে মানুষের নাম,
অর্থ পাবে সব ভালোবাসা,
এক হাঁটু জলে ডুবে যাবে না তো এক বুক আশা,
আমাদের এত মেধা,এত শ্রম ঢালার গৌরবে
আজ নয় ,কালও নয়,
যা চেয়েছি–একদিন হবে।

ক্রমশ অমলেন্দুর খিদে পায়।একটি কবিতা তাকে অরুচির মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে ঠান্ডা রুটি তরকারির দিকে টেনে নিয়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল রুটির টুকরো আর হিমঘরের মতো ঠান্ডা বাঁধাকপি তার কাছে অমৃত মনে হয় । সে খায় , আর ভাবতে থাকে–এমন অসামান্য ও চূড়ান্ত আশাবাদের কবিতা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি আছে কি ? আশাবাদের কথা ভাবতে গিয়ে অমোঘভাবে তার সামনে ভেসে উঠলো উন্মনার শান্ত মুখশ্রী । এমন অমলিন মুখ কোনো নিরাশা‌র মেঘকে কপালে,গালে,নাকের পাটায়,চিবুকে জমতে দেয়না।তাই নিশ্চিতভাবে কবিতার ওয়ার্কশপের মধ্যে অমলেন্দু স্যারের চোখে চোখ রেখে ধুমপানের নেশা ছেড়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠতে গিয়ে , অমলেন্দু রুটির বদলে নিজের গালটাই কামড়ে বসলো। ইচ্ছে হল কোনোমতে খাওয়া শেষ করে এই কবিতাটা উন্মনাকে শোনাবে। পরক্ষণেই অভিজ্ঞ সাংবাদিক মন , পাগল অমলেন্দুর হাত চেপে ধরলো–যে আবেগ ছাব্বিশে মানায় , সে আবেগ পঞ্চাশে মানায় না । মন বললো–সুযোগ একদিন নিশ্চয়ই আসবে। এমন কবিতা শতাব্দী ধরে ফুল হয়ে ফুটে থাকবে উন্মুখ পাঠক ও কবিতা-পাগল, জীবনবাদী শ্রোতার জন্য । কলকাতার ‘পরিচয় ‘ পত্রিকার দপ্তরে সম্পাদকের চেয়ারে বসে থাকা শ্যামবর্ণ ,ধুতি পাঞ্জাবি,একহারা চেহারার সেই অধ্যাপক কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকে মনে পড়ে গেল অমলেন্দুর। কিছুদিন আগে ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন কবি । রেখে গেছেন স্বর্গের পারিজাত ফুলের মতো এই কবিতা–একদিন হবে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।