অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৫৪)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

বাইরে অঝোর বৃষ্টি বিশ্রামবিহীন,
তুমি আমি মুখোমুখি নির্জনতা ঘিরে ;
ভরা শ্রাবণের মেঘে বিবাহবার্ষিকী ,
কথা বলো ,হে অতীত ,কুটোখড় নীড়ে

শ্বশুর বাড়িতে এসে সাত আটটা দিন কোথা দিয়ে চলে গেল ,বুঝতে পারেনি উন্মনা । গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে প্রাণতোষ। ডাক্তার বলেছেন , এ যাত্রায় বেঁচে গেল সে । তবে হার্ট অ্যাটাকটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে । কিছুদিন পরে পেসমেকার বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে । প্রাণতোষ কলেজে খুব জনপ্রিয় যে,বোঝা যায়। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক অধ্যাপিকা, সিনিয়র স্টুডেন্ট, শিক্ষাকর্মীরা বাড়িতে নিয়মিত ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন , শুভকামনা জানাচ্ছেন। শুভকামনা জানানোর নম্রতাটুকু সবসময় উন্মনার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।‌ বেশির ভাগ মানুষ অসুস্থ মানুষকে কুশল জানান অন্তর থেকেই । সেখানে তাদের প্রাত্যহিক মতবিরোধও দূরে চলে যায়।কেন জানিনা ,অধ্যাপক প্রাণতোষকে নিয়ে উন্মনা গর্ব অনুভব করলো । বিবাহিত জীবনের একটা অদ্ভুত মায়া আছে ,যা জন্মভুমির টানের মতোই বুকের মধ্যে থেকে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে কোনো তিক্ত অতীতের কথা ভাবতে চায় না উন্মনা । গরম স্যুপ খাওয়ানোর পর , ঠোঁটের কোণ দুটো যত্নে মুছিয়ে দেয় উন্মনা। চব্বিশ ঘণ্টার আয়া রাখা হলেও প্রাণতোষের অনেক কাজ উন্মনার নিজে করতে ভালো লাগে । হার্ট অ্যাটাকের পর একটা শ্লথতা আসে মানুষের জীবনে । একটু হতাশ , কিছুটা অনিশ্চিত , কখনও চেষ্টা করে হাসতে গিয়ে বেদনা ঝরে পড়ে প্রাণতোষের চিবুকে । বিবাহিত জীবনের শুরুতে এই মানুষটিকে আকন্ঠ ভালোবেসেছিল উন্মনা। স্বাভাবিক বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও ভালোবেসেছিল । সুঠাম, সুপুরুষ প্রাণতোষকে ঘিরে,তার স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়েছিল ঘরে বাইরে । প্রাণতোষের বাড়ি ফেরবার কয়েকদিন পর দুপুরে , ফোনে মা আর মেয়ের সঙ্গে কথা বলার‌ শেষে ,সন্ধের মুখে প্রাণতোষের ঘরে ঢুকলো উন্মনা । সাহায্যকারী ভদ্রমহিলাকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে বললো। সদ্য বিশ্রাম থেকে উঠে বসে বালিশে আধশোয়া অবস্থায় প্রাণতোষ তখন খবরের কাগজ পড়ছিলো । অদ্ভুতভাবে তাদের প্রথম বিবাহিত জীবনের সেই বাবুইবাসা গন্ধটা যেন পেল উন্মনা । খড়কুটোর গন্ধ ,কলেজ ফেরত প্রাণতোষের ছেড়ে রাখা হাফশার্ট থেকে মৃদু ঘাম ও পৌরুষের দলছুট মিষ্টি গন্ধ ! তাদের দাম্পত্য জীবনে,যৌথ পরিবারের ঘনবদ্ধ জীবন যাপনে, ছুটির দিনের দুপুর বা প্রতি রাতের আশ্চর্য বিন্যাসে স্বামীর কাছে আসতে , ছিমছাম উন্মনার গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করতো। খুব চেনা সেই গান — দূরে দূরে, কাছে কাছে ,এখানে ওখানে, খুঁজেছি তোমায়,এসেছি তোমার মনের ছায়ায়…
শিল্প সংস্কৃতির নিবিড় ভক্ত না হলেও, প্রাণতোষ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে শুনতো সেই গান , তারপর দৃষ্টির নম্রতা দিয়ে কাছে টেনে নিত উন্মনাকে। তালবাগিচার সংসার এক আশ্চর্য মায়ায় বেঁধেছিল শান্ত ও নিবিড় উন্মনাকে। বিছানার একান্তে উন্মনা ফিসফিস করে সাতরঙা এক পাখির মতো তাদের নীড় সাজানোর গল্প করতো ।‌ মৃদুভাষী স্বামী প্রাণতোষ অন্তরঙ্গতম মুহূর্তেও শুধু আদর ও স্নেহ দিয়ে ঘিরে রাখতো তার স্ত্রী উন্মনাকে।স্বামীর কাছে মেয়ে চেয়েছিল উন্মনা। খুশি হয়ে স্বামীও তাতে সায় দিয়েছিল। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর ,এ বাড়ির সবাই খুব খুশি না হলেও প্রাণতোষ কিন্তু খুশি হয়েছিল।করতোয়া,তোয়া কত নাম ! সেই জলস্রোতের মতো সরল জীবনকে মনে রেখে উন্মনা আজ সকালে এখানকার এক মন্দিরে গিয়ে,দেবতার সামনে হাত জোড় করে প্রাণতোষের দীর্ঘ সুস্থ ও নীরোগ জীবন কামনা করেছে । ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখের জল বাঁধ মানছিল না ।দেবতাকে ডাকতে গিয়ে তার পরলোকগত বাবাকে ফিসফিস করে বলেছিল — বাবা ,ওই দূর নীলিমা থেকে তুমি আশীর্বাদ পাঠাও ,ও যেন ভালো থাকে ।
ঠিক এই মুহূর্তে দরজা ভেজিয়ে একটা চেয়ার টেনে প্রাণতোষের মুখোমুখি বসলো উন্মনা। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলো স্বামীর দিকে — একটু কথা বলতে পারবে ? প্রাণতোষ মাথা নেড়ে বললো — হ্যাঁ পারবো ।
মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করছে ? তোয়াকে নিয়ে আসবো এখানে ? বাইরে বৃষ্টি ঘন হয়ে এলো। সেদিকে তাকিয়ে প্রাণতোষ ঠোঁট কামড়ে আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছিল।
— না থাক ,আমাকে এই অবস্থায় দেখলে ও খুব উতলা হতে পারে । তোমার কাছেই ও ভালো আছে , ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে। আমি বিশ্বাস করি সন্তান সব সময় মায়ের । তাছাড়া, গত তিনচার বছর ধরে আমি তো তেমন করে বাবার কর্তব্য পালন করিনি ।
— থাক ওসব কথা । তুমি আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠো। তারপর আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাববো ।
— না উন্মনা,আমাকে একটু বলতে দাও । আমি ঠিক আছি ।
বাইরের বৃষ্টি আর হৃদয়ের ক্ষরণ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে যেন প্রাণতোষের গলায় — আমার কাছ থেকে , এই পরিবার থেকে সরে গিয়ে তুমি একটা মুক্ত জীবন পেয়েছো , যা তোমার নিজস্ব অর্জন । সেখানে আমার স্বামীত্বের অধিকারবোধ খাটানোর প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া, গত তিন চার বছর আমাদের কোনো যৌথ জীবন নেই । বোধহয় আমরা সহজেই ডিভোর্স পেয়ে যাবো। তোয়ার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার।যতদিন প্রয়োজন হবে বাবার কর্তব্য আমি করবো । যদি সুস্থ হয়ে উঠি , আমরা দুজনেই দুটো নতুন জীবন বেছে নেবো । তিক্ততা নয়,বাকি জীবন আমরা ভালো বন্ধু থাকবো।
নিজের ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার শব্দ আর থরথর করে কেঁপে ওঠা নিজেই অনুভব করছিল উন্মনা। বিবাহিত জীবনে প্রাণতোষের সেই কঠিন নির্মম আচরণ আর আজকের এই শান্ত ও প্রকৃত অধ্যাপকসুলভ মানুষটাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলনা সে। প্রাণতোষ কি নতুন কোনো জীবন খুঁজে পেয়েছে ? খুব জানতে ইচ্ছে করছিল উন্মনার । তার মনের মতো কাউকে খুঁজে পেয়েছে সে ? ছাত্রী ? সহকর্মী? প্রাণতোষ ধীরে ধীরে দম নিয়ে আবার শুরু করলো — পত্র পত্রিকায় তোমার লেখা পড়ছি উন্মনা । তোমাকে যিনি নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছেন ,তাঁর কথাও শুনেছি। আমি অসুস্থ না হলে তোমার হয়তো আসাই হতো না আর। হয়তো আদালতেই দেখা হত আমাদের। তবু আমাদের যে একটা বাবুইবাসা সংসার ছিল ,তুমি আসতেই সেটা টের পেলাম। উন্মনা ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে প্রাণতোষের বিছানায় গিয়ে বসলো ।তার স্বামীর ডান হাতটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললো — তুমি আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করবে তো ? কথা দাও।
— না উন্মনা।কথা দিতে পারলাম না। বিবাহিত জীবনে আমি ডাহা ফেল। আর ওপথে পা বাড়াবো না। অধ্যাপনার জীবন শেষ করে রইলো ঝোলা,চললো ভোলা –বলে বেরিয়ে পড়বো। জানো, কিছুদিন ধরে বিভূতিভূষণ পড়ছি । শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত নতুন করে পড়ছি। তোমার আর তোয়ার মায়া আমি কোনোদিন কাটাতে পারবো না । তাই নতুন করে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
বাইরের বৃষ্টি যেন উন্মনার উন্মুখ কানে ফিসফিস করে বললো –মানুষটাকে শেষবারের জন্য একবার হৃদয় দিয়ে ছোঁও উন্মনা । উনি তোমাকে মুক্তি দিয়েছেন ।ওনার এই উদার হৃদয়কে , খোলা মনকে টুপি খুলে স্যালুট জানাও। কতদিন পরে স্বামীর বুকের ওঠানামাটা প্রাণ পেতে দিয়ে শুনলো। প্রাণতোষ আলতো করে জড়িয়ে থাকলো তার পিঠ। কতদিন পরে তার স্বামীর বুকের চেনা গন্ধটুকু পেল উন্মনা ‌। স্বামী প্রাণতোষ কাঁপা কাঁপা হাতে উন্মনার মাথায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাত বোলালো। ভালোবাসার হাত, আশীর্বাদের হাত।
নতুন করে বৃষ্টি না আসায় ছাদে গিয়ে সেদিন রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ফোনে মা ও মেয়ের সঙ্গে কথা বললো উন্মনা। তোয়া বারবার জিজ্ঞেস করছিল — বাবা আমার কথা জানতে চাচ্ছে না ? বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমার । আমাকে একবার নিয়ে যাবে বাবার কাছে ? একটুও বিরক্ত করবো না বাবাকে । ফোনের এ প্রান্তে , ও প্রান্তে তিনজন মানুষই তাদের নিজস্ব ভাষায় কাঁদছিলো। আকাশে বৃষ্টি না থাকলেও ,আষাঢ় যেন তার সমস্ত গভীরতা নিয়ে এই পৃথিবীর পান্থশালায় বৃষ্টির মহাকাব্য লিখে যাচ্ছিল।
সামান্য কিছু মুখে দিয়ে উন্মনা আবার ছাদে উঠে এলো । এই বাড়িতে কারোরই তার সম্পর্কে তেমন কোনো কৌতুহল নেই। তবু উন্মনা এখানে থাকার দিনগুলো কে যতটা পারে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে । প্রায় দিন পনেরো পরে ,উন্মনার কলম উন্মুখ হয়ে উঠলো কিছু লেখার জন্য । কবিতার শিরোনাম দিলো–

ও বৃষ্টি,ও শব্দ,ও নীরবতা !

আমি তোর সব শব্দ,নিভৃত মর্মকথা,
বৃষ্টির কাছে ঢেলে দেবো ।
জীর্ণতা ধুয়ে মুছে আবার তাদের নীরবতা যেন ঠিক তোর চিকন ত্বকের মতো —
ভাষাহীন,তবু যেন ভীষণ ভীষণ নম্র।
তার বুকে লিখে দেবো , না না, এঁকে দেবো — আগামী মেঘের মহাসমারোহ।
প্রথম শ্রাবণে দিস পাঠিয়ে তাদের
শালবনী জঙ্গলে,গোদাপিয়াশালে, আর
জলঙ্গী পেরিয়ে নদী পদ্মার ওপারে ,
সেই পাখির ডানায় ভাসা রূপসী বাংলায়….
#
ফিরিয়ে নিস না যেন,ও মেয়ে, আবার কোনো ছলে।
তোর শব্দ,নীররতা ,প্রথম বৃষ্টির আশ্লেষে–
ভেসে যাবে ,জল দেবে সব নিঃস্ব জঙ্গলে, সব হৃদয়ের হাহাকারে, নদীতে,নদীতে …
.
ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ivy banerjee says:

    অপূর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।