পূজা পরিক্রমা
চায়ের কাপটা নামিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যায় মিতালি। সকালে বড়ো তাড়াহুড়ো থাকে।সব সেরে দোকান খোলা। আজ ষষ্ঠী। কাল থেকে চারদিন বন্ধ রাখবে দোকান। এইসময়টা একদম দম ফেলার সময় পায়না।খুব ভিড় হয়। ভাত চাপিয়ে ডালটা চাপাতেই দিয়া এসে জড়িয়ে ধরে।
— ছাড় দিয়া, এখনো বাচ্চাদের মতো করিস। আজ অনেক চাপ আছে। দেরি হয়ে যাবে।
— আজ হোক দেরি।আর এখন থেকে চাপ নেবে না। আমার চাকরিটা হয়ে গেছে মা। ওরা কনফার্মেশন দিল।
চোখ দিয়ে জল নেমে আসে মিতালির। কথারা হারিয়ে গেছে যেন।
–ও মা…এতদিনের যুদ্ধ শেষ মা..
মেয়ের কথায় হুঁশ ফেরে মিতালির। সত্যিই এতদিনের যুদ্ধ শেষ আজ। দিয়া বলে চলে,
— আজ ওবেলা আর দোকান খুলবেনা মা।আমি এখন কিছু কাজ সেরে আসছি। বিকেলে আমরা বেরোবো।ঠাকুর দেখব আর ফেরার সময় ডিনার করে ফিরব। আজ সব খরচ আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে। বুঝেছ মা জননী…
একগাল হেসে ফেলে মিতালি।
— আচ্ছা আচ্ছা। সে দেখা যাবে। চল জলখাবার খাই। দাদু-দিদাকে বলেছিস?
— না তো।এবার যাবো বলব সব। আজ কিন্তু আমরা সবাই বেরোব। তুমি দাদু -দিদা তৈরি হয়ে থাকবে।
দোকানটা এবেলা আর খোলেনি মিতালি। ঘরের কাজ গুছিয়ে চা নিয়ে ওপরে গেল। চা খেতে খেতে কাকু-কাকীমার সাথে কথা হচ্ছিল। সুজাতাকাকীমা বললেন,
— যুদ্ধটা শেষ হলো।
–তোমরা পাশে না থাকলে…
হ্যাঁ,সুজাতাকাকীমা আর ঋষিকেশকাকু পাশে না থাকলে যে কি হতো!ভাবলেও ভয়ে শিউরে ওঠে মিতালি।
সুজাতাকাকীমা আর ঋষিকেশকাকু আত্মীয়তার সম্পর্কে কেউ হননা। তবে এঁনাদের দুজনের জন্যই আজ মিতালি আর দিয়া সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারছে। সুজাতাকাকীমা মিতালির মাথায় হাত রেখে বলেন,
— আমরা সাথে থেকেছি মাত্র, কিন্তু আসল লড়াইটা তোমার আর দিয়ার..
— না গো কাকীমা। তোমাদের জন্যই সাহস করে বেড়িয়ে আসতে পেরেছি সে রাতে। তোমরা আশ্রয় না দিলে…..
কাকু মিতালির মাথায় হাত রেখে বলেন,
— তুমি আমাদের মেয়ে। এটাই এখন সত্যি। পুরোনো কথা ভেবো না…
পুরোনো কথাগুলো মনে করতে চায়না ঠিকই । তবুও মনে তো পড়েই–
**
খুব ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছিল মিতালি ও তার ভাই। তারপর মাতৃহীন সংসারে বাবার আদরে স্কুল শেষে কলেজে উঠল। কলেজে পড়াকালীন মিতালি স্বপ্ন দেখত পড়া শেষ করে চাকরি করবে। কিন্তু ভালো সম্বন্ধ পেয়ে পড়া ছাড়িয়ে বিয়ের জোগাড় করেন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। বিয়ের আসরেই পণ নিয়ে সমস্যা শুরু হয়।মিতালির বাবার অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়া থেকে বাঁচাতে বরপক্ষের হাতে-পায়ে ধরেন। সেখানেই দেনাপাওনার নতুন চুক্তি হয়। সবকিছু মেনে নিয়ে বিয়েটা হয়ে যায়।তারপর শুরু হয় নতুন জীবন।মদ্যপ স্বামী রজতের আর লোভী শাশুড়ির অত্যাচার শুরু হলো। মিতালি প্রথম প্রথম বাবার কাছ থেকে কিছু আনত। তবে একসময় বাবারও আর্থিক জোর শেষ হলো প্রায় । এদিকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে। একদিন মিতালি সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহননের। কিন্তু শরীরের মধ্যে নতুন প্রাণের আগমনী বার্তায় সিদ্ধান্ত বদল করে। অন্তঃস্বত্ত্বা মিতালির ওপর রজত ও শাশুড়ির দয়া হয়। শারীরিক অত্যাচারের মাত্রা কম হয়। নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যত ধীরে ধীরে উন্নত হবে এই আশায় দিন কাটে। কিন্তু উপরওয়ালা অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। মেয়ে সন্তানের আগমনে খুশি হয় নি পরিবার। আবার শুরু হয়েছে পুরোনো জীবন।এর মাঝেই মিতালির বাবাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। ভাই কোনোরকমে টিউশনি আর কলেজ করে দিন চালায়। সেখানে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। এত বড় পৃথিবীতে মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবে!এই সমস্যার সমাধান না পেয়ে দিনের পর দিন মার খেতে থাকে।
এমন সময় একদিন সাক্ষাৎ মা দুর্গার রূপে যেন মিতালির জীবনে সুজাতাকাকীমা এলেন।
পাশের বাড়িতে ভাড়া নিয়ে এসেছিলেন কাকীমারা। কাকুর ট্রান্সফারের জব ছিল।ছাদে গেলে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। কিন্তু ভয়ে কখনও কথা বলতোনা। সৌজন্যতামূলক হাসি বিনিময় করে চলে আসত। কিন্তু ভগবান বোধহয় অন্যকিছু ঠিক করেছিলেন। একদিন ছোট্ট দিয়াকে নিয়ে শিবমন্দিরে গেল মিতালি। সেখানেই দেখা সুজাতাকাকীমার সাথে। আলাপ করলেন নিজে থেকেই। তারপর কখনও পার্কে, কখনও বাজারে দেখা হলে নিজের থেকে কথা বলতেন।কেন যেন মিতালির খুব আপন মনে হতো সুজাতাকাকীমাকে। তারপর একদিন পার্কে দিয়াকে নিয়ে গিয়েছিল। আগের রাতের রজতের মারের দাগ ঢাকতে ব্যর্থ চেষ্টা করছিল মিতালি। কিন্তু সুজাতাকাকীমার নজর এড়ালোনা কিছুই। এরপর মিতালিকে বোঝাতে লাগলেন এভাবে মার খেয়ে জীবন কাটানো ঠিক না। কেঁদে ফেলেছিল মিতালি। অসহায়তাগুলো বলে ফেলে সুজাতাকাকীমাকে। সেইসময় যেকোনো সমস্যায় পাশে থাকার ভরসা দিলেন। আর সেই ভরসাতেই সেদিন…
**
সেদিনের কথাটা আজও চোখে ভাসে।শরীরটা ভালো ছিল না মিতালির। রাতে খাবারে লবনের মাত্রা ঠিক না থাকায় মারতে উদ্যত রজতকে বলেছিল,
— শরীর ভালো নেই। তাই খাবার ঠিক বানাতে পারিনি।
উত্তরে অশ্রাব্যভাষায় কথার সাথে মার জুটছিল মিতালির। ঠিক তখন ছোট্ট দিয়া ভয়ে জানালা দিয়ে চিৎকার করে ডেকেছিল সুজাতাকাকীমাদের। তারপর ছুটে এসেছিল মিতালিকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টায়।রাগের চোটে মিতালিকে ছেড়ে দিয়াকে মারতে উদ্যত হয় রজত। সেদিন সব ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙেছিল মিতালির। টেবিলের ওপর ফলকাটার ছুরিটা উঁচিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ এমন রূপে মিতালিকে দেখে থমকে গিয়েছিল রজত। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় শুনেছিল সুজাতাকাকীমার গলা।সেই শব্দে সাহস বেড়ে গিয়েছিল অনেকটা। সেরাতেই সুজাতাকাকীমা আর কাকুরর সাথে বাড়ি ছেড়েছিল মিতালি মেয়েকে সঙ্গে করে।
শুরু হয়েছিল অন্য লড়াই। তবে সে লড়াইয়ে পাশে ছিলেন কাকু-কাকীমা। আশ্রয় দিয়েছিলেন মিতালি আর দিয়াকে। কিন্তু কাকু-কাকীমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে মন চাইছিল না। কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল মিতালি।কাকু অনুভব করেছিলেন একথা। তাই কাকুর জানাশোনা একটা দোকানে মিতালিকে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন । আর সেই থেকে শুরু অন্য জীবন।দিয়াকে নিয়ে নতুন পরিচয়ে যেন নতুন করে বাঁচার লড়াই। কাকু যখন বদলি হলেন পরিবারের সাথে মিতালি আর দিয়াকেও নিয়ে এলেন।দিয়াকে নতুন স্কুলে ভর্তি করলেন। মিতালি পূর্ব অভিজ্ঞতায় আবার কাজ পেল। এভাবেই জীবন বয়ে গেল। আজীবন মিতালিকে কন্যাসম আর দিয়াকে পৌত্রীসম দেখেছেন সুজাতাকাকীমা ও ঋষিকেশ কাকু। অবসরের পর এখানেই বাড়ি করলেন কাকু।
পুরোনো কাজ ছেড়ে সঞ্চিত অর্থ আর ব্যাঙ্ক লোনের মাধ্যমে কাছেই একটা ছোট্ট দোকান খুললো মিতালি। কসমেটিকস আর ইমিটেশন গয়নার দোকান। নিজের অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারকে মূলধন করে শুরু করল স্বাধীন ব্যবসা। আর সে ব্যবসা ধীরে ধীরে উন্নতির মুখ দেখতে লাগল। এদিকে দিয়াও কলেজের পড়া শেষ করে টিউশনি ও চাকরির খোঁজ করতে লাগল। সবসময়ই পাশে থেকে ভরসা যুগিয়েছেন কাকু-কাকীমা।
আর আজ দিয়ার চাকরির খবরটা জানান দিল এতদিনের লড়াই বোধহয় শেষ হলো।তবে সবকিছুই সম্ভব হয়েছে কাকুকাকীমার পাশে থাকার ভরসায়। আজ তাই ওনাদেরকেই নিজের পরিবার ভাবে মিতালি।
এমন সময় গেট খোলার শব্দ জানান দিল দিয়ার ফেরার। কাপটা টেবিলে রেখে কাকু-কাকীমাকে প্রণাম করে মিতালি। ছলছল চোখে বলে,
— হ্যাঁ পুরোনো কথা ভুলে এবার নতুন চিন্তা করব। আমার নতুন বাবা-মা আর দিয়াকে নিয়ে এখন আমরা সবাই ঠাকুর দেখতে যাবো। তৈরি হয়ে নাও তোমরা।
**
সন্ধ্যায় মিতালিদের বাড়ির সামনে একটা উবের এসে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে সেগাড়ির পিছনে উঠলেন ঋষিকেশকাকু, সুজাতাকাকীমা ও মিতালি।সামনের সিটে দিয়া বসতেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। দিয়া আজ তার মা-দিদা-দাদুকে নিয়ে পূজাপরিক্রমায় বেরোলো।