T3 || অবিস্মরণীয় নজরুল || বিশেষ সংখ্যায় অনিন্দিতা ভট্টাচার্য্য
by
·
Published
· Updated
কলমে, বিদ্রোহে কাজী…
কলমে বিদ্রোহের ঝড় উঠতো যাঁর, কখনো বা সেই কলম থেকেই ঝরতো প্রেমের অমোঘ উচ্ছাস, কখনো বা শ্যামা মায়ের আকুল বাণী, সে যেন কলম নয় সে যেন এক সৃষ্টির সূচনা। সত্যি কি অবিশ্বাস্য জাদু ছিল যেন প্রেত্যেকটা শব্দের বন্ধনী তে। বলে যেত না ছোঁয়া আত্মপ্রকাশ দের। বিংশ শতাব্দীর অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। দুই বঙ্গদেশেরই এক অতিপরিচিত নাম হলো কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কলমে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিদ্রোহী কবি হিসাবে বিশেষ পরিচিত তিঁনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, মানুষের প্রতি মানুষের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছে তাঁর কলম।
তিনি যেন মানুষ নন, এক নতুন সৃষ্টির সৃষ্টি কর্তা। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। মূলত তিনি কবি হিসাবেই বেশি খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই “বিদ্রোহী কবি”, তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লেখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।
কবির সৃষ্টি যেন সত্যিই একেকটি অমূল্য রত্ন। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে তাঁর প্রত্যেকটা প্রতিবাদ, ভালোবাসার রঙ, সবই যেন বড্ড কাঙ্ক্ষিত, বড্ড ছুঁয়ে যাওয়া। কবি যেখানেই থাকুক, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি এভাবেই বারেবারে ফিরে আসুক। শ্রদ্ধা অফুরান।