২১ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সবাই মনে রাখে। সারা দেশ জুড়ে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য জেগে উঠেছিল নবীন থেকে প্রবীণ সকলে।
এরকমই অত চেনা পরিচিতি না থাকলেও, যদি ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ রাখা যায় তাহলেই দেখা যাবে আজকের দিনে আসমে এই ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিল কিছু তরুণ। কি ছিল সেই বিপ্লব…!
১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকায় ১১ টি তরুণ প্রাণ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল, ভারত রাষ্ট্রে। ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে আরও তিনটি তরুণ প্রাণ আত্মবলিদান দেয় সেখানে। তারও আগে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন মানুষ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের বাইরে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। দুটো ক্ষেত্রেই মাতৃভাষার নাম বাংলা। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা যথাক্রমে অসমিয়া ও উর্দু। এ লড়াই দুটো ভাষার লড়াই নয়, বরং আধিপত্যবাদের লড়াই।
শুধু কি তাই ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এরকম নানারকম বলিদান। কিন্তু এতেও কি হয়েছিল সমাধান..?
স্বাধীনতার পর পরই বাংলা ভাষা আসামের আধিপত্যবাদের শিকার হয়। ১৯৪৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই, রাজ্যপাল আকবর হায়দারি, সাংসদ নীলমণি ফুকনরা চেষ্টা করতে লাগলেন, কীভাবে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করা যায়। তারই জেরে ১৯৬০ সালে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বাঙালিরা আক্রান্ত হন। প্রায় এক থেকে দেড় লক্ষ বাঙালি আসাম ছাড়তে বাধ্য হন। নয় জন বাঙালি নিহত হন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা পুনরায় প্রস্তাব আনেন, অসমিয়া হবে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা। এ সবের বিরোধিতা চলতে থাকে, মূলত বাঙালিরাই করেন। এসবের ফলে শিলচরে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জনকে আসাম সরকারের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ইতিহাসের পাতায় এগুলো আজ নিছকই বিপ্লব, যা আসতে আসতে অবলুপ্তির কোঠায়।
এই লড়াই ছিল মাতৃভাষার লড়াই। মাতৃভাষা হয় সহজাত। অন্য ভাষা রপ্ত করতে হয়। আর সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে ব্যক্ত করার একটাই ভাষা থাকে তা হলো মাতৃভাষা। তাছাড়া অন্য যে ভাষাই অর্জন করা হোক না কেন মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশের মত এত অনাবিল আনন্দ অন্য কোন ভাষাতেই সম্ভব নয়।
মাতৃভাষায় আঘাত আনতে পারলে ধসে যায় সেই জাতি। আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু তিনটি জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় – ভাষা, চিন্তন ও জগৎ। ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। মাতৃভাষায় আমরা চিন্তা করি, কল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি। ভাষা ছাড়া চিন্তন অসম্ভব। চিন্তনের একটি মূল জায়গা হল জগৎ বা ‘ওয়ার্ল্ড’। ভাষার উপর আঘাত হানতে পারলে চিন্তার জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করা সম্ভব হবে, আর সেটা সম্ভব হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতকে বুঝতে পারবে না মানুষ। সে পঙ্গু হয়ে পড়বে। প্রশ্ন করবে না, শাসিত ও শোষিত হবে বিনা প্রশ্নে।
ভাষার এই সংগ্রাম শুধু বাঙালিদের একচেটিয়া, এরকম মনে হতে পারে। না। তামিল, কন্নড়, মালয়ালম, কোঙ্কনি ভাষা নিজেদের অধিকারের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন করেছে। সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার তকমা পেতে মৈথিলি, কোঙ্কনির বহু সময় লেগেছে। সাঁওতালিকে জনজাতি ভাষার মর্যাদা দিতেও দেরি করা হয়েছে অনেক।
তাই ভাষার লড়াই সত্যি “আ মরি বাংলা ভাষাই” হয়ে থাকে। সেখানে যতবার আঘাত আনা হবে, ততবারই গর্জে উঠবে প্রজন্মের নতুন শিক্ষিত প্রাণ।
আজ ১৯মে, ভাষা শহীদ দিবস। ভাষার এই লড়াই হলো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। শাসকের চোখে পাল্টা রক্ত চক্ষু রেখে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। যতদিন ভাষা, বারে বারেই মাতৃভাষা।