অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৫)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

বাড়ির অন্তরে আছে নিজস্ব নির্জন
সেই রূপকথায় বাঁচে অন্তরমহল
আত্মজার হয়ে ওঠা মেয়েবেলা ঘিরে
না ফোটা পলাশ অবগুণ্ঠন খোল…

একটু ম্লান আলো জ্বলা বাসটা যখন বাঁকুড়া শহরের দিকে চলে গেলো , উন্মনাকে প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে ; সবজির বিশাল খালি‌ ঝুড়িগুলো ভ্যানরিক্সায় চাপিয়ে , প্যাডেলে পা রাখা পাশের গ্রামের খোকন মাহাত বললো–ও দিদিভাই , আমার এই ঝুড়ির মধ্যে যদি চেপে বসতে পারো,তাহলে চলে এসো , এখন আর টোটো পাবে না। দূরের রাস্তায় ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া ওর এতক্ষণের সঙ্গী বাসটার লাল আলো বিন্দু হতে হতে একসময় শূন্য হয়ে গেল । সেদিকে তাকিয়ে উন্মনার মনে হলো ,পুরুষ মানুষেরা আজও কতো নির্ভরযোগ্য । গ্রামের পথে দেখা হলে , মুখচোরা খোকনদা কখনো কথা বলে না । অথচ আজ রাত নটায় তার অসুবিধের কথা ভেবে…
মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সেই , উন্মনার চোখে কথায় কথায় জল আসে । আধো আলো অন্ধকারে সেটাকে বুঝতে না দিয়ে খুব নরম করে বললো–খোকনদা , আমার এই ব্যাগ আর শাড়ি সামলে , তোমার ভ্যানে বসতে আমার একটু অসুবিধে হবে। এইটুকু তো পথ ,পনেরো কুড়ি মিনিটেই পৌঁছে যাবো । তুমি বরং বাড়িতে একটা খবর দিও যে , আমি নেমে গেছি , বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে আসছি । আমার ফোনে আর চার্জ নেই,তাই ফোন করতে পারছি না। খোকনদা ম্লান হেসে বললো–ঠিক আছে । আমি খবর দিয়ে যাচ্ছি।এই পথে তোমার কোনো ভয় নেই দিদি।রাত এগারোটাতেও হেঁটে ফিরতে পারবে । গ্রামের গাছপালা, দূরের বন ,পাহাড় , বনের দেবতা — সবাই এই বনতুলসী গ্রামকে রক্ষা করে।আমি মুখ্যু মানুষ। এর বেশি কিছু জানি না। চলি । তুমি এসো । রাস্তা ছেড়ে নাবাল পথে আধো-আলো রাতছায়াতে নামতেই ,খোকনদার কথার সূত্রে উন্মনার হঠাৎ মনে পড়লো , গতকাল অনামিকাদির সান্ধ্য কফি আড্ডায় অমলেন্দুদার বলা কয়েকটা কথা। অমলেন্দু বলেছিলো– জানেন , আমাদের এই ছড়ানো বাংলা অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যতে কখনও জঙ্গলের রাজত্ব হবে না । তার কারণ,বাংলার অন্তর ধারণ করে রয়েছে দুজন প্রকৃতির সন্তানকে । একজন রূপসী বাংলার জীবনানন্দ দাশ , আরেকজন আরণ্যক ও অভিযাত্রিকের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সবসময় আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকেন।সুখে , দুঃখে , বিপদে , সম্পদে। একদিন জঙ্গলে হাতির খবর নিতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম । টাওয়ার পাচ্ছিলাম না যে , কোনো সাংবাদিক বন্ধুকে খবর দেবো । একটা আলগা পাথরের ওপর বসে,’রূপসী বাংলা’ থেকে একটার পর একটা কবিতা আওড়াতে থাকলাম। আর , ‘অভিযাত্রিক’-এ পায়ে হেঁটে ভাগলপুর থেকে ত্রিকূট পাহাড় পর্যন্ত প্রতিদিনের দিনলিপি মনে মনে ভাবতে থাকলাম। এই দুই মহামানবের লেখার মধ্যে ডুবে গিয়ে ,বুনো হাতি , হায়নার ভয় সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছিলাম। ভোরের আলো ফোটার পর… যা হোক,সে তো অন্য গল্প। আপনারা এই অভ্যেসটা ট্রাই করে দেখতে পারেন। আমি যখন শহরে যাই, তখন ভিড় বাসের দম বন্ধ অবস্থায় আর অল্প আলোতেও অভিযাত্রিকের পাতায় ডুবে যাই । গোটা বইটাই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ,তবু আবার পড়ি…
আজ,এই রাত নটা দশের একলা চলায় , উন্মনা প্রথমে ব্যর্থ চেষ্টা করলো জীবনানন্দের রূপসী বাংলা থেকে বিড়বিড় করার , কেননা লজ্জায় গতকাল বলতে পারেনি যে , অভিযাত্রিক ওর আদৌ পড়া হয়নি। বিভূতিভূষণ ,মানিক, তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়া হয়ে গেলেও অভিযাত্রিক কখনো ছুঁয়েও দেখেনি উন্মনা। এটা ওর নিজস্ব লজ্জা। আজ ওর এই একলা চলার পথে তাই মনে মনে একবার স্বামী প্রণতোষকেই ডেকে নিলো।তিনবছর আগে ফেলে আসা ওদের যৌথ সংসারের জীবনে , রাতের রূপসী অন্ধকারে যখন স্বামীর সঙ্গে কখনো হাঁটতে বেরোতো,তালবাগিচার চেনা পথ ছাড়িয়ে মুম্বাই রোডের দিকে নির্জনতায় , অথবা ডিভিসি মোড় ছাড়ানো আই আই টির দিকের একান্তে , তখন উন্মনার ডান হাত জড়িয়ে থাকতো সুঠাম ও সুভদ্র স্বামী প্রাণতোষের বাহু।
ভীষণ ভালো লাগতো সেই মুহূর্তগুলো । আত্মজা করতোয়া আসবার কোনো সুসংবাদ তখনও উন্মনার শরীরে নিহিত হয়নি। সেই সময় , দুই তিন চার কিলোমিটার , রাতের সখ করে হাঁটায় প্রাণতোষের পুরুষ বাহু ছুঁয়ে যেতো উন্মনার তিতিরের মতো নরম বুকের স্পর্শ । জীবনসঙ্গী যতদিন মাথার ওপরে ছাদ , তারপর ছাদ ছাড়িয়ে আকাশ হয়ে থাকে , নারী জীবনে সেই পরম তৃপ্তির অনুভূতি বোধহয় তুলনাহীন। উন্মনা ঈশ্বরবাদী হলেও ভাগ্য গণনায় বিশ্বাসহীন। বরং , বিজ্ঞানের যুক্তিবাদ তাকে অনেক বেশি আলোড়িত করে । তাই বিচ্ছেদের পেছনে ভাগ্যের দোহাই দেওয়ার মানসিকতা তার নেই । পাত্রের জলের মতো বর্তমানটাকে মেনে নিয়ে , ভবিষ্যতের দিকে আশাবাদী হয়ে শান্ত তাকিয়ে থাকাটাকেই তার স্বাভাবিক বলে মনে হয় ।
পায়ে পায়ে কখন যেন দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গেলো । একটু দূরের থেকে , বাগান পেরিয়ে ছোট্ট ঘরের আলো দেখতে পেয়ে , মেয়ে বা মায়ের কথা মনে পড়ে সে আকুল হলো না।ওই আলোর বৃত্তের মধ্যে ছোট্ট মেয়ে করতোয়ার কচি গলার ডাক সে এখুনি শুনতে পাবে । কিন্তু অতীতটা ক্রমশ যেন একটা পাহাড়ের অন্তরালে চলে যাচ্ছে ! সুখী দাম্পত্যের বিছানার নীল অন্ধকারে , শুধু আঙুলের স্পর্শ দিয়ে স্বামীর মুখের প্রতিটি রেখা সে অনুভব করতে পারতো হৃদয় দিয়ে , নগ্নতা ও মগ্নতায় একাকার হয়ে ! আজ সেই স্বামীর মুখটাই সে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে না তো !প্রাণতোষের সুপুরুষ অবয়ব ক্রমশ শুশুনিয়া পাহাড়ের আড়ালে চলে যাচ্ছে না তো ? মহাশূন্যতায় মিলিয়ে যাচ্ছে না তো ? কালো রঙের কাশ্মীরি শালের আড়ালে উন্মনা যেন প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো ! গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর। মা মৃত্তিকার সামনে দাঁড়িয়ে , ব্যাগ খুলে ক্যাডবেরি আর উপহারগুলো মেয়ের হাতে দিতে দিতে বলে উঠলো– জানো মা ,জানো তোয়া , আমার এই ঝোলার মধ্যে এত্তো গল্প , এত্তো রূপকথা, এত্তো চুপকথা লুকিয়ে আছে ! সব তোমাদের বলবো । মা তুমি ছোটোবেলায় সেই গানটা শিখিয়েছিলে ,মনে আছে ? মৃত্তিকা মুহূর্তে ছেলেমানুষ হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো–আমি জানি , তুই কোন গানটার কথা বলছিস ! বলেই সুরেলা বয়স্ক গলায় গেয়ে উঠলো–‌পুতুল নেবে গো পুতুল….
তারপর আটান্ন বছরের মা আর আটত্রিশ বছরের মেয়ে অনায়াসে ফিরে গেলো তাদের কিশোরীবেলায় সেই কবেকার শ্যামল মিত্রের গানে গানে–
আমার এই ছোট্ট ঝুলি‌, এতে রাম বারণ আছে,দেখে যা নিজের চোখে, হনুমান কেমন নাচে,এ সুযোগ পাবে না আর,বলো ভাই কি দাম দেবে, পুতুল নেবে গো পুতুল…
করতোয়ার ডাগর চোখ ও এক আকাশ বিস্ময় দুহাতে চারটে ক্যাডবেরি ধরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো মা আর দিম্মার ছেলেমানুষির দিকে !
তারপর? তারপর আর কি ? অনেক দূরের শুশুনিয়া পাহাড় থেকে রাতের হাওয়া বয়ে আনলো জানুয়ারি শেষের কনকনে হাওয়া। মেয়ের জমে থাকা অভিমান আদরে আদরে মুছে দিয়ে , খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে , মায়ের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসলো উন্মনা । মায়ের হাতে অদ্ভুত একটা মেথি ফোড়নের যেমন তেমন পাঁচমিশালি তরকারি , সঙ্গে মেদিনীপুরের বড়ির আহ্লাদ মিশে গেলে , টুকরো টুকরো গরম রুটির সাথে যেন অমৃত হয়ে ওঠে। সঙ্গে তুলতুলে বেগুন ভাজা — গ্রামের চাষির কাছ থেকে কেনা –মা জানালো। স্বল্পাহারী মা ও মেয়ে দুজনেই ঝোঁকের মাথায় একটু বেশিই খেয়ে ফেললো মনে হয় । খিদেও পেয়েছিলো জমিয়ে। মৃত্তিকা দেখছে , তার আত্মজা চাঁপাকলির মতো আঙুলগুলো কী অদ্ভুত সুখে চাটছে। মায়ের নিম্নগামী স্নেহ একই সঙ্গে নরম চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ে আর নাতনির দিকে।পাশের ঘরের আবছা নীল আলোতে ঘুমিয়ে আছ করতোয়া । ছোট্ট এই ছায়াঘেরা বাড়িটায় তিন প্রজন্মের নারীজন্ম যেন এলিয়ে দিয়েছে , সুখে থাকার ঠিকানা লেখা– যাও পাখিদের । মা মৃত্তিকা তাঁর অভিজ্ঞ জীবনের শিকড়ে গিয়ে এইটুকু বুঝতে পারছে ,গত দুটো দিন একটা রাতে তার মেয়ে বেঁচে থাকার একটা নতুন দিগন্ত খুঁজে পেয়েছে । মা আরও বুঝতে পারে–জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলতে আমরা যা বুঝি , তা আসলে বোধসম্পন্ন মানুষের মেধা ও শ্রমের অর্জন। সেই ‘অর্জন’কে ছুঁতে চেষ্টা করছে তার মেয়ে উন্মনা। তার নিজের হাতে গড়া সেই ছোট্টবেলার পুতুল । হঠাৎ চোখে জল এসে গেলেই ,মায়েরা এমন ভাব করে , যেন চোখে আলটপকা কিছু একটা ঢুকেছে। বেসিনের দিকে পা বাড়ানো মাকে বোঝবার চেষ্টা করে উন্মনা।জীবনে বহুবার বেদনায় টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মাকে কাঁদতে দেখেছে উন্মনা, কিন্তু আজ মনে হলো , এ কান্নাটা একটু অন্যরকম।
মেয়েকে মায়ের ঘরে শুইয়ে ,উন্মনা নিজের ছোট্ট ঘরটাতে আধশোয়া হয়ে , মৃদু আলোর টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলো । তারপর কতদিন বাদে একটা আশ্চর্য ঝর্ণা কলমে , মন্ত্রমুগ্ধের মতো কয়েকটা লাইন লিখলো খাতা খুলে—
তোমার জন্যে শালমহুয়া ঝরায় পাতা
তোমার জন্যে মাঠ পেতেছে ধূসর খাতা
তোমার জন্যে ট্রেন থেমে যায় শীতের বনে
তোমার হৃদয় শিশিরপাতের শব্দ শোনে ?
তোমার সঙ্গে অবাক বেলার ঢেউ উচ্ছ্বাস
তোমার চোখে বেড়াতে আসে ভোরের বাতাস,..
নিজের সৃষ্টি করা কবিতার লাইনগুলোর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলো উন্মনা । এত নিশ্চুপ রাত তার জীবনে খুব কমই এসেছে । সমূহ ও বিস্তৃত স্তব্ধতার মধ্যে একটি নারীজন্ম ভাবছে–পৃথিবীতে একজন মানুষ অন্তত তার কথাকে মর্যাদা দিলো । তার স্বতস্ফূর্ত ইচ্ছের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে , একটা মানুষ এক মুহূর্তে নিজেকে বদলে ফেললো ! সম্ভব ? এমন হওয়া সম্ভব !

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।