|| আগমনী সংখ্যায় || অনিন্দিতা

আজ প্রভাতে যে সুর ও শুনি

যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী ।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।
শঙ্খ ধ্বনি ও স্তোত্র পাঠ শেষে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ কণ্ঠে শুরু হলো “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;….”
“অপু! অপু, উঠে পড়ো। চন্ডী পাঠ শুরু হয়ে গেছে। তোমাকে কতদিন বলেছি চন্ডী পাঠ শুরুর আগে বিছানা ছেড়ে উঠবে। স্নান টানের তো বালাই নেই, অন্তত বিছানা থেকে উঠে বাইরের ঘরে এসে বসতে তো পারো?”, একটু ভারিক্কি চালে ও কিছুটা শাসনের সুরে বলে উঠলেন আর্য্যতীর্থ মহাশয় ওরফে অপুর বাবা।
“উফ বাবা! এতো সকালে উঠে কি হবে? এমনিতেও আমি এই স্তোত্র পাঠের মানে বুঝি না। আর পরে তো টিভি তে দেখাবেই, সেখানে না হয় দেখে নেব। মহালয়া দেখা বা শোনা কিছু একটা হলেই তো হলো!”, ঘুম চোখে বিছানাতে শুয়েই সে বাবার উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলে উঠলো।
“আমি যা বলেছি তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়। এতো কথার কৈফিয়ত আমি দিতে বলি নি তোমায়। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরের ঘরে এসো”, এবার কিছুটা কড়া গলায় আর্য্যতীর্থ মহাশয় কথা গুলো বলে ঠাকুর ঘরের দিকে চলে গেলেন।
রেডিও তে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র পাঠ শুনতে শুনতে সাদা ধুতি পরিহিতা ও পৈতা ধারী শ্রী আর্য্যতীর্থ মহাশয় সোজা হয়ে বসে দুর্গা মন্ত্র জপতে শুরু করলেন।
তার মতে দুর্গা পুজো তে থাকে দুটি সন্ধিক্ষন। এক মহাঅষ্টমীর শেষ ও মহানবমীর শুরুর পুণ্য লগ্নে সন্ধি পুজো আর দুই এই মহালয়ার দিন ভোরে যখন দেবী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন করেন। এই দুই সন্ধিক্ষণে দুর্গা মন্ত্র জপ নাকি দেবীর আরাধনার এক উত্তম পথ। তাই পাড়ার আর পাঁচটা বাড়িতে শুয়ে শুয়ে মহালয়া শোনার প্রথা থাকলেও, এই বাড়িতে তা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।
মহালয়ার ভোরে চিরাচরিত স্বভাবে চন্ডী পাঠের আগে অপুর বাবা স্নান করে সাদা ধুতি পরে শুদ্ধ হয়ে ঠাকুর ঘরে বসে দুর্গা মন্ত্র জপ করেন। যতক্ষন রেডিও তে চন্ডী পাঠ হয়, ততক্ষণ তিনি একই ভাবে তার আসনে অধিষ্ঠ থেকে দুর্গা প্রণাম করতে থাকেন। চন্ডী পাঠ শেষে, একই ভূষণে তিনি গঙ্গায় যান তর্পণ করতে। এবছর ও তার অন্যথা হবে না।
অপু ওরফে অনির্বান চক্রবর্তী। শ্রী আর্য্যতীর্থ চক্রবর্তী ও শ্রীমতি জয়তী চক্রবর্তীর একমাত্র সন্তান। সে এখন ক্লাস 10এর ছাত্র। পড়াশুনা, আচার, ব্যবহার সব কিছু ঠিক থাকলেও, সে যেই জিনিসে কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু পায় না সেই দিকে সে একেবারেই এগোয় না। আর সকালে ঘুম থেকে ওঠা! সে যেন বিষের সমান। আর এই রেডিওতে চন্ডীর পাঠ যেন তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। অপু কিছুতেই বোঝে না কি করে এই কঠিন কঠিন কথা গুলো কেউ বুঝতে পারে! যদিও বা তার বাবা অনেক বার তাকে বলেছিল যে এই চন্ডী পাঠ তাকে বুঝিয়ে দেবে, কিন্তু সে না করে দিয়েছে। ওই যে তার পছন্দের নয়।
সে যাই হোক, যতই তার বয়স ১৬বছর হোক না কেন, তার বাবার কথা অমান্য করার সাহস তার নেই। তাই সে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরের ঘরে চলে গেল। বাইরের ঘরের সাথেই লাগোয়া ঠাকুর ঘর। সে উপস্থিত হয়ে দেখলো তার বাবা যথারীতি ঠাকুর ঘরে আর তার মা তার বাবার পাশে পরিস্কার লাল-সাদা কাপড় পরে হাত জোড় করে বসে আছেন।
অপু তার বাবার ওপর কথা বলার সাহস পায় না। কিন্তু সে অনেক বার তার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যে সে তো এগুলোর কিছুই বোঝে না, তারপরেও কেন প্রত্যেক বার তাকেও সকালে উঠতে হয়! তার মায়ের প্রতিবার একই কথা, সকালে উঠলে নাকি শরীর মন সব ভালো থাকে। আর এই দিন নাকি দুর্গা ঠাকুরের কাছে যা চাওয়া যায় তিনি তাই দেন।
“উফ! বিরক্তিকর। মা কে বলেও কোনো লাভ নেই। এই বাড়িতে তার কষ্টটা কেউ ই বুঝবে না। সে একবার ভালো করে পড়াশুনা শিখে চাকরি পেয়ে যাক। তারপর সে বিদেশে চলে যাবে। যত সব উদ্ভট জিনিষ।” এসব ভাবতে ভাবতেই অপু সোফাটার উপর গিয়ে বসলো। ঠিক তখনই রেডিও তে শুরু হলো “বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন, আজ প্রভাতে সে সুর ও শুনে…”
এরপর মহালয়া চলতে থাকে তার গতিতে, আর অপু সোফায় হেলান দিয়ে আরেক রাউন্ড ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
স্তোত্র পাঠ শেষে অপুর বাবা আসন ত্যাগ করেন এবং তর্পণ করার জন্য গঙ্গা তে যাওয়ার সব রকম প্রস্তুতি শুরু করেন। তার সাথে হাত লাগান অপুর মা।
“অপু, এখানে এসেও ঘুমিয়ে পড়েছিস? উফ তোকে আর মানুষ করতে পারলাম না!”, সোফার ওপর ঘুমন্ত অপু কে দেখে রাগের সুরে বলে উঠলেন তার বাবা।
“কি..! কি..! কি হয়েছে!”, বাবার ডাকে একপ্রকার ধর ফর করে উঠে বসলো অপু।
“কিছু হয় নি। মহালয়া শোনার নামে ঘুমিয়ে তো একেবারে উদ্ধার করেছো আমায়। এবার তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নাও। আমি তর্পণ করতে যাবো গঙ্গায়, তুমি যাবে আমার সাথে” বললেন অপুর বাবা।
“এটা কি হলো মা?”, কিছুক্ষন হতভম্বের মতো বসে থেকে, মায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো সে।
“আমি জানি না। তোর বাবা যা ভালো বুঝেছেন তাই বললেন। বেশি কথা না বাড়িয়ে উনি যা বললেন তাই কর”, জয়তী দেবীর পরিষ্কার উত্তর ছেলের প্রতি।
প্রতিবার মহালয়ার দিন সকালের এই বিরক্তিকর কাজ গুলো এই স্তোত্র পাঠ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতো। তারপর বাবা তর্পণ এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলে অপু আবার গিয়ে বিছানায় এক লম্বা ঘুম দিতো। বাবা ফিরতে ফিরতে দুপুর। কিন্তু এই বার হঠাৎ কি হলো! তাকে কেন যেতে বলছে বাবা….!
কিছুতেই উত্তর খুঁজে না পেয়ে, শেষে বাবার সাথে তর্পণ এ যাবার জন্য রেডি হতে চলে গেল। কারণ তার কথা অমান্য করার সাহস যে কারুর নেই।
“বাবা…ও বাবা! কি ভাবছো? বলো তারপর কি হলো? মহালয়ার বাকি গল্প টা বলো… আর তারপর যে বললে, পূর্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে এই দিন কি যেন হয়! সেটা বলবে..”
ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফেরে অপু অর্থাৎ অনির্বান এর। ছেলেকে মহালয়ার গল্প বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো সে। আজ প্রায় ২৫বছর পরে সেও একজন বাবা। তার ছেলে অর্কদীপ্ত চক্রবর্তী।
কিন্তু সেদিনের পরিবেশ আর আজকের পরিবেশের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সে এখন একজন নাম করা সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আজ আর সে গঙ্গা নদীর ধারে সেই ছোট্ট দোতলা বাড়িতে থাকে না। এখন সে টেমস নদীর ধারে এক বড়ো ইমারতের বেশ কিছুটা টপ ফ্লোরের বাসিন্দা। যেখান থেকে লন্ডন শহরটা বেশ পরিস্কার ই দেখা যায় কিন্তু কলকাতার গন্ধ, সেই পুজোর আমেজ, ছোটবেলার টান কিছুই পাওয়া যায় না। গঙ্গা নদীর ধারের মতো যে টেমস নদীর ধারে কাশফুল ফোটে না। এখানে বাঙালি কমিউনিটি তে যদিও দুর্গা পুজো হয়, কিন্তু তাতে যেন ঠিক প্রাণ নেই। সবই কেমন যেন ফ্যাকাশে আর বড্ড লোক দেখানো।
২৫বছর আগের সেদিন তর্পণ ফেরত তার বাবা কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল। যদিও সেদিন সেগুলো তার শুনতে মন চায় নি, তবুও…
“দেখ অপু আমি জানি, আজ আমি তোকে হঠাৎ তর্পণ এ নিয়ে আসাতে তুই বেশ বিরক্ত হয়েছিস। তুই তো মহালয়ার দিন ভোরেই উঠতে চাস না। তবে দেখ বাবা, আমি জানি তোরা সবাই আধুনিক ভাবে গড়ে উঠছিস। আমরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম যারা এসব মানছি। এই মহালয়া, তর্পণ, নানারকম আচার বিধি, সবই। কিন্তু কি বলতো এগুলো হলো আমাদের সংস্কৃতি। আধুনিক একশবার হও, তাতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে নয়। যেই লোকাচার, নিয়ম, সংস্কৃতি তোমার পরিচয় তাকে কোনো দিনও অবহেলা নয়। এই যে তর্পণ, এর মানে হলো তোমার যে সকল পূর্ব পুরুষরা আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে আজ জল দান করতে হয়। তাতে অনেক পুণ্য হয়। তারা আশীর্বাদ করেন। আর এটা তখনই করা হয় যখন তোমার নিজের বাবা মা মারা যাবেন। তার আগে নয়।”
সেই কথা গুলো আজও অপুর কানে স্পষ্ট বাজে। সেদিন বিরক্ত হলেও নিজের সংস্কৃতি, আচার, সে ভোলে নি। নিজের ছেলেকে সেই আদর্শেই বড়ো করে তুলেছে। তাই তো আজ সে মহালয়ার ও তর্পণ এর গল্প নিয়ে বসেছিল।
কারণ কাল যে মহালয়া। কাল আবার ও বাবা ছেলে মিলে মহালয়া শুনবে, সেই ভোর ৪টে থেকেই।
তবে কিছুটা অমিল, বিদেশের মাটিতে তো আর দেশি রেডিও চ্যানেল পাওয়া যায় না। তাই কাল মহালয়া চলবে ইউটিউবে। বাবা ছেলে সোফায় বসে আবারও শুনবে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে, “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;….”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।