• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৯)

রূপকথা পৃথিবীর

আমি তো জানিনা স্বপ্ন ফুরালে কেন এত ঘুম পায় ?
আমি যে দেখিনি শালিখ,চড়ুই কোথায় হারিয়ে যায় ?
আমি তো শুনিনি কেন,ছোটোবেলা বন্ধু হারিয়ে চুপ?
এখনও বাতাসে ঝরা পাতাদের গন্ধ বিলোয় ধুপ!
মা আজ চার মাস হলো হাসপাতালের চিকিৎসা আর ভালোবাসায় বন্দী। আমি যাকে ভিতরের পৃথিবী বলেছিলাম, না না, ভেবেছিলাম– সেটা আসলে সুন্দর একটা ঘর- সংসার। তবে, একটু অন্যরকম ।
আমি কিভাবে জানলাম ? মাকে যখন শক দেওয়া হতো, সেই দিনগুলোতে বাবা আমাকে নিয়ে যেতো । কী জন্য তা আমি জানিনা , তবু আমাকে যেতেই হতো। দক্ষিনেশ্বর থেকে শ্যামবাজার হয়ে ৩৩ নম্বর দোতলা বাসে চড়ে, সেই বন্ডেল গেট , ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে, সাইকেল রিক্সায় সেই বাড়িটার কাছে । এখানে কোথাও আমার মা আছে। কিন্তু বাড়িটার বাইরে থেকে কোন মা মা গন্ধ নেই । ওষুধ বা ডেটলের গন্ধও নেই ; শুধু একটা .. আচ্ছা কিসের গন্ধ বলতো দিদি ? অনেক পুরনো দিনের গন্ধ? সেই মার মুখে শোনা কানন দেবী , কে এল সায়গল ,পঙ্কজ মল্লিক আর রাইচাঁদ বড়ালের গানের গন্ধ? মা’র সঙ্গে আমার দেখা হতো না। আমি শুধু বাইরে মায়ের দু-তিন প্রস্থ পোশাক নিয়ে বসে থাকতাম , আর একটা ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যেতাম– কোনো জন্মদিনে পাওয়া উপহারের বইগুলো। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের–মরণের ডঙ্কা বাজে, মিসমিদের কবচ, আবার যখের ধন, আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের–গুণধর ছেলে।বাসে বসেই পড়তে পড়তে যেতাম আর বাবা দূর থেকে চোখ পাকাতো, যার অর্থ হলো বাসে বসে বই পড়লে চোখটা নষ্ট হবে। দিদিভাই , তুই বলতো — তোর আমার দাদার এমনকি বাবার আর মামার বাড়ির সুন্দর মানুষগুলোর ভালো চোখ দিয়ে কি এইসব দৃশ্য দেখার কথা ছিল ? আমি যদি গিয়ে দেখি যে, ইলেকট্রিক শক দিতে গিয়ে মা……
তাহলে কোন ভালো চোখ দিয়ে মায়ের মৃতদেহ দেখব ? তার চেয়ে এই ভালো–
জানিস দিদি ,ও একটা কথা তো বলাই হয়নি– মা নাকি খুব জমিয়ে দিয়েছে হাসপাতালে। মহিলা রোগীরা নাকি স্মৃতিকণাদি বলতে অজ্ঞান ।সব সময় তারা মায়ের কাছে গান শুনতে চায় ,আর আমি জানি, মা বেছে বেছে বাবার ভালোলাগা গানগুলোই তাদের শোনায়। একজন নার্স আমায় সেদিন বলছিলেন– তুমি গান শিখেছ মায়ের কাছে ? আমি হাঁদা গঙ্গারামের মত মাথা নাড়লাম, অর্থাৎ না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আহা যেমন গলা তেমন সুর । সেদিনকে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন স্মৃতিকণাদি । আমি সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট হতে চেয়ে বললাম–আমি জানি কোন্ গান দুটো। তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি গড়গড় করে বলে গেলাম– এক নম্বর গান হল — তাই তোমার আনন্দ আমার’পর , তুমি তাই এসেছ নীচে— আমায় নইলে , ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে… নার্স দিদি বলে উঠলো– আরেকটা? সেটাও তুমি জানো ? আমি বললাম — জানি কিনা জানিনা , তবে মনে হচ্ছে, জানি । বলেই আবার বলে উঠলাম — জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, মনে রেখো, আমি যে গান গেয়েছিলাম , মনে রেখো… ভদ্রমহিলার মুখের অবস্থা দেখে আমার নিজেরই মায়া হলো। তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন–তার মানে তোমার মা তো সব সময় বাড়িতে গানের চর্চা করেন । তাই তুমি এত জানো । আমি এবার সত্যিই লজ্জা পেয়ে গেলাম। মুখ ফুটে তো আর বলতে পারিনা যে, আমাদের বাবা, মানে, মা’র– ওগো শুনছো কে শোনাবার জন্যই ……অথচ সে তো একটাও শুনতে পাচ্ছে না। দিদিভাই , মা বাবার এত ভালোবাসা — তবু মাকে পাগল হয়ে যেতে হলো কেন রে ? আমার একটা দৃশ্য মনে আছে যা মায়ের মনের উপর খুব চাপ সৃষ্টি করেছিল। মা পাড়ার জলসায় গান গাইতে উঠলেই নির্দিষ্ট কয়েকটা বাড়ির মহিলারা সঙ্গে সঙ্গে নানা ছুতোয় হাই তোলার ভঙ্গি করে বাড়ির পথে পা বাড়াতো। আমার মার গান শেষ হলেই পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে এসে হারানো জায়গা দখল নিতো। মা প্রথম প্রথম আমল না দিলেও পরের দিকে দেখেছি , এই কথা বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলতো। না , আমি এটাই যে আসল কারণ–সেটা বলতে চাচ্ছি না; মা’র দিদিমাও তো …এই রোগটা আসলে বংশগত। তোর আমার কারুর রেহাই নেই এখান থেকে বোধহয। শুধু বাবার কথা ভাব তো ! বাবা নিজের অফিস, সংসার, আমাদের পড়াশুনো আর রিক্রিয়েশন ক্লাবের আনন্দময় জীবনটাকে সম্পূর্ণ নির্বাসন দিয়ে দিয়েছে ,শুধু মা’র জন্য। বাবার বুকে আজও কতো আশা — মা একদিন ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে, আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে । সেই রকম রসিকতা আর গানে মাতিয়ে রাখবে সারা বাড়ি। গোটা মামার বাড়ি বড়দি বড়দি বলে ছুটে আসবে। তোর মনে আছে দিদি ? মায়ের সঙ্গে কালীবাড়িতে গেলে, ডালার দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যেতে যেতে, মা বারে বারে ফিরে তাকাতো ,কী কারণে? ডালার দোকানিকাকু চিৎকার করছে– ও বড়দি আসুন না.. আমার দোকানে জুতো রাখতে পারবেন। পুজোর ফল ফুল মিষ্টি ধূপ… সব এখানেই পাবেন। ‘বড়দি’ বলে ডাক আমাদের মাকে মুহূর্তের মধ্যে দক্ষিনেশ্বর থেকে চেতলায় নিয়ে চলে যেত। মা বারবার মনে করতো,পাঁচ মামার অন্তত পঞ্চাশ জন বন্ধুদের মধ‍্যে কেউ কালীবাড়ি বেড়াতে এসে, মাকে পেছন থেকে বড়দি বলে ডাকছে। কী আশ্চর্য! তাই না ? মা কখনও বাস্তবটাকে মানতে চাইছে না । এরকম ডালার দোকানির ডাক তো স্বাভাবিক। সেটাও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না মা। পাড়ার মধ্যে যে বিশ্রী দলাদলি থাকে , এটাও কি মা কখনও মেনে নিতে পেরেছে ? তাই নিজেকে ভাঙচুর করতে করতে একদিন রাগে দুঃখে ,লাথি মেরে ভাতের হাঁড়িটাই উল্টে দিলো।আমাদের রান্নাঘরের সমস্ত শান্তি আর তোলা উনুনের আঁচ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে গেল কোণায় কোণায় জ্বলন্ত কয়লা হয়ে। মগের পর মগ জল ঢেলে হয়তো সে আগুন নেভানো গেল ; তবু মায়ের আপনার চেয়ে আপন যে রান্নাঘর , তার দেয়ালে দেয়ালেও আংরা আগুনের দাগ থেকে গেল । মা হয়তো ভালো হয়ে ফিরে আসবে ঠিকই, আবার আমাদের পাড়ার দল পাকানো দিদি, কাকীমারা, হাসতে হাসতে বৌদি বৌদি, কাকিমা কাকিমা বলে মায়ের হারমোনিয়ামের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে। যেন কত আপন জন ! আর মা, সবকিছু ভুলে আবার তাদের গান শেখাতে বসবে।পনেরোই আগস্টের প্রভাত ফেরীর গান —
চল চল চল ,
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল , নিম্নে উতলা ধরণীতল ,
অরুণ প্রাতের তরুণদল,
চল রে চল রে চল।
কিন্তু তুই দেখে নিস দিদিভাই– ইলেকট্রিক শক আর কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ মাকে আর কিছুতেই তার আগের জীবনটা ফিরিয়ে দেবে না। তুই তো কিছুদিন পরে কলেজে চলে যাবি, তারপর তোর বিয়ে হয়ে যাবে । দাদা কোথায় চাকরি নিয়ে থাকবে, তা কে জানে ? আমি কিন্তু মাকে ছেড়ে কোনদিনও কোথাও যাবো না ।
ডাক্তার নাকি বলেছেন যে, এই রোগে ওষুধ কখনও বন্ধ করা যায় না। তার মানে, আমি চিরদিন ওই নস‍্যির ডিবের মতো , ছোট ছোট কৌটো থেকে মাকে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে যাব, আর আশা করবো–মা আশা ভোঁসলের গলায় আবার গেয়ে উঠবে — আমায় তুমি যে ভালবেসেছো , জীবনে যে তাই দোলা লাগালো, প্রাণের পরীর ঘুম ভাঙালো…
ডাক্তাররা বলেছেন — পেশেন্টকে যেন সারাদিন যতটা পারা যায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় ,আর কোন উত্তেজনার ঘটনার মধ্যে তাকে যেনো না জড়ানো হয়। তাহলে মা’র সুন্দর নিষ্পাপ জীবনটা ডাক্তারবাবুদের হাতের মুঠোর মধ্যে এভাবেই চলে গেল ?
আর, তোর আমার অন্যায়? দিদি , মা তো কোনদিনও জানতে পারবে না যে , হাসপাতালে ঢোকার পরে মায়ের লক্ষ্মীর ঘট থেকে কায়দা করে পয়সা নিয়ে , আমরা দুই ভাইবোন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে স্বপনকুমারের রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের বইগুলো কিনেছি । আসলে কিনতে চাইনি, মা’র লক্ষ্মীর ঘটের পয়সা চুরি করতে চাইনি ; কিন্তু বাড়ির সামনে এসে যদি কোন ফেরিওয়ালা ডাক দেয় — স্বপনকুমারের রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ কিনবেন ? ও দিদি, বিশ্বচক্র সিরিজের সবগুলো বই আছে আমার কাছে…. দীপক চ্যাটার্জি আর রতনলালের গোয়েন্দাগিরি — চলন্ত ছায়া , হিংসার অন্ধকার , উড়ন্ত বিমানে চূড়ান্ত ডাকাতি…. একসাথে তিনটে বই নিলে ,আর একটা হাফ দামে দিয়ে দেবো। আসুন,আসুন…….
আর , আমরা তখন মা বাবা সবার কথা ভুলে , সমস্ত সুশিক্ষা ভুলে , সেফটিপিন দিয়ে লক্ষ্মীর ঘটের ফুটো থেকে চার আনা আটা আনাগুলো বার করছি। স্বপনকুমারের বইগুলো না পড়লে বেঁচে থাকাটাই যে অর্থহীন হয়ে যাবে !
আচ্ছা দিদি, মা হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে তুই আমি কি একসঙ্গে ঘট থেকে পয়সা চুরির পাপ স্বীকার করবো ? নাকি,মা নিজেই ভুলে যাবে তার সিঁদুর ছোঁয়ানো লক্ষ্মীর ঘটের কথা ? সেই যে লক্ষ্মীর পাঁচালীতে গড়গড় করে পড়তাম–
লক্ষ্মীর ভান্ডার স্থাপি
প্রতি ঘরে ঘরে,
রাখিবে তন্ডুল
তাতে এক মুষ্টি করে।
সঞ্চয়ের পথ ইহা জানিবে সকলে,
দুঃসময়ে সুখী হবে তুমি এর ফলে।
দিদি , মা আমাদের ক্ষমা করবে তো ? সত্যিই করবে তো ? নাকি হেসে বলবে — আচ্ছা যা.. সব ভুলে যা… আজ রাতে কি খাবি বল– গরম ভাতের সাথে ঝাল ঝাল, কষা কষা ডিমের কারি আর নরম করে আলুভাজা আর লক্ষ্মী ঘি… কী ছোটো পুত্তুর… চলবে তো ?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।