অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ২১)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

আছে দিগন্ত,আছে তো বাংলাভাষা,
নেই আঁধারের এতটুকু হাহাকার;
শীত শেষ হলে, কিংশুক ডেকে নেবে,
কবিতা কাড়বে ? এমন সাধ্য কার ?

বাঁকুড়া স্টেশন থেকে বাসে করে গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে নামতেই , হালকা যাই যাই শীত আর অনাগত উন্মুখ বসন্ত যেন উন্মনাকে একই সঙ্গে স্বাগতম জানালো। ইচ্ছে করেই টোটোর পথটা হেঁটে ফিরলো উন্মনা।প্রতিটি পদক্ষেপেই নারীজন্মের দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। অর্ধেক জীবন আলো আঁধারে কাটানোর পর বাকি অর্ধেক জীবনের জন্য একটা গোটা কবিতা জন্ম পেয়ে গেছে সে! আরো কুড়ি বছর আগে অমলেন্দু স্যারের সঙ্গে দেখা হলে কী হতে,সেটা তর্কের বিষয়, কিন্তু যা এই মুহূর্তে সে পেল , যে আলোর ঠিকানা, যে কবিতার পথনির্দেশ,তাই বা কম কী ? মানুষের জীবনে তো অনেক কিছুর দরকার হয়না । অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য এগুলোর জন্য লড়াই করতে করতেই চেতনার ভুবনকে পাওয়ার জন্য সাধনা করা যায়‌ । আর সেই চেতনার জীবনটাই একজন মানুষকে হাত ধরে নিয়ে যায় গ্যালিলিও, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, আইনস্টাইন,কার্ল মার্কস , বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ , লেনিন , জীবনানন্দ , আরও কত উজ্জ্বল মণীষার কাছে। তার জন্য কোনো বিত্ত বৈভবের প্রয়োজন হয় না। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের প্রাচুর্য না থাকলেও অন্তরের সম্পদেই তাকে পাওয়া যায়। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চেয়েছে শিক্ষিত হতে‌। শব্দকে বর্ণমালায় এনেছে সে।আলতামিরার গুহাচিত্রে রেখে গেছে তার শিল্পী হয়ে ওঠার দুরন্ত আবেগ। আষাঢ়ের মেঘে মাদল বাজলে , সে ময়ূর ময়ূরীর মতো নেচে উঠেছে।জন্ম নিয়েছে নৃত্যকলা।কোকিলের পঞ্চম স্বর আর পাখিদের কলকন্ঠ থেকে জন্ম নিয়েছে ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিনী। উন্মনার অনুভূতিপ্রবণ অন্তর এই অনাগত বসন্তের শীত শীত হাওয়ায় মনে করিয়ে দিলো সেই কবে বাবার মুখে শোনা কথাগুলো — শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব , বিপ্লব আনে মুক্তি । বহিরঙ্গের বিপ্লব সমাজের পরিবর্তন ঘটায় । সেই বাহ্যিক বিপ্লব ঘটাতে হলে প্রয়োজন হয় মানুষের পরিণত মানসিকতা।সেই দৃঢ়তা মানুষ পায় বইয়ের পাতা থেকে । একটা ভালোবাসার কবিতা , একটা জেগে ওঠার ছোটোগল্প‌, একটা পাগল করা নাটক, একটা প্রাণিত হওয়ার উপন্যাস , একটা মননশীল প্রবন্ধ , একটা আশ্চর্য ভ্রমণ কাহিনি মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে ,উন্মনার উপলব্ধিতে তা ধীরে ধীরে কুঁড়ির মতো ফুটে উঠতে থাকলো । উন্মনা বুঝতে পারলো , মানুষের জীবনটা একটা বিশাল উপন্যাস। সেখানে অমলেন্দু স্যার যেন এক টুকরো সোনালি আলোর সকাল। বুঝতে পারলো , সমস্ত ভালোর হাত ধরে যাবতীয় কালোর বিরুদ্ধে এবার তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
‌ বাড়িতে এসেই যেন‌ আক্ষরিক অর্থেই হই হই শুরু করে দিলো উন্মনা। পারলে তখনই শুভব্রত আর প্রলয়কে ফোন করে বসে। তারপর মায়ের হাতের মুড়িমাখা আর চায়ের সামনে বসে , ছোট্ট করতোয়াকে জড়িয়ে উন্মনার সারাদিনের উচ্ছ্বাস যেন চাঁদের আলোর মতো গলে গলে পড়তে লাগলো। মা মৃত্তিকার চোখে যে নারীজন্ম , সেই আলো যেন উন্মনার চোখ ছুঁয়ে ছোট্ট তোয়ার চিবুকে এসে পড়লো । এমন আশ্চর্য আলো যে কোন স্বর্গে রচিত হয় ! আহা !
রাত এখন সাড়ে ন’টা ।কিছুটা সময় মেয়ের পড়াশোনাতে দেওয়ার পর, খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে , খাতার পাতায় এখন উন্মনার কয়েকটি অক্ষর ফুটে উঠছে। নরম বুকের নীচে চুলের গন্ধ লাগা বালিশ । সারা ঘরে কেমন একটা আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ লেগে আছে । অনেক কথা মনে এলেও সেটাকে কিছুতেই কবিতায় রূপ দিতে পারছে না উন্মনা । অক্ষরের পর অক্ষর লিখছে আর বিরক্ত হয়ে কেটে দিচ্ছে । কিন্তু সে অনুভব করছে ,তার কবিতা জন্ম তাকে দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতায় সে আশরীর তোলপাড় হয়ে উঠছে ক্রমশ। শূন্যে আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা আঁকাবার চেষ্টা করছে উন্মনা । একটা সাধারণ – অসাধারণ শান্ত মুখশ্রী । একজন বয়স্ক বিষণ্ণ পুরুষ । আর কয়েকটা শব্দ। না না শব্দ নয়‌ , শব্দব্রহ্ম। আচ্ছা কবিতা কোথা থেকে জন্ম নেয় ? হৃদয়ে না মস্তিষ্কে ? অনেক শব্দ এলেও সেই অমোঘ শব্দটি কিছুতেই আসছেনা ,যা তার কবিতার প্রথম লাইনের প্রথম হৃদয়ধ্বনি হবে। উন্মনার অনুভূতিতে সন্ধ্যা মুখার্জীর সেই কবেকার গান–ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে,বলে তুমি নাও আমাকে,আমায় কেন তেমনি কাছে ডাকলে না !
লতা যেমন ফুলশাখাকে ভালোবেসে জড়িয়ে থাকে..
নাঃ! আজ কিছুতেই কবিতা আসবেনা ! ওদিকে মেয়েকে খেতে দেওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। চট করে প্রলয়কেই ফোন করলো উন্মনা। কী আশ্চর্য ! প্রলয়ও তখন কবিতার ভাবনার মধ্যেই ছিলো।‌ হ্যালো বলতেই হেসে ফেললো–শোনো দিদিভাই,অন্য কেউ হলে ফোনটা কেটে দিতাম । তুমি বলে কাটলাম না । কিন্তু তুমি আমার কবিতাটা ঘেঁটে ঘ করে দিলে ।কী সুন্দর একটা লাইন মনে এসেছিল ! এক সেকেন্ডে দাঁড়াও । কথাটা লিখে রাখি। আচ্ছা।তুমিও লিখে রাখো লাইনটা।দেখি দুজনেই আলাদা করে চেষ্টা করি। খুব সাধারণ কথা । লিখবে দিদিভাই ? লাইনটা হলো —
না লেখা কাব্যের কাছে ।
আজ সারাদিন রুটি রুজির দৌড়ে থাকলেও , এই লাইনটা আমাকে বারবার নক করেছে,আমাকে তোলপাড় করেছে ।
–এসো দিদিভাই , আমরা দুজনেই চেষ্টা করি এই লাইনটা নিয়ে ।
— দূর ! তাই হয় নাকি ? তুমি কোথায় কবি প্রলয় ! আর কোথায় আমি ? আমি নিজেই একটা কবিতা লিখতে গিয়ে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছি । তুমি তো তাও একটা গোটা লাইন পেয়েছো ,আমি তো একটা জুতসই শব্দও পাচ্ছিনা।
প্রলয়ের গলায় সমর্থন ঝরে পড়লো– ঠিক বলেছো দিদিভাই , কবিতাজন্মের পথ বড় দুর্গম। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সারাজীবন চেষ্টা করেও হয়তো একটা সত্যিকারের কবিতা লিখে উঠতে পারে না । আবার উনিশশো তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় কলকাতার পথে পথে — এট্টু ফ্যান দাও মা , এট্টু ফ্যান দাও — ধ্বনি থেকে ডুকরে ওঠে কাস্তে’র কবি দিনেশ দাসের কলম —

এই আকাশ স্তব্ধ নীল
কোনোখানে যুদ্ধ নেই
হেথা আকাশ রুক্ষ নীল
নিম্নে ভিড় ভ্রষ্ট নীড়
মৌনমুক ভুখ মিছিল..

কবি প্রলয়ের গলায় আটকে থাকা কান্না — বলতো দিদিভাই ,ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল থেকে এর চাইতে ভালো কবিতা উঠে আসা সম্ভব ?
অথবা , রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র শেষ কবিতার শেষ লাইন–
তিনটি মাত্র শব্দ —
হে বন্ধু , বিদায়…
তুমি বলতো দিদিভাই , এর চাইতে অমোঘ উচ্চারণ আর কিছু হতে পারে ? যেন অমিত লাবণ্যর চিরদিনের বিচ্ছেদ বেদনার অনিবার্য গুহাচিত্র !
এরকম শত শত কবিতার উদাহরণ আছে দিদিভাই ,যা সত্যিকারের কবিতা। তেমন কবিতা লিখতে পারলে বুঝবো , আমারও কবিজন্ম বলে কিছু আছে । যাক তুমি বলো,কেন ফোন করলে? উন্মনার গলায় সমস্ত কথা আটকে গেছে প্রয়লের কথা শুনতে শুনতে। বাংলা ভাষাজননীকে দেবার মতো অনেক কিছু আছে কবি প্রলয়ের কলমে । এমন অতলস্পর্শী কবিমন যার আছে ,তার তিন টাকার কলমটাই কবি কালিদাসের খাগের কলম হয়ে উঠবে একদিন। উন্মনা শুধু অস্ফুট স্বরে বলতে পারলো — ভাই এসো, তুমি আমি শুভ অমলেন্দু স্যার, একটা কবিতা জীবন গড়ে তুলি। একটা টোটাল রেজারেকশান। একটা অভ্যুত্থান , একটা চেতনার বিপ্লব ।‌ দাঁড়াও শুভকে কনফারেন্স কলে ধরি ?
তারপর প্রায় একঘন্টা ধরে ওরা তিন কবিতাবন্ধু মিলে , কত কথা বললো,কথা দিয়ে কত ছবি আঁকলো ! ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করলো ! যে মাস্টার প্ল্যান তারা তিনবন্ধু মিলে উপুড় করে ফেলবে অমলেন্দু স্যারের কাছে — এক আকাশ কবিতাজন্ম গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি‌। যেন লালন ফকিরের উঠোনের মতো , কবিতা লেখার খাতা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় । যেন একটা তিন টাকার কলম আর দশ টাকার লেখার প্যাড বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে । যেন মানব জমিনের প্রতিটি মিলিমিটারে রামপ্রসাদের গানের সোনা , সোনার ফসল হয়ে জেগে ওঠে‌ । যেন দিনের রবি রাতের তারায় লেখা হয় মানুষের ইতিহাস ।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে অস্থির মনটাকে ছুঁচের ডগার মতো তীক্ষ্ণ ও স্থির করে উন্মনা যে শব্দের প্রতিমা আঁকলো,তার নাম কবিতা…

আজ শুধু কবিতার দিন
শব্দের প্রতিমারা সারারাত ঝরে যাবে বুকের উঠোনে
না লেখা কাব্যের কাছে জমে ওঠে ঋণ
অন্য বসন্তের রঙ পলাশের বনে।

হায়রে , ক্লান্ত মাঝরাতের কবি উন্মনা ভাবে– না-ছন্দে কবিতা লিখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ছন্দের কাছেই আবার ধরা পড়ে গেলাম ! পাশের ঘর থেকে মায়ের নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও রূপসী বাংলার সবুজ অন্ধকারে কেউ একজন কি তার জন্য এখনও জেগে আছে ? অন্তত একজনও কেউ ! জেগে আছে ?

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।