অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৬)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয় ঋতু

শীতের হাওয়ায় শালজঙ্গল
ডুলুং-এ এসে থামে
আপনভোলা কবি এসেছে
পাতাঝরা ঝাড়গ্রামে

কলকাতার সাংবাদিক মেঘলা নিজের উপস্থিতি খুব ভালো করে দাগিয়ে দিতে জানে। যে কোনো জমায়েতে ওর দিকে নজর দিতেই হবে । ঝাড়গ্রামে ওর বন্ধু শিক্ষিকা অনামিকার বাড়িতে বিকেল শেষ হতে না হতেই শনিবারের আড্ডা যেন তুঙ্গস্পর্শী আনন্দে ফেটে পড়লো । বেলপাহাড়ির প্রলয়, ফুলকুশমার শুভব্রত , বাঁকুড়ার মেলেডা গ্রামের বাচিকশিল্পী ও ডাক্তার অরুণাভ , আর আগামীকালের প্রধান বক্তা বাঁকুড়া জেলার সাংবাদিক ও কবি অমলেন্দু মন্ডল ইতিমধ্যেই হাজির । চা-কফি, মুড়ি মাখা , আর সিঙ্গাড়া , তেলে ভাজার বন্যা বইছে যেন । হাতে হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছে মেঘলার স্কুলের বন্ধু দরাজ দিল অনামিকা। মেঘলা , অনামিকার প্রাণনাথ অরুণোদয়কে ডেকে একহাত নিয়ে নিলো — এই যে মশাই , ঝাড়গ্রামে খুব তো রোমান্টিক ঘর সংসার পেতেছেন , কথায় কথায় ডুলুং নদী , চিল্কিগড়। ফেসবুকে আমার বন্ধুটাকে দেখতে পাই না কেন ? সেই স্কুলের বন্ধু ঝকঝকে অনামিকাকে কোথায় লুকিয়ে ফেললেন ? ব্যাঙ্ক চাকুরে অরুণোদয় কম যায় নাকি ? দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে, সবাইকে অবাক করে প্রায় কিশোর কুমারের গলায় গেয়ে উঠলো–
মেরী ভিগি ভিগি সী, পলকোঁ পে রহ গয় , যৈসে মেরে স্বপ্নে বিখর কে , জ্বলে মন তেরা ভি , কিসী কে মিলন কো , অনামিকা তু ভী তরসে…
আবার হৈ হৈ করে হাসির শব্দ যেন ঝনঝন করে বাসন পড়ার শব্দে একাকার হয়ে গেলো । অরুণোদয় আলতো করে যেন বাতাসকেই ঠোনা মারলো— তোমাদের ড্রাই আড্ডায় ভাই আমি নেই। কনকনে শীতের সন্ধ্যায় তোমরা চা কফিতে লটকে পড়ে আছো , আমার এসময় হুইস্কি না হলে চলেই না । কেমন কবি তোমরা ? সিগারেট বিড়িতেই সন্তুষ্ট থাকো ? বর্ষা-শীতে মদ্যপান করো না ! আমি তো শালা বাবার জন্মে এমন শুনিনি। প্রলয় লাজুক গলায় বললো — আমাদের পকেটে মাল কড়ি কম থাকে তো , এজন্য ওগুলো জোটাতে পারিনা। আপনি কি সারা বছর জলেই থাকেন , নাকি মাঝে মাঝে ডাঙায় ওঠেন ? শুভব্রত ফোড়ন কাটলো — ফুলকুশমায় আমার এক চেনা দাদা আছে । কবিতা তেমন লেখে না , তাই সারা বছরে মদ মাত্র দুদিন খায় — যেদিন বৃষ্টি পড়ে সেদিন আর যেদিন বৃষ্টি পড়ে না সেই দিন । সবাই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো। অরুণোদয় শুভব্রতর পিঠ চাপড়ে বললো — তোমার হবে । ফুলকুশমায় আমার কলিগ থাকে । আমি খোঁজখবর রাখবো — কবি শুভব্রত কতদিন সাদা জলে থাকে ! একটু নাম ডাক হলেই তো….
এতক্ষণে অরুণোদয়ের চোখ পড়ল অমলেন্দুর দিকে। আপনার কথা অনেক শুনেছি। কাগজে আপনার প্রতিবেদনও পড়েছি । সত্যি সত্যিই দলমার দলছুট হাতিদের জন‍্যে প্রান্তিক জেলাগুলোর গ্রামে গ্রামে ফসলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয় , তার নিখুঁত প্রতিবেদন আপনার কলমে উঠে আসে । আবার , বন্যপ্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রেও আপনার অবদান বলবার মতো । সেদিন কাগজে দেখলাম , আপনি একটা আহত বনবেড়ালের পরিচর্যা করছেন। সাবাস । বন্যপ্রাণ নিয়ে এক সময় আমারও খুব উৎসাহ ছিলো। ইনফ‍্যাক্ট এখনও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি আমার নেশা বলতে পারেন । কিন্তু ব্যাঙ্কে কাজের চাপে…. অমলেন্দু নিঃশব্দে হেসে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো। অরুণোদয় আর কথা না বাড়িয়ে , কাজ আছে বলে অন্য ঘরে চলে গেল।অনামিকা চেঁচিয়ে বললো– শুনছো , আটটার মধ্যে বাজারে যেও । এতগুলো লোক খাবে আজ । কিছু ব্যবস্থা তো করতে হবে — দেশি মুরগির মাংস নিয়ে এসো। চটপট মাংসের ঝোল ভাত রান্না করে ফেলবো । ক’জন রুটি খাও বলে দিও , সেই মতো রুটি কিনে আনা হবে। অরুণোদয় দারুণ নাটকীয় ভঙ্গিতে– জো হুকুম ম‍্যাডাম বলে , হাত নেড়ে চলে গেলো।
মেঘলা যেন ক‍্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বললো– তোর বরকে দেখে এই বয়সেও ফিদা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে । কলকাতা হলে , দু-এক পেগ সিওর মেরে দিতাম মাইরি তোর বরের সঙ্গে। যাক ছাড়।
আরেক রাউন্ড চা হবে তো ? জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে , প্রায় সাতটা বাজতে চললো। আচ্ছা, কালকে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তো স্কুলের গ্রাউন্ডেই , তাইতো ? অনামিকা বললো– আমি কিন্তু স্থানীয় এক কবিতা পাগল ক্যাটারার মালিককে বলে দিয়েছি। প্রলয় বলে উঠলো — অনামিকাদি , দুপুরের মেনু কি? অনামিকা চা করতে উঠে যেতে যেতে বলল — হরি মটর। আন্ডারস্ট্যান্ড ? পড়তে এসেছো কবিতা , নজর রান্না ঘরের দিকে । এই জন্যেই বাংলার কবিদের কিছু হয় না। শুভব্রত আবার ফোড়ন কাটলো — কার কি হয় জানিনা , দুপুরের মেনু আর রাতের মেনু না শুনলে কবিতাই বেরোবে না । বাঁধাকপি ফুলকপি একঘেয়ে হয়ে গেছে । কাজেই তোমরা ডালের সঙ্গে পোস্ত রেখো কিন্তু কালকে। অমলেন্দু বললো — আমি একটা কিছু স্পন্সর করবো না ? মেঘলা বললো — ইয়ার্কি নাকি ? একটা মানে ? তোর থেকে হাজার পাঁচেক টাকা নেবো বলে বসে আছি । নয়তো খরচ উঠবে কি করে ? আমরা , দূর থেকে আসা কবিদের থেকে একটা পয়সাও নিতে পারবো না । অমলেন্দু মাথা নেড়ে বললো — দ‍্যাটস গুড । সেটাই তো আশা করা যায় । জেলা টপকে , সেই কাকভোরে বেরিয়ে তারা কবিতা পড়তে আসবে। তাদের মুখে দুটো ডাল ভাত দিতে পারবো না আমরা ? তাদের থেকে ছলে বলে কৌশলে টাকা নেওয়া হবে ? যেমন বিভিন্ন জায়গায় দেখি ! দুপুরের খাবার জন্য পয়সা নিলে কবি সম্মেলন আর পাইস হোটেলের মধ্যে পার্থক্য কি ? অনামিকা , ভাই তুমি লম্বা একটা ডিমের ঝোলের ব্যবস্থা করো। ডাল , মোটা মোটা আলু ভাজা বা বেগুন ভাজা , আলু পোস্ত আর ডিমের ঝোল। শেষ পাতের চাটনি পাঁপড়ের ব্যবস্থা আপনা আপনিই হয়ে যাবে । প্রলয় করুণ মুখে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললো — দিদিভাই ,এই শীতে অন্তত একটা করে নতুন গুড়ের রসগোল্লা হবে না শেষ পাতে…. কথায় বলে , সব ভালো যার শেষ ভালো ।মেঘলা হাসতে হাসতে প্রলয়ের সোয়েটার এক টান মেরে বললো– এই ছেলেটা , তোর উন্মনাদি এখানে আসবে কিনা , সেটা কনফার্ম করেছে ? ও শুনেছি সংযোজনাটা ভালোভাবে করতে পারে । কিরে ? সিওর আসবে তো ? আমি কিন্তু অ্যনাউন্সমেন্ট ভালো পারি না। মাইক্রোফোনের সামনে ভীষণ নার্ভাস লাগে । প্রলয় এবার শুকনো মুখে দাঁতে নখ খুঁটতে খুঁটতে ভয়ঙ্কর চিন্তাশীল হয়ে জবাব দিলো–আজ সকাল পর্যন্ত গাঁইগুঁই করছিল , মেয়েকে মার কাছে একা রেখে আসার ব‍্যাপারে । মনে হল,খুব একটা ইচ্ছে নেই । তবুও বলেছে , রাত নটার সময় কনফার্ম করবে । দেখি কি হয় । শুভব্রত আশা জাগিয়ে বললো– আমি জানি , দিদিভাই ঠিক আসবেই ।ওরকম কবিতা পাগল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আমার ম‍্যাগাজিনের জন‍্য প্রতিবার সাহায্য পাঠিয়ে দেয়।
আরে , ওই তো ! আবার চা এসে গেছে । সবাই মিলে চিৎকার করে উঠলো — চিয়ার্স !
না না , ভুল হলো — সবাই মিলে দ্বিতীয়বার চিৎকার করে উঠলো — উল্লাস !

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।