• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৮)

রূপকথা পৃথিবীর

তেমন দিনের জন‍্যে সবাই জাগি ,
সাতসকালের সুয‍্যি বলবে হেসে —
ভালো থেকো চাঁদ ,স্বপ্ন ও শৈশব ,
তুলি দিয়ে আঁকা গাঢ় সবুজের দেশে !
মাত্র কয়েকদিন স্কুল করেই ,আমাকে আবার মামার বাড়ি ফিরে যেতে হলো। মাকে নাকি হাসপাতালে ভর্তির দিন ঠিক হয়ে গেছে । দিদি কোথায় জানিস তো জায়গাটা ? আমরা যখন তেত্রিশ নম্বর দোতলা বাসে চড়ে চেতলা থেকে শিয়ালদা বা শ‍্যামবাজারের দিকে যাই , তখন হাজরা রোড , বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরিয়ে রাস্তাটা সোজা এসে , বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধার ঘেঁষে ব়াঁদিকে ঘুরে , যখন সোজা পার্ক সার্কাসের দিকে চলে যায় , তখন বাসের ডানদিকে যে লেভেল ক্রসিংটায় সবসময় জ‍্যাম আর ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে , ওই রেলগেটের ওপারের পৃথিবীতেই লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতাল । চেতলা থেকে বৃষ্টিভেজা সকালে একটা ট‍্যাক্সি করে আমি , সেজোমামা , বড়মামা আর বাবা, মা’কে নিয়ে যখন ওই লেভেল ক্রসিংটা কোনোরকমে পেরোলাম , তখন বৃষ্টির জন‍্যে কাচ বন্ধ করা গুমোটের মধ‍্যে আমার মতো মায়ের মনটাও যে দমে গেল , সেটা বেশ বুঝলাম । দিদি তুই বিশ্বাস কর — বালিগঞ্জ রেললাইনের ওপারে যে একটা পৃথিবী আছে , সেটা যেন আমি এই প্রথম জানলাম। বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে বাবা কেমন যেন অন্যমনস্ক উত্তর দিলো — এই জায়গাটার নাম কুষ্টিয়া, আর তারপরেই পিকনিক গার্ডেন। আমি মনে মনে বললাম…তারপরে ? তারপরে কি পৃথিবীর শেষ ?
দিদি ,জানিস তো , মা আজ সকালে চুপচাপ স্নান সেরে , নিজের মাকে প্রণাম করে , নীলমণির মা’র হাতের জলখাবার খেয়ে, নিঃশব্দে গলি টপকিয়ে ট‍্যাক্সির দরজায় পা রেখেছিলো । আর এই মুহূর্তে , বৃষ্টিতে ঝাপসা কাচের ওপারে , রেলগেট পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তায় যেন আকুল হয়ে খুঁজছে আপাতত নিজের অস্থায়ী ঠিকানার বাড়িটা । দিদি তোর মনে আছে , মা আমাদের হাজারিবাগ আর রাঁচি বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি বলেছিলো । রাঁচি শহরের পাগলা গারদ নাকি লোকে দেখতে যায় ! আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম–মা, ও মা, পাগলা গারদ কি চিড়িয়াখানা ? আর তুই বলেছিলি , চিড়িয়াখানাতেই বা কেন ওইটুকু-টুকু খাঁচার মধ‍্যে পশু পাখিদের বেঁধে রাখবে ? হারমোনিয়ামের রিড থেকে আঙুল তুলে নিয়ে , দুচোখের জলে একাকার হয়ে মা কোন গান গেয়েছিলো তোর মনে আছে ? ঠিক জানি তোর মনে পড়ে গেছে — এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় , আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে…এই আকাশে আমার মুক্তি…..
মা হঠাৎ অস্থির হয়ে বড়মামা আর সেজোমামাকে জিজ্ঞাসা করলো — হ‍্যাঁ রে খোকন , দুলাল — তোরা আমার গানের খাতাটা ব‍্যাগের মধ‍্যে ঢুকিয়েছিস তো ?সামনের সিটে বসে থাকা আমার আর বাবার পিঠ দুটো খিমচে ধরে মা কেমন অস্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো– ওগো শুনছো , হাসপাতালে হারমোনিয়াম আছে ? হারমোনিয়াম ? বাবা অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে বললো — তুমি নিশ্চিন্ত থাকো , আমি খোঁজ নিয়েছি , ওখানকার রিক্রিয়েশন রুমে ক‍্যারাম থেকে লুডো পর্যন্ত সবকিছু আছে । এমন কি তাসও । তুমি তো টোয়েন্টি নাইনটা খারাপ খেলো না । আর সব জায়গার মতো এই হাসপাতালেও দু-তিনটে হারমোনিয়াম আছে । তোমার রবিঠাকুর সেখানে খুব যত্ন করে গীতবিতানটাও রেখে দিয়েছেন তোমার জন‍্যে । মা কেমন আচ্ছন্নের মতো আমাকে বললো — হ‍্যাঁ রে ঝন্টু , তুই আমাকে মাঝে মধ্যে দেখতে আসবি তো ? মঙ্গলাকে বলিস — আমার রান্নাঘরটা যেন গুছিয়ে রাখে। মা’র জন‍্য মন খারাপ করবি না ঝন্টু , খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করবি । মাস কয়েক বাদে আমি যখন ফিরবো ,আমার হাতে তোর ঝকঝকে রেজাল্টটা দিবি। আমার বুকের ভেতর থেকে একটা গুমরে গুমরে ওঠা কান্না , গলার কাছে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আর বাবা প্রাণপণে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা আমার বাঁ হাতটা জোরে চেপে যেন বলতে চাইছে — কাঁদবি না ঝন্টু , একদম কাঁদবি না । মনকে শক্ত কর । এটা আমাদের জীবনের পরীক্ষার সময় । এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ,আর কোনো দুঃখ কোনদিনও ঘায়েল করতে পারবে না । চুপ ! চোখের জল সামলা !
হাসপাতালের সামনে এসে কিন্তু মনটা ভালো হয়ে গেল । হালকা একটা বাগান ঘেরা তিনতলা বাড়ি । একতলা দোতলা তিনতলায় বিশাল বিশাল এল সেপের বারান্দা। অনেকেই ঘোরাঘুরি করছে , তাদের দেখে কখনোই পাগল বলে মনে হচ্ছে না । সিঁড়ি বেয়ে দুজন নার্স এগিয়ে আসতেই , আমার মা যেন নিজেই তাদের কাছে ধরা দিলো ! কিন্তু হলে হবে কি ? গানের মানুষ তো ! পিছন দিকের কোনো বাড়ির রেডিও থেকে একটা গান শুনে হঠাৎ থমকে গেল আমার মা। আমাকে বললো– ঝন্টু, গানটা শুনছিস ? ভালো করে কান পেতে শোন ।আমার খুব প্রিয় শিল্পীর গান । তোদের শুনিয়েছি কতবার , মনে নেই ? বাবা একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে । তবুও মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে । বড়মামা আর সেজোমামা আলতো করে জড়িয়ে রয়েছে মাকে ; আর আমি মায়ের আঁচলটা যতক্ষণ পারছি ধরে রাখছি । এই যে বাইরের পৃথিবী … দিদি জানিস , আর ওই যে হাসপাতালের ভেতরের পৃথিবীটা — দুটো যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়া ! একটা বাইরের জগৎ , আরেকটার ভিতরের । কিন্তু ততক্ষণে আমার কানকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে রেডিওতে , শৈলেন মুখার্জীর দরদী ও মিস্টি কন্ঠস্বর —-
দাঁড় ছপছপ কোন তরী বেয়ে চলেছি…
ঢেউ দোল দোল মন গান গেয়ে চলেছি…
কে নিলো মন — জানিনা ,জানিনা …
উতরোল হিল্লোল ,
কী বাতাস , মনে আজ দিলো দোল জানিনা ,
কী মায়ায় ভরে যায় এ জীবন …
দাঁড় ছপছপ কোন…
আমি , সেজোমামা আর বড়মামা বারান্দার টানা লম্বা বেঞ্চিতে বসলাম। মা’র ব‍্যাগ , ব‍্যাগের মধ‍্যে গানের খাতা , চিকিৎসার কাগজপত্রের ফাইল হাতে বাবা ,ওই ভিতরের পৃথিবীটার মধ‍্যে চলে গেল….যেখানে হারমোনিয়াম, গীতবিতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের জন‍্যে অপেক্ষা করছে — ভয়াবহ ইলেকট্রিক শক !
ও ভগবান , আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না । শুধু বুঝলাম , বড়মামা আর সেজোমামা তাদের সমস্ত স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিলো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।