অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৩১)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

এই তো আমরা হাতে হাত রেখে বাঁচি
এই তো আমরা জীবনের কথা বলি
চৈত্র পেরিয়ে গ্রীষ্মদিনেও থাকবো
কানে,প্রাণে , আর কবিতায় গলাগলি
এই তো আমরা…

মেদিনীপুরের মতো আধুনিক শহরের কাছে , কাঁসাই নদী আর গুড়গুড়িপালের জঙ্গলের দিগন্তে যে এমন একটা আশ্চর্য সুন্দর ইতিহাসের ছোঁয়া লাগা ন্যাচারাল পার্ক আছে ,তরুণ কবি শুভব্রত,বাদল মেঘ , তিথি বোধহয় তেমন করে জানতো না । প্রলয় উন্মনার কথা আলাদা ।ওরা বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে।তাই এই জায়গাগুলো ওদের অজানা নয়। মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র তিনচার কিলোমিটার দূরে রাঙামাটি , বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে এই গোপগড়ে এলেই , টিলা ও স্বাভাবিক বনভূমির ছোঁয়া পাওয়া যায় । ঐতিহাসিক ভাবে,এই টিলার ওপরে রানী ভবানীর গড়। তার ভগ্নস্তূপও‌ রয়েছে এখানে। টিলার ওপর সাজানো গোছানো পার্কে ,ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার , রেস্টুরেন্ট,নানা রকম ফুলের বাগান আর গেস্ট হাউস।ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে অমলেন্দু আবার অবাক হয়ে গেল ।‌ দূরে কাঁসাই নদীর রেলব্রীজ , আরও দূরে খড়্গপুর আই আইটির আভাসও যেন দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই গুড়গুড়িপালের হাতির জঙ্গল। অনতিঅতীতে মাওবাদী ভয়াবহতা ও আতঙ্ক মিশে ছিল এই জায়গাগুলোয়।এখন‌ শরতে , শীত-বসন্তে ভ্রমণ পিপাসুদের ঢল নামে । প্রকৃতি ও মানুষের যুগলবন্দিতে গোপগড় যেন নতুন করে সেজে উঠেছে । মার্চের শেষের দিকে মাঝ চৈত্রে এসে ,বসন্ত ক্রমশ গ্রীষ্মের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে । গাছের ছায়ার নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে ওদের কবিতা পরিবার। উন্মনা, শুভ ,প্রলয় বাদল মেঘ , তিথি ও সকলের প্রিয় অমলেন্দু স্যার । কবি প্রলয়ের কোলের ওপর পড়ে রয়েছে আজকের মিটিং এর অনুপুঙ্খ লেখার খাতা ও পেন । উন্মনা বাড়ি থেকে আনা জলখাবার সাজাতে সাজাতে টুক করে একটু ফোড়ন কাটলো — কি ব্যাপার ? কবিতার খাতায় মিটিং এর গুরুগম্ভীর কথাগুলো লেখা হবে ? কবি প্রলয়ের লাজুক হাসি চৈত্রের গরমকে যেন একটু স্নিগ্ধ করে দিলো — আজ্ঞে না স্যার , কবিতার খাতা আমার ব্যাগের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে । এটা একটা নতুন খাতা । বেশ মোটা দেখেই কিনলাম ,যাতে আগামী কয়েক বছরের মিটিং এর সবকিছুই এখানে ধরে যায় । কবি বাদল মেঘ কৌতুহল চাপতে না পেরে বলেই ফেললো — সে কি ? কবিতাজন্মের কথা তো আকাশে বাতাসে লেখা হবে ! খাতার পাতায় কেন ? বাদল মেঘের বন্ধু তিথির রিনরিনে গলা সুরে সুরে বেজে উঠলো— আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম একটি তোমার সই গো,
তুমি চোখের পাতায় এঁকে দিলে ,আমি হলাম তোমার সই গো…
একটা আস্ত পটলভাজা লুচির মধ্যে জড়িয়ে প্রায় গোটাটাই মুখে পুরে দিয়েছিল বাউল ক্ষ্যাপা বিন্দাস । অমলেন্দু ওকে আজ সঙ্গে নিয়ে এসেছে । তাতে এই গানওয়ালা বেজায় খুশি। আজ তার দায়িত্ব মিটিং এর গুরুগম্ভীর আলোচনার মাঝে মধ্যে গান শোনানোর । মুখের মধ্যে লুচিটাকে প্রাণপণে ম্যানেজ করতে করতে ভরাট গলায় সে বললো — ও নতুন দিদিভাই , এত সুরেলা গলা তুমি কোথায় পেলে গো‌ ? আগ বাড়িয়ে শুভ উত্তর দিলো– বোধহয় বসন্তের কোকিল ফিরে যাওয়ার আগে পঞ্চমী সুরটা ওকেই দিয়ে গেছে । লজ্জা পেয়ে তিথি উত্তর দিলো–গান আমার মায়ের কাছেই পাওয়া‌। আমি তেমন করে শিখিনি । তবু ইচ্ছে হলে গাই । চারিদিক থেকে প্রশংসার জোড়া জোড়া চোখের দৃষ্টিতে অস্বস্তি বোধ করে মিষ্টি মেয়ে তিথি লজ্জা এড়াতে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো — উন্মনাদি , তোমার হাতের লুচি আলুভাজা পটলভাজায় বোধহয় জাদু আছে । নারকেলের নাড়ুটাও কী অপূর্ব ! যেন কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর গন্ধ পেলাম। ব্রেকফাস্টেই তো পেট ভরিয়ে ফেললাম ।
জগতে তিন ধরনের মানুষ আছে। তাদের মধ্যে কেউ প্রশংসা শুনলে গুটিয়ে গিয়ে লজ্জাবতী লতা হয়ে যায় , কেউ চুপ করে গিয়ে চোখ দিয়ে হাসে , আবার কেউ কেউ প্রগলভ হয়ে উঠে অনেক অনেক কথা বলে ফেলে । এখানে প্রগলভ হওয়ার মতো কেউ নেই।কবিতার মানুষ ,গানের মানুষ যেন ভালোবাসা দিয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। জলখাবার আর চা শেষ করে ওদের আলোচনার বিষয় শুরু হতেই , অমলেন্দু বললো — বিন্দাসের গান দিয়েই শুরু হোক ।
আজ বিন্দাসের ঝুলিতে একতারা নেই । মালকোঁচা মারা ধুতি আর হালকা বাসন্তী হাফ পাঞ্জাবিতে বিন্দাসকে দেখে উন্মনার মনে হল — যেন বিদায়ের আগে বিষণ্ণ ঋতুরাজ আজ এই গোপগড়ের ঘাসে বসে আছে । একটু দূরের কাঁসাই নদী ,বহু দূরের রেলব্রীজ আর আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বনভূমি , সবাই যেন বলে উঠলো–গান শোনাও ঋতুরাজ ,গান শোনাও। উন্মুখ বিন্দাস জিজ্ঞাসা করলো — কি গান শুনবে বলো ? তুমি যা শোনাবে ,তাই শুনবো । বিন্দাস হামাগুড়ি দিয়ে এসে অমলেন্দুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো । তারপর লাজুক স্বরে বললো — একটা পুরোনো বাংলা গান শোনাচ্ছি ।
শ্যামল মিত্রের গান শুনবে ?
সবাই হৈ হৈ করে সম্মতি জানালো। কবি প্রলয় বললো–শ্যামল মিত্রের গান ভীষণ প্রিয়। শোনাও শোনাও। ক্ষ্যাপা বিন্দাস উদাত্ত কন্ঠে গেয়ে উঠলো — ভ্রমরা…ফুলের বনে মধু খেতে অনেক কাঁটার জ্বালা ,তুই যাসনে সেখানে…
রূপের জালে জড়ালে তোর আসবে দুখের পালা ,
তা যে জানে সে জানে ,ভ্রমরা যাসনে সেখানে….
এই পাগল করা গান শুনতে শুনতে অমলেন্দুর মনে হলো, বিন্দাস ওর আদ্যোপান্ত জানে বলে,ওকেই গানটা শোনাচ্ছে। অন্যমনস্ক হতে গিয়েও,অবাধ্য দৃষ্টি চলে গেল উন্মনার দিকে।উন্মনার চোখ মাটির দিকে নামানো। চোখ সরিয়ে নিতে দেখলো — বাদল মেঘ ও তিথি ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। ‌ ‌
‌ গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে বিন্দাস অন্য কাজে চলে গেল।যাবার সময় বলে গেল — ও বন্ধুরা, আগামী সাতজন্ম তোমাদের কবিতার কাছাকাছি থাকবো গো । গান শোনানোর জন্য থাকবো ,মাধুকরীতেও থাকবো।দুবেলা দুমুঠো শুধু খেতে দিও । আমার গুরুদেব অমলেন্দুদার কাছাকাছি থাকতে পারলেই আমি খুশি । এখন একটু মেদিনীপুর শহর থেকে ঘুরে আসি । দুপুরে খাওয়ার সময় ঠিক হাজির হব।তখন গান শোনাবো, আবার বিকেলে মিটিং শেষ হলেও গান গাইবো । আগলা পাগলা লোক তো গান গাইতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু , তোমাদের সকলের কাছ থেকে কবিতা শুনবো আমি । আর যাওয়ার আগে আরেকটা জিজ্ঞাসা আছে । ও দিদিমণি ,ও দাদারা , কবিতা তোমরা কেমন করে লেখো গো ? আর , অত সুন্দর করে বলোই বা কেমন করে ? আমি তো কোনোদিন চেষ্টা করলেও পারবো না । তাইতো আমি গান নিয়েই পড়ে থাকি গো ।বলেই , দুকলি রবীন্দ্রনাথের গান শোনাতে শোনাতে গেটের দিকে হাঁটা দিলো।চৈত্রের আকাশে বাতাসে ভাসতে লাগলো পাগল বিন্দাসের হৃদয় থেকে উঠে আসা গান — মরি হায় , চলে যায় ,বসন্তের দিন চলে যায় ,দূর শাখে , পিক ডাকে , বিরামবিহীন,মরি হায়….
সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কবি শুভব্রত হাতের ঘড়ি দেখে অস্ফুট সুরে বলে– এবার মিটিং শুরু হোক ? প্রত্যেকেই চুপ করে বসে আছে। বিন্দাসের ক্রমশ আবছা হয়ে যাওয়া বাসন্তী রঙের অবয়বটার দিকে তাকিয়ে। খুব ধীরে ধীরে অমলেন্দুর উচ্চারণে উঠে এলেন রবীন্দ্রনাথ। উন্মনা বুঝলো — তার কবিমন গলার কাছে উঠে আসা বেদনাকে চাপা দিতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে —
অমলেন্দুর কন্ঠস্বর শব্দ দিয়ে যেন ছবি এঁকে চললো–
আবার যদি ইচ্ছা কর ,আবার আসি ফিরে
দুঃখ সুখের ঢেউ খেলানো এই সাগরের তীরে।
আবার জলে ভাসাই ভেলা, ধূলার ‘পরে করি খেলা ,
হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে।
আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি ,
আঘাত খেয়ে বাঁচি, না হয় আঘাত খেয়ে মরি ।
আবার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে,
নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে
আবার যদি ইচ্ছা করো, আবার আসি ফিরে।
কবিতা শেষ হতেই তিথির রিনরিনে গলা আবার বীণার মতো বেজে উঠলো–
তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে,
দেবে কি গো বাসা আমায় দেবে কি একটি ধারে ?
কবি প্রলয়ের কোলের ওপর থেকে নামিয়ে রাখা মিটিং এর খাতা দুপুর-চৈত্রের এলোমেলো হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছিলো । আকাশী রঙের‌ নতুন পেনটা আকাশের দিকে মুখ তুলে ঘাসের ওপর পড়ে আছে।
সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।