অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ১২)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

তুমি তো চলেই যাবে শেষ ঝরাপাতা
বাসস্টপে দেখা হলে ফাগুন-বিকেলে
চিনতে না পারো যদি,ও পলাশ,তুমি ?
অনন্ত গোধূলি এসো আলতো পা ফেলে….

সবাইকে নমস্কার জানিয়ে স্টেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অমলেন্দুকে প্রায় টানতে টানতে আবার মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করালো প্রিয় বন্ধু মেঘলা। মাইক্রোফোনের দখল নিয়ে প্রকৃত টিম লিডারের মতো ঘোষণা করলো– চুপি চুপি একটা কথা ফাঁস করে দিই আপনাদের সামনে।কথা দিন, শুধু আপনারাই জানবেন,আর কেউ নয়‌। ঠিক? প্রমিস? তবে শুনুন–
মাস্টার্স শেষ করার পরে, একদিন আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে যখন আমার হবু বরের নামটা ঘোষণা করলাম , সেদিন বিকেল বেলায় হৈ হৈ করতে করতে, ঠোঙা ঠোঙা বাদাম ভাজা, ঝালনুন সমেত আমরা সবাই একটা ঝিলের ধারে,মখমল ঘাসের ওপর গিয়ে বসলাম । আমাদের প্রিয় বন্ধু অমলেন্দু সেদিন খুউব দুঃখী দুঃখী একটা কেয়ারফুলি কেয়ারলেস ছায়া ওর মুখের উপর ছড়িয়ে বলেছিলো–তুই আমাকে একবার প্রপোজ করবার সুযোগ পর্যন্ত দিলি না ? যাক, বিয়েতে কি উপহার নিবি বলিস । আমি একটুও না ভেবে বলে দিয়েছিলাম– আমার বিয়েতে কোনো উপহার নেওয়ার ইচ্ছেই নেই ।তবু যদি দিতেই চাস , একগুচ্ছ ফুল আর শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা উপহার দিস । আমি চিরদিন মনে রেখে দেবো। আর , এই মুহূর্তে এই ঝিলের ধারে, অন্য সকলের চোখ কান খোলা থাকলেও , তুই শুধু আমাকেই শোনাবি প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের দীর্ঘ কবিতা — জাবাল সত্যকাম। অন্য সবাই মন দিয়ে শুনবে ,আমি শুধু চোখ বুজে , মন-প্রাণ পেতে দিয়ে শুনবো। জানেন,আমার প্রিয় বন্ধু সেদিন কথা রেখেছিলো। শুধু আমরাই নয় , ঝিলের জল , সবুজ ঘাস , ঝিলের জলে উপুড় হওয়া আকাশ আর , সেই আকাশের প্রথম তারা অবাক হয়ে ওর কবিতা শুনেছিল । আমি জানি অমলেন্দু আজও ওই কবিতা আপনাদের সবাইকে শোনাবে।হৃদয় দিয়ে শোনাবে,অনুভব থেকে শোনাবে। কিন্তু, তার আগে আমার আর একটা ছোট্ট কথা বলা বাকি আছে। শীত পেরিয়ে বসন্ত, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মের মুখেই আমি পাড়ি দেবো বিদেশে।হয়তো একযুগ পেরিয়ে ফিরবো বা তারও বেশি। কিন্তু ফিরবোই এই পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার টানে। জীবনের শেষের প্রহরগুলো এই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবো। আবার যখন আমার আহ্বানে এই ঝাড়গ্রামেই মিলিত হবো আমরা সবাই, সেদিন আজকের এই তরুণতম কবিরা , আমি নিশ্চিত জানি–প্রত্যেকেই একেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে–উন্মনা , প্রলয় , শুভব্রত,প্রত্যেকের মেধা থেকে বিচ্ছুরিত হবে সূর্যের সাতরঙা আলো । বন্ধু অমলেন্দু হয়তো তখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কিন্তু সেদিনও তাকে আমাদের ছোট্ট আয়োজনে আসতে হবে‌।হবেই।হয়তো ঋতুরাজ বসন্ত হয়ে ,নয়তো ছায়া ঘনাইছে বনে বনের প্রথম আষাঢ় হয়ে, অথবা শরৎকালের আকাশ দেখার অনন্তনীল সকাল হয়ে…
‌ কথাগুলো শুনতে শুনতে উপস্থিত সকলে ভাঙা বিকেলের আলোয় যেন স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গেলো। দু-চোখের অবাধ্য জল নিঃশব্দে মুছে , নিজেকে সামলে নিয়ে মেঘলা আবার বললো– ভেবেছিলাম আজকের খরচ খরচা কিছুটা অমলেন্দুর পকেট থেকে ছিনতাই করবো। জানি ওর হাঁটুঝুল পাঞ্জাবির পকেটগুলোও ওর হৃদয়ের মতোই অনেক বড়ো , সেখান থেকে অনায়াসেই…
কিন্তু,না বন্ধুরা, গতকাল এবং আজকের যাবতীয় খরচ খরচা আমি নিজেই বহন করবো। প্রিয় দুই ভাই প্রলয় ও শুভব্রত যেন আমাকে এই সুযোগটুকু দিয়ে ধন্য করে। আপনাদের কাছে অনুরোধ ,আর অল্প কিছুক্ষণ এই অনুষ্ঠান চলবে। অমলেন্দুর কবিতার পরে আমার মিষ্টি বোন উন্মনা অনুষ্ঠান পরিচালনার ধকল সরিয়ে রেখে, একটা-দুটো কবিতা শোনাবে। সবশেষে আমাদের ডার্লিং বন্ধু ক্ষ্যাপা বিন্দাস ওর নিজস্ব ঘরানায় গানের কথা , প্রাণের কথা বলবে। সবাইকে ধন্যবাদ জানাবে কবি প্রলয় ও শুভব্রত। আমি মাইক্রোফোন ছাড়বার আগে যদি অনুমতি দেন ,দুকলি শুনিয়ে যেতে পারি। কী , আমাকে অনুমতি দেবেন ? একজন তরুণ কবি ডুকরে বললো– দিদিভাই, তুমি সত্যি সত্যিই ফিরে আসবে তো এ দেশে ? আমরা অপেক্ষা করবো । মেঘলা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো । তারপর ওর ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে উঠে গাইলো চিরদিনের মান্না দে’র শীতঋতু সঙ্গীত — না না যেওনা,ও শেষ পাতা গো,শাখায় তুমি থাকো,ছিলে তুমি ছিলাম আমি , চিহ্নটি তার রাখো,না না,যেওনা….
শীতের বিকেল এমনিতেই বিষণ্ণতায় চুপ করে থাকে। আর , এমন গান শোনার পর, চরাচরেও যেন বাক্যস্ফূরণ হয়না ! মেঘলা শুধু অমলেন্দুর বাড়ানো হাতটা ধরে মৃদু একটু ঝাঁকুনি দিলো ; কিন্তু চোখের জলে ভেজা মুখ তুলে মেঘলা কী যে বললো , তা শীত-ক্যামেরার লং শটেও ধরা পড়লো না। যেন বললো–মনে রেখো,মনে রেখো সখা। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই অমলেন্দুর সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে স্মার্টলি বলে উঠলো–রেডি ? ক্যামেরা রোলিং … সাইলেন্ট… অ্যাকশান…
অমলেন্দুর কন্ঠস্বর যে ব্যারিটোন, এমন কথা স্বয়ং ঈশ্বরও বলবেন না ; কিন্তু , একটু ধরা ধরা গলায় কোথাও যেন একটা ম্যাজিক-টাচ আছে। এমনি কথা বললে একরকম। কিন্তু মাইক্রোফোনের সামনে গেলেই ভোজবাজির মতো সব পাল্টে যায়‌। কোনো কথা না বলে অমলেন্দু শুরু করলো ওর নিবেদন–কবি শঙ্খ ঘোষের –তুমি তো তেমন গৌরী নও কাব্যগ্রন্থ থেকে জাবাল সত্যকাম–
তুমি দিয়েছিলে ভার,আমি তাই নির্জন রাখাল।
তুমি দিয়েছিলে ভার,আমি তাই এমন সকাল -সন্ধ্যা,
আজানু বসেছি এই উদাসীন মর্যাদায়।
চেয়ে‌ আছি নিঃস্ব চোখে চোখে।

যে দীর্ঘ কবিতার শুরুটাই এমন আদিগন্ত ও ব্যাপক , সে‌ কবিতার অঙ্গে অঙ্গে ভাবতরঙ্গে মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের অতল গাম্ভীর্য দুই কবি প্রলয় ও শুভব্রতকে একেবারে স্তব্ধ করে দিলো । শুভব্রত প্রলয়কে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো–প্রলয়দা , এই ছন্দের চলনটা কেমন গো ? প্রলয় স্টেজের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সংক্ষেপে জবাব দিলো– ধীর লয়, সাধারণত এই ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে , কিন্তু ছান্দসিকরা এই ছন্দকে বলবেন মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ।যেমন কবি জীবনানন্দ দাশের বেশির ভাগ কবিতা । প্রাচীন দিঘির মতো সেই বিকেলী স্তব্ধতা এতটাই গভীর ছিল যে ,ওই ফিসফিস শব্দটাও একটু দূরে বসে থাকা উন্মনাকে নাড়িয়ে দিলো। নিঃশব্দে ঠোঁটে আঙুল রেখে উন্মনা ওদের চুপ করতে বললো । শান্ত সুভদ্র দুই তরুণ কবি জিভ কেটে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো । কবিতা বয়ে চলে , কবিতা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোয়, তারপর সেতারের আরোহণ পর্বের পর অবরোহনে নেমে আসে । না,না উন্মনার মনে হলো–সেতার নয় , এই কবিতার উচ্চারণ যেন সরোদের কান্না , যেন জাবাল সত্যকামের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা লেখা দায়বদ্ধ খাতার পাতা।
একসময় কবিতাটি শেষের মুহূর্তে চলে আসে। অমলেন্দুর চোখের পাতা কাঁপে , অমলেন্দুর নাকের পাটায় পুরুষের কান্না জমে ওঠে । অমলেন্দুর ঠোঁটে কবিতার শেষ লাইনগুলো যেন টেরাকোটার ভাস্কর্য হয়ে যায়–
এখন স্পষ্টই আমার আড়াল , বনবাস
এখন অনেকদিন বন্ধুদল তোমাদের হাতে হাতে নই।
যখন সহস্র পূর্ণ হবে , ফিরে যাবো ঘরে
যখন সহস্র পূর্ণ হবে
আয়তনবান এই দশ দিক গাঢ়তর স্বরে
ফিরে নেবে ঘরে
এখন আজানু এই উদাসীন মাঠে মাঠে আমার সকাল
তুমি দিয়েছিলে ভার , আমি তাই নির্জন রাখাল ।

‌ হাততালি নয় , তবু সমবেত সকলের দৃষ্টির নম্রতা যেন শত প্রণাম হয়ে , দিনশেষে শেষ খেয়ার পাল তুলে বয়ে গেল কবি শঙ্খ ঘোষের দিকে । উন্মনার মনে হল, এমন কবিতা তো পৃথিবীর যে কোনো ভাষার সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ । কবিতা যে দিগন্ত রেখার মতো হাতছানিময়, কবিতা যে ভাষাজননীর আঁচলের স্নিগ্ধ ছোঁয়া , কবিতা যে দুধের বাটির মতো পূর্ণিমার চাঁদ ,যা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করা মাত্র শ্রাবণের ধারার মতো ভালোবাসা হয়ে ঝরে পড়ে; সেকথা ঠিক এই মুহূর্তে উন্মনার মনে হল।
এই কবিতার পরে ক্ষ্যাপা বিন্দাসের গানেও আর মানুষ তেমন করে জেগে উঠলো না। আর বিন্দাসও তো তেমন ক্ষ্যাপামির গান গাইলোনা। বরং একতারটির একটি তারে যেন লালনকে ডেকে আনলো–মন তুই রইলি খাঁচার আশে ,খাঁচা যে তৈরি কাঁচা বাঁশে, কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে,লালন কেঁদে কয়…
দিনশেষের মন খারাপের আলোয়, সূর্যদেবও যেন দিনান্তের সীমানায় দু’দন্ড দাঁড়িয়ে সে গান শুনলো।
ঝাড়গ্রাম থেকে বাঁকুড়ার দিকে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যার শেষ বাসের জানলার ধারে বসে , আমাদের ক্ষ্যাপা বিন্দাস ভাবছিলো–ঘরে ফিরে একটা মাটির প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে, সারারাত তার দিকে অপলক তাকিয়ে ভাববে, আজকের গোটা দিনটার কথা । তার পাগল গুরুর থেকে চেয়েচিন্তে নিয়ে এবার থেকে কবিতা পড়বে , অনেক কবিতা। যে মানুষের জীবনে গানের পাশে, ছবির পাশে, স্তব্ধতার পাশে কবিতাও থাকে, সেই মানুষের দিকে তাকালে সব হিংসা দাঁত নখ লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য । ওই যে ,একহারা চেহারার শ্যামলা দিদিমণি– উন্মনাদি , শেষে উঠে কী সুন্দর ভাবে কবি সুকান্তর ছাড়পত্র শোনালো ! আহা ! কী সুন্দর লাইনগুলো! চলে যাবো , তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ , প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল। আহা রে! কলকাতা শহর এমন দামাল ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলোনা ? স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে , মাত্র একুশ বছর বয়সে কিশোর কবিকে চলে যেতে হল ?
তারপর উন্মনা দিদিভাই ছাড়পত্র শেষ করে রবিঠাকুরের বাঁশিওয়ালা শোনালো যে ! ও জীবন , বাঁশিওয়ালা কেমন বাঁশিওয়ালা গো ? যাকে দেখবার জন্য…নারীর মন এত উতলা হয় ?
আচ্ছা, আমার গান শোনবার জন্য তেমন করে কি কেউ কোনোদিন আসবে ? কোনো উস্কোখুস্কো চুলের বনদেবী ? শীতশেষে ঝরাপাতার উপরে পায়ের শব্দ তুলে সামনে এসে , আমার হাতে তুলে দেবে নতুন একতারা ? বলবে — তোমার গানের জন্য কান পেতে আছি গো ক্ষ্যাপা !
নাঃ , এবার অমলেন্দু স্যারের কাছে আমাকেও নাড়া বাঁধতে হবে… বিন্দাস ভাবে,ভাবনার দিগন্ত মেলে দেয় অন্ধকার টিলা জঙ্গল পেরিয়ে।
সন্ধের দূরপাল্লার বাস ধীরে ধীরে জঙ্গলমহল পেরিয়ে বাঁকুড়া জেলায় ঢুকে যাচ্ছে।
কোথাও কখনও ঘর না বাঁধা ক্ষ্যাপা বিন্দাস রঙচটা পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে বিড়বিড় করলো–আবার কবে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে গো কবিবন্ধুরা ? গানের পাশাপাশি কবিতা শুনতেও যে এত ভালো লাগে — কই, আগে তো জানতাম না !

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।