• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ৩০)

রূপকথা পৃথিবীর

ভালো থাকো বললে যেন
সুখে থাকাই বুঝতে পারি,
গান গাইলেই আকাশ মাটি
গেয়ে ওঠে সারি জারি।
নদী যেন গ্রাম না গিলে
আপন-মনে সাগরে যায় ,
জীবন যেন জীবন ছেড়ে
যাবার সময় দুবার তাকায় ।
মামার বাড়িতে রবিবারের আনন্দবাজার নিয়ে সকালে উঠেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। হাতে হাতে ঘুরতে থাকে রবিবারের টাটকা কাগজটা । সেজোমামা চায়ের কাপ আর আর খবরের কাগজটা নিয়ে বসে সিনেমার পাতায় চোখ রেখেছে , আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ আটকে গেল একটা অদ্ভুত সুন্দর কবিতায়। সেজোমামাও সেটা লক্ষ্য করলো । সিনেমার নামটা এমন ভাবে লেখা , যেন একটা ভাঙা , ইঁট বার করা পাঁচিলের গায়ে কিছু কথা লেখা রয়েছে। তপন সিংহের নতুন ছবি আপনজন’এর নিচে একটা কবিতা লেখা। সেজোমামা বললো– জোরে জোরে পড় , ভালো লাগবে। বড়োমামাও এগিয়ে এলো কাছে । সবার হাতে চায়ের কাপ , সবাই শুনছে , তাদের ভাগ্নে ঝন্টু কি পড়ছে । মা আর দিদিমা একসাথে চুপ করে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে। নীলমণির মার হাতে ব্রিটানিয়া থিন আ্যারারুট বিস্কুটের কৌটো। আমার কিন্তু চা জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে। বাঁ হাতে দুটো বিস্কুট ধরা‌। আমি বেশ জোরে জোরে পড়তে লাগলাম ,আপনজন সিনেমার বিজ্ঞাপনটা —
স্কুল-কলেজে খিল , রাস্তায় মিছিল ।
ক্র‍্যাকারে কাঁপে রাজপথ ,
কিনু গোয়ালার গলি ,
হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি।
বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ওঠে জোছনা !
ময়লা হাতে যেন ওকে ছুঁসনা ;
ওরে মন , পৃথিবীর গভীর গভীরতর
অসুখ এখন।
বিশ্বাস কর দিদি , আমাকে অন্তত তিন তিনবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতাটা পড়তে হলো। বড়মামা বললো– জীবনানন্দের ছোঁয়া রয়েছে , কিন্তু এত সুন্দর সিনেমার বিজ্ঞাপন আমি কখনো দেখিনি। সেজোমামা আমার কানে কানে বললো — ঝন্টু , বিজলীতে চলছে সিনেমাটা , দারুণ হিট করেছে। মেরে দিবি আমার সঙ্গে ? আমি ফিসফিস করে বললাম– কী ভাবে ? প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলায় তো….. সেজোমামা বললো –আজ তো ব্রিগেডে মিটিং, কালকের দিনটা একটু ফাঁকা থাকবে , রেডি থাকবি । আমি অফিস থেকে ফিরেই , তোকে নিয়ে ছুটবো । লাইন দিয়ে দেখতে হবে কিন্তু । মাসের শেষ , আমার পকেটে পয়সা নেই । আমি বললাম — কতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে ? সেজোমামা অবলীলায় বললো — ধরে নে ঘন্টা দুয়েক। বিজলী সিনেমার যেখানে লাইন পড়ে , তার সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে — বিজলী গ্রিল।ওখানকার ফিশ রোল যা খেতে না ! আমি অবাক হয়ে বললাম — এই যে বললেন , মাসের শেষ ; পকেটে টাকা নেই ! সেজোমামা দরাজ হেসে বললো– ও ফিস রোলের টাকা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। চল চল মেরে দিই। এই হচ্ছে আমাদের সেজোমামা । সবসময় খুশ মেজাজে। রাত জেগে দেয়ালে দেয়ালে বামপন্থীদের প্রচারের ছবি আঁকছে । মাঝরাতে একটু ঘুমিয়ে , ভোরবেলা উঠে পড়ে সেই খিদিরপুরে , হাইড রোডের অফিসে ছুটছে । ছটা-দুটো ডিউটি । তারপর বাড়ি ফিরে এসে , আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে পার্টির কাজে। আমার তো ঘোর লেগে গেছে ওই সিনেমার বিজ্ঞাপনটা দেখে । বড়মামা বললো — দুটো নতুন ছেলেকে তপন সিংহ এই ছবিতে প্রথম আনলো — স্বরূপ দত্ত আর সমিত ভঞ্জ ।আজকের প্রজন্মের দুই যুবক । দুটো দলের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। শেষটুকু বলছি না ,খুব ভালো লাগবে দেখতে। আমাদের অনেক সৌভাগ্য , ছায়া দেবীর মতো একজন আন্তর্জাতিক মানের অভিনেত্রী আমরা পেয়েছি।
সেদিন সারা বিকেল ব্রিগেডে…লালে লাল জনসমুদ্র ! এ তো চেতলা পার্ক বা দেশপ্রিয় পার্ক নয় , সারা কলকাতার ফুসফুস। বিশাল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আমি মেজোমামার হাত ধরে , কেমন যেন হারিয়ে গেলাম ওই জানসমুদ্রের মধ্যে। চেতলার কমরেডদের খুঁজে বার করে , সেখান থেকে খাবারের প্যাকেট বিলি করা শুরু করলাম সবার সঙ্গে। পিতলের কলসি থেকে , মাটির ভাঁড়ে আদার কুচি মেশানো হাতে গরম চা !
আমি কী দেখলাম জানিস দিদি? খাবারের প্যাকেট পেয়ে গ্রাম থেকে আসা কমরেডদের সে কী আনন্দ ! আর কৌটো ঝাঁকানোর সময় , অল্প একটু জায়গার মধ্যেই কৌটো ভরে গেল সিকি আধুলিতে । স্টেজে যখন জ্যোতি বসু উঠলেন , তখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না । শুধু যেন মনে হচ্ছে , ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কেউ গমগমে গলায় এমন কিছু শপথবাণীর কথা বলছেন , যা আমার রক্তকে দুলিয়ে দিচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে — লেখাপড়া , খেলাধুলোর জগতের বাইরেও, আর একটা বিরাট জগৎ আছে ; যার খবর আমি এতদিন রাখতাম না । এই যে কলকাতার বাইরের বিশাল মফস্বল এলাকা , সেইসব দূরের জেলাগুলো থেকে মানুষেরা এসেছেন অনেক বিশ্বাস নিয়ে , তাঁদের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব মঞ্চে উপস্থিত সব নেতাদের । আর একটা জিনিস বুঝতে পারলাম — এই জনজোয়ারকে , এই আবেগকে সম্মান জানাতে শিখতে হবে। যেমন চুনী গোস্বামী , পিকে ব্যানার্জিকে জানাই, পতৌদির নবাব , জয়সীমাকে জানাই , উত্তম কুমার , সৌমিত্রকে জানাই , সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেনকে জানাই , সত্যজিৎ রায় , মৃণাল সেন, তপন সিনহাকে জানাই — সেইরকম ভালোবাসা , চোখ কোটরে ঢুকে যাওয়া ওই মানুষগুলোর জন্যেও যেন থাকে । মেজোমামা বিড়বিড় করে বলে চলেছে — জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার , আর , প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য । আমায় বললো — লাইন দুটো কোন কোন কবির জানিস ? আমি মাথা নাড়লাম , অর্থাৎ,জানি না। মেজোমামা বললো — প্রথমটা বিষ্ণু দে’র কবিতা ঘোড়সওয়ার , দ্বিতীয় কবিতাটা সুভাষ মুখার্জির মে দিনের কবিতা । মে-দিনের সম্পর্কে তোকে আজ রাত্রে বাড়িতে গিয়ে বলবো। আজ কিন্তু তোকে একটু লেখাপড়া করতে হবে ফিরে গিয়ে। সন্ধের মধ্যেই তো বাড়ি ফিরবো । তুই কিন্তু কোনো আলোচনার মধ্যে না গিয়ে , চুপচাপ আমার ঘরে বসে পড়াশুনো করবি।
মিটিং শেষে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে বসে ফিরতে ফিরতে , ঘোরানো বেঞ্চে লাল পতাকা বুকে নিয়ে বসে থাকা , চেতলার কমরেডদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে ছোটোমামা , বড়মামা ,সেজোমামা , মণিমামা ,আর মেজোমামা , সঙ্গে আমিও। একটা নতুন গান। কিন্তু কী আশ্চর্য উদ্ভাসিত সেই গান —
ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান ,
প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল ,
কমরেড লেনিনের আহ্বান ,
চলে মুক্তি সেনাদল ।
আমার হঠাৎ মনে পড়লো — মিটিংয়ের আগে , স্টেজের ওপর ধুতি পাঞ্জাবি পরে একজন মানুষ , গমগমে গলায় আবৃত্তি করছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের আঠারো বছর বয়স ,আর লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে , কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায় ? আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ওই লাইনটা — কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায় ?
আমার ফুটবল মাঠ , ক্রিকেট মাঠ ,আমাদের ছোট্ট সংসার জীবন , আমাদের সমস্ত না পাওয়া , মায়ের উন্মাদ হয়ে যাওয়া অসুখ , আমার ভালো রেজাল্ট করতে না পারা , দিদির নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া , মা’র ধুলোপড়া হারমোনিয়াম আর তানপুরা , দাদার চোখে চাকরি না পাওয়ার হতাশা , বাবার ক্রমশ বুড়িয়ে যাওয়া — সবকিছুর ওপরে উঠে সুকান্ত ভট্টাচার্য যেন সদর্পে ঘোষণা করছেন — লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে , কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায় ?
পরদিন দুপুর ঠিক সাড়ে তিনটের সময় , ভবানীপুরে , বিজলী সিনেমার বাঁ দিকের গলিতে যখন নব্বই পয়সার টিকিটের লাইনে দাঁড়ালাম আমি আর সেজোমামা , তখন দুপুর তিনটের ম্যাটিনি শো আধঘন্টা হলো সবে শুরু হয়েছে । আমরা বেশ কতক্ষণ রাজা উজির মেরে কাটালাম ফুটপাতে বসে। ভেতর থেকে সমস্ত সংলাপ কিছুটা হলেও কানে আসছে । একটা চিৎকার কানে এলো— কিরে ছেনো , তুই বেরোবি না আমি যাবো ? সেজোমামা বললো — এটা স্বরূপ দত্তের চিৎকার । স্বরূপ দত্ত রোবে , আর সমিত ভঞ্জ হচ্ছে ছেনো। কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা সুন্দর গান ভেসে এলো — আলো আমার আলো ওগো , আলোয় ভুবন ভরা…..
দেখতে দেখতে পাঁচটা বাজতেই , লাইনের সবাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সেজোমামা বললো — ঝন্টু , একটু দূরে যেখানে লেখা রয়েছে বিজলী গ্রিল , ওখান থেকে ফিস রোলের গন্ধ আসছে ! তুই দাঁড়া , আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি । মিনিট পাঁচেক বাদে সেজোমামা যখন ফিরলো , তখন হাতের ঠোঙা থেকে ফিস রোলের গন্ধ ম ম করছে।
রাত সাড়ে ন’টার সময় সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরলাম। রাত সাড়ে দশটায়, বারান্দায় সবাই মিলে খেতে খেতে , শুধু আপনজনের গল্প নিয়েই মগ্ন। আমার মনের মধ্যে অনুরণন তুলছে গুলি খেয়ে ছায়া দেবীর মৃত্যু ,আর ওই ভাঙা দেয়ালে লেখা লাইনগুলো– হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি ।
দিদি দেখিস , এই লাইনগুলো আমি জীবনে কোনোদিন ভুলবো না ।
পরের দিন সকালে মেজোমামার ঘরে –অঙ্ক, খাতা, পেন নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে বুঝলাম — আমি লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে গেছি , বিশেষ করে অঙ্কে। অথচ সামনের বছর আমি ক্লাস এইটে উঠতে চলেছি। তার পরের বছরই তো বেছে নিতে হবে ,আমি সায়েন্স আদৌ পাবো কিনা ।
মায়ের ওপরে একটু ক্ষোভ জমলো , যখন দেখলাম জলখাবারের পরের ওষুধটা খাওয়াবার সময় , মা, টান মেরে সেটা উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মানসিক রোগের ওষুধগুলো বেশ দামী। ভাগ্যিস দুটো ট্যাবলেটই ফেলেছে। নীলমণির মা সঙ্গে সঙ্গে এসে মাকে বোঝাতে বসলো — মলিনা , এরকম ছেলেমানুষী করিস না মা। তোর আর দুই বোন কেমন গুছিয়ে সংসার করছে দ‍্যাখ তো। তোর ছোট ছেলেটা ওর লেখাপড়া করবে কি করে বলতো ? আমি চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এলাম মেজোমামার ঘরে , আবার অঙ্ক বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলাম। এ বাড়িতে অঙ্ক বুঝিয়ে দেবার মতো কেউ নেই। তার কারণ , মামা’রা সকলেই খুব ব্যস্ত । মণিমামা গানের টিউশানিতে। আর, ছোটোমামাও তো সারারাত্তির ধরে সেজোমামার সঙ্গে দেয়াল লিখছে , পোস্টার মারছে । এখনও বোধহয় ঘুম থেকেই….
বলতে বলতেই মেজোমামার ঘরে ছোটমামা ঝোড়ো কাকের মতো ঢুকে পড়লো । ঝন্টু , তুই যদি পরপর দু’দিন সিনেমা দেখিস , তাহলে তোর পড়াশুনোর কী হবে ? আমি অবাক হয়ে বললাম — যা বাবা ! আমি আবার সিনেমা দেখার কথা কখন বললাম ? এই তো কালকেই দেখে এলাম আপনজন । আমার কানের কাছে মুখ এনে ছোটোমামা বললো — পূর্ণতে কি ছবি এসেছে জানিস ? হাটারি । জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার নিয়ে এরকম ছবি খুব কম দেখা যায়। আর একটা যা মিউজিক আছে না ! বলে — লা লা লা লা… করে পুরো মিউজিকটাই শুনিয়ে দিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বললাম — চল পানসি বেলঘরিয়া। ছোটমামা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো বেলঘরিয়া না , ভবানীপুর । সেজদার সাথে তো লাইনে দাঁড়িয়ে দেখেছিস , আমার সঙ্গেও লাইন মেরেই দেখতে হবে কিন্তু । রাজি ? আমি তো পারলে তখনি দৌড় মারি । ছোটোমামা বললো — সিনেমা দেখে কিন্তু , বাড়ি ফিরে খানিকটা পড়াশুনো করে , রাত আটটা নাগাদ পার্টি অফিসে চলে আসবি , পোস্টার লাগাতে যেতে হবে।
দুটোর সময় পূর্ণ’র সামনে গিয়ে দেখি , সব্বোনাশ ! টিকিট পাওয়া আনিমপসিবল । লাইনে রীতিমতো ঠেলাঠেলি,ধাক্কাধাক্কি । মাত্র এক সপ্তাহের জন্যে এসেছে হলিউডের বিখ্যাত সুপারহিট ছবি হাটারি । আমরা শুকনো মুখে অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম — দাদা, দুটো এক্সট্রা হবে ? এমনকি ব্ল্যাকাররাও বাদ গেলো না । দুজন ব্ল্যাকারকে মামু বলে ডাকলেও , তারা একটুও নরম হলো না। কি করা যায় , কি করা যায় ..ভাবছি । ছোটমামা হঠাৎ বললো — এই ঝন্টু , তোর মনে আছে? আরও একদিন আমরা এই পূর্ণ’তে এসে টিকিট না পেয়ে, ইস্টবেঙ্গল মাঠে খেলা দেখতে চলে গেছিলাম । আমি বললাম — হ্যাঁ ,সে তো বছরখানেক আগে বর্ষাকালের কথা । ইস্টবেঙ্গল আর উয়াড়ির ফুটবল ম‍্যাচ। ছোটোমামা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো। মনে আছে সেদিন কি কেলেঙ্কারি হয়েছিল ? আমরা দুজন এখান থেকে টিকিট না পেয়ে, সোজা ইস্টবেঙ্গল মাঠে গেলাম কেন ? তোর মনে আছে ? আমরা তো মোহনবাগানের সাপোর্টার। ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গেলাম কেন ? ঈশারাকে লিয়ে সমঝদারিই কাফি হ‍্যায়…. আমি গম্ভীর মুখে বললাম— অপয়া হয়ে ইস্টবেঙ্গলের পয়েন্ট নষ্ট করতে । সেদিন আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম , মাঠে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে হারাবো , নয়তো একটা পয়েন্ট নষ্ট করাবো । তাই হল কিন্তু। দু-দুবার ইস্টবেঙ্গল গোল করতে না পারলে , আমরা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম । ইস্টবেঙ্গল গ‍্যালারিতে মোহনবাগানের সাপোর্টার ধরা পড়ে গেলে …..
কিন্তু পাশের এক ভদ্রলোক আমার কাঁধটা একটু জড়িয়ে ধরে বললেন — বাবা , ইস্টবেঙ্গল গোল মিস করলে আনন্দ কোরো না। আমাদের কোথাও বুকে ব্যথা লাগে । চুপচাপ খেলা দেখে বেরিয়ে যাও। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না । জানিস তো দিদি , ছোটোমামাকে ফিসফিস করে বললাম — এতদিন জানতাম মোহনবাগানের সাপোর্টাররা খুব স্পোর্টিং হয় , কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরাও যে তাই , তার প্রমাণ পেলাম। এমনিতে তো ইস্টবেঙ্গলের পাঁচ গোলে জেতা উচিত ছিলো, কিন্তু সেই ম্যাচ ড্র হয়ে গেলো যখন , মাঠ জুড়ে কী হা হুতাশ ! তবে , ইস্টবেঙ্গলের রাইট ব্যাক, অল্প বয়সী একজন খেলোয়াড় , নাম শুনলাম সুধীর কর্মকার ; বারবার দূর থেকে উয়াড়ীর গোলে কত গোলার মতো শট মারলো , একটাও গোল হলো না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার চোখে লেগে থাকলো , ফর্সা মতো ছেলেটির খেলা। সুধীর কর্মকার । আহা ! এই খেলোয়াড়কে মোহনবাগান যদি পেতো !
ছোটোমামার আলতো ছোঁয়ায় আমার চটকা ভেঙ্গে গেলো। ছোটোমামা বললো — এখন তো শীতকাল । ময়দানে ফুটবল নেই । চল বাড়ি ফিরে যাই। বড়দির শরীরটা তো ভালো নয় ! তুই মন খারাপ করিস না , আমি তোকে এই ছবিটা দেখাবোই । পূর্ণ সিনেমার দিক থেকে হাজরার মোড়ে হেঁটে যেতে যেতে , বিজলী সিনেমার কাছে গিয়ে বললাম — সামনের কাচের দরজাটা একটু টানুন ছোটোমামা । টানতেই ভেতর থেকে ঠান্ডা এক ঝলক বাতাসের সঙ্গে একটা অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো ! আমি বললাম — ছোটোমামা ,গন্ধ পাচ্ছেন কিছু ? ছোটোমামা বললো– হ্যাঁ , কেমন যেন একটা …..
আমি বললাম — ওটা এয়ারকন্ডিশনের গন্ধ। আর, বিজলী সিনেমার সামনে দাঁড়ালে , এই গন্ধটা সবথেকে সুন্দর পাওয়া যায় ।
বাড়ি ফিরতেই আবার দুঃসংবাদ । মা নাকি আজকে আবার বেরিয়ে গেছিলো ! ছোট মাসির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসে ছিলো। শেষমেশ ছোটোমাসির শাশুড়ি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে , মাকে আবার মামার বাড়িতে ফেরত দিয়ে গেছে। সেই থেকে ছোটোমাসি মা’র পাশে বসে , হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে । ছোটোমামা, আর আমি ঢুকতেই ,ছোটোমাসি হাউমাউ করে বললো– ছোড়দা , বড়দি আবার ভালো হবে তো আদৌ ? গান গাইতে পারবে? আমি নিঃশব্দে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার মধ্যে ঢুকে গেলাম। সন্ধেবেলায় নীলমণির মা যখন , চা জলখাবার আমাকে পৌঁছে দিলো মেজোমামার ঘরে , তখন আমার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে । নীলমণির মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো — অভিমান নিয়ে বসে থাকতে হয় ঝন্টুবাবু ? তোমায় কে বলেছে মলিনা সেরে উঠবে না ? তুই তোর পড়াশুনো মন দিয়ে কর‌। তোকে তো পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে । এই তো ক’দিন বাদেই বাড়ি ফিরে যাবি । আমরাই তো তখন তোর মাকে আগলাবো । পরীক্ষা শেষ হলেই কিন্তু আবার চলে আসবি এখানে । বাইরে হালকা শীতের থমথমে রাত । একটু বাদেই আমি গুটিগুটি পায়ে চেতলা পার্টি অফিসে যাবো । মার কাছে আজকে আমি আর যাইনি । আমি শুধু ভাবছি — জীবনে আমি কী করবো ? আমি কি খেলাধুলো করবো ? নাকি ছোটোবেলা থেকেই রাজনীতিটা করবো মন দিয়ে? নাকি , কিছুই না করে, শুধু একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে ঘরসংসার করবো ? কোনটা বেছে নেবো ? হঠাৎ সব কিছু আমার কাছে কেমন অর্থহীন মনে হতে লাগলো। মনে হলো , এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমার কাছে যদি অনেক ঘুমের ওষুধ থাকতো ; তাহলে , মুঠো মুঠো একসাথে খেয়ে নিতাম । ঘুমিয়ে পড়তাম , যে ঘুম আর কোনোদিনও ভাঙতো না। ভেবেই আমি শিউরে উঠলাম! মা’র তো অনেকগুলো ওষুধ , তারমধ্যে তো ঘুমের ওষুধও আছে , তাই না ?
যদিও ওগুলো আমার কাছে থাকে না , দিদুর ঘরের আলমারির মধ্যে সাজিয়ে রাখা আছে। আচ্ছা, আমি যদি তার থেকে……
আমার গা-হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মনে মনে বললাম — আমি তো বেঁচে থাকতে খুব ভালোবাসি। আমার তো অনেক কিছু করার আছে জীবনে। তাহলে আমি মরে যাওয়ার কথা কেন ভাবছি ? তাহলে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, আঠারো বছর বয়স , লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে , ট্রামের সেকেন্ড ক্লাশ ভর্তি কমরেডদের গলায় — Through the winter’s cold and famine ,
from the fields and from the towns, at the call of Comrade Lenin ,
there arose the Partisans…..
আমাকে তবে কী শেখালো ? আর, আমার প্রিয় মেজোমামার দুই স্বপ্নদেখা চোখে , আগামী কৃষক বিপ্লবের স্বপ্ন ? কোন কিছু দেখবো না ? জীবন থেকে পালিয়ে যাবো ?

আগামী সংখ্যায় সমাপ‍্য

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।