গল্পে অর্পিতা বোস

ভান

ছবিতে রজনীগন্ধার মালাগুলো একটু হালকা করে দিলে বোধহয় ভালো হতো। বড় ছবি হলেও মালায় াছবির অনেকটাই ঢেকে গেছে। মনে হচ্ছে যেন প্রতিমাকাকির কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ছেলের বৌ বা নাতি নাতনি কাউকেই দেখছিনা। আমিই উঠে ঠিক করব কী করবনা দোটনার মাঝেই দেখি শর্মিষ্ঠা বৌদি একগাল হেসে অতিথিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শর্মিষ্ঠা বৌদি প্রতিমাকাকির ছেলের বৌ। অবাক হয়ে গেলাম সাজ দেখে! দামী (দামি) বাংলাদেশী সাদা-তুঁতে ঢাকাই, আভরণ ও সাজগোজ গুলিয়ে দিচ্ছে উৎসববাড়ি ও শোকেরবাড়ির পরিবেশ। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই প্রায় এমন সেজেছেন যেন বিয়েবাড়ির দিনেরবেলা। নিজের দিকে তাকিয়ে যেন এই সাদামাটা পোশাক বড়ই বেমানান লাগছে। ব‍্যাগ থেকে জুঁইয়ের মালাটা বের করব কি করবনা ভাবছি। এমন সময় এক মহিলা বেশ হেসে বৌদিকে শাড়ির কথা বলতেই বেশ জোর গলায় বৌদির কথায় চমকে গেলাম,
— মা খুব ভালোবাসতেন আমাকে। এই শাড়িটা কেনার সময় বলছিলেন (বলেছিলেন) ওনার শ্রাদ্ধশান্তিতে পরতে। মায়ের কথা না রেখে পারলাম না গো। খুব ভালোবাসতেন। আমাদের খুব ভালো বন্ডিং ছিল।
কথার সাথে সাথে রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো বৌদি।
এই শোকের বাড়িতেও খুব হাসি পেল। প্রতিমাকাকির সাথে বৌদির বন্ডিং!


গরমের ছুটিতে এসিতে শান্তির ঘুমটা ভাঙল বেলের আওয়াজে। একটু বিরক্ত হলেও দরজা খুলে দেখি প্রতিমাকাকি। বিনবিন করে ঘামছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-এই দুপুর রোদে তুমি!
আঁচলে ঘাম মুছে। একটু হেসে বললেন,
– চলে এলাম রে। আসলে বিকেলে বৌমা একটু ঘুমায় তো। তখন তোর মা আমাকে ডাকতে কলিং বেল বাজায়। বৌমার ঘুম ভেঙে যায়। তাই ভাবলাম চলে আসি আমিই। তাছাড়া দুপুরে খুব গরম আমার বাড়ি। তোদের এখানে বেশ ঠান্ডা। তাই ভাবলাম…
— কিন্তু তোমার বাড়িতেও তো সব ঘরেই এসি আছে গো…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা এসে বলল,
– আরে প্রতিমা এসো এসো।
মায়ের কথায় আমাদের কথোপকথনে বাধা পড়ল। প্রতিমাকাকিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— ঘুমিয়ে নে আরেকটু। আমি বোধহয় তোর ঘুম ভাঙালাম।
ঘরে যাইনি। দুই বন্ধুর মাঝে শুয়ে পড়লাম। প্রতিমাকাকির কোলে মাথা রেখে। সুরভী জর্দার মিষ্টি গন্ধটা প্রতিমাকাকির গা থেকে আসে। একটা অদ্ভুত নেশা হয় আমার।স্মৃতিরোমন্থনে ছুঁয়ে এলাম ফেলে আসা সময়।


মা আর প্রতিমাকাকি বহুবছরের বন্ধু। এপাড়ায় তখনও ফ্ল‍্যাট কালচার আসেনি। রোয়াক ছিল বাড়ির বাইরে। প্রতিবেশিনী থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্করা তখন মনের সাথে পরিবারকেও বাঁধতে পারত। রোজ বিকেলে মা, প্রতিমাকাকি, কঙ্কন কাকিমারা গল্প করতেন। পি এন পি সিও ছিল। আর ছিল বিশেষ বিশেষ খাবার চালাচালি। প্রতিমাকাকির হাতের ঘুগনির স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। মা আর প্রতীমাকাকির মধ্যে সেই বিয়ের পর থেকেই বন্ধুত্ব। সেই সম্পর্ক দিন দিন গভীরতর হয়েছে। প্রতিমাকাকি অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত দু’জন একসাথে বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন। এমনকি নার্সিংহোমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ফোনেই কথা বলতেন রোজ। মার কাছে জেনেছি সুখদুঃখের কথায় প্রতিমাকাকি শুধুই কষ্টের কথা বলতেন। শারীরিক নয় মানসিক।
শর্মিষ্ঠা বৌদির ব‍্যবহারে প্রায়ই মানসিকভাবে আহত হতেন। আর আজ শর্মিষ্ঠা বৌদির মুখে “আমাদের মধ্যে খুব ভালো বন্ডিং ছিল” কথাটায় বড় হাসি পেল।
অথচ প্রতিমাকাকির জর্দার গন্ধে নাকি ইদানিং বৌদির মাথা ধরত শুনেছি। খুব দুঃখ করতেন।
এসব ভাবনায় ছেদ পড়ল বেশ হইহই হাসির শব্দে। চমকে পিছনে তাকাই। প্রতিমাকাকির নাতি আর তার বন্ধুরা গল্পগুজবের সাথে বেশ জোরে হাসিঠাট্টায় মশগুল।
মনে পড়ল এই নাতির খুব ছোট্ট বয়সে একবার জ্বর থেকে তড়কা হলো। প্রতিমাকাকি খালি পায়ে নাতিকে নিয়ে দৌঁড়েছিলেন পাড়ার দিলীপ ডাক্তারের বাড়ি। আর আজ ঠাকুরমার শ্রাদ্ধশান্তির কাজে নাতি শোকটুকুও ভুলে গেছে!
-আরে তুলি কখন এসেছ? শরবত, মিষ্টি নিয়েছ?
শর্মিষ্ঠা বৌদির কথায় ঘোর কাটল।
আমার কথা বলার আগেই একজনকে বেশ উচ্চস্বরে ডাকে। শরবত আর মিষ্টির প্লেট নিয়ে তিনি হাজির। আমি ইতস্তত করছি দেখে বৌদি বলল,
— খাও। একদিন মিষ্টি খেলে কিছু অসুবিধা হবেনা। মিষ্টিগুলো সব ভীমনাগ থেকে আনা। সব তোমার কাকির পছন্দের। ফুলের মালা থেকে খাবার সব। দুপুরের মেনুও সব মায়ের পছন্দের। তোমাকে আর কী বলব! জানোই তো মা কেমন খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসতেন। ওমা! একটা মিষ্টি কি নিচ্ছো (নিচ্ছ)!
আমার হাতে মিষ্টির প্লেট তুলে দিতে গেলে ঠাকুর মশাই হঠাৎই বলে উঠলেন,
— একটু আস্তে কথা না বললে মন্ত্রপাঠে অসুবিধা হচ্ছে।
মুখটা বেঁকিয়ে অন্য একজনের কাছে যাওয়ার আগে বৌদি কানের কাছে বলে গেল,
– দুপুরে খেয়ে যেও কিন্তু। তোমার বাবানদাকে জানোতো। সবসময় বেস্ট চায়। লেক মার্কেট থেকে ফুল আনিয়েছে। নামি (নামী) ক‍্যাটারারকে দিয়েছে খাবারের দায়িত্ব। খেয়ে যেও কিন্তু।
আমি চুপ করে দেখলাম ছবিতে প্রতিমাকাকির মুখটা রজনীগন্ধার মালায় প্রায় ঢেকে গেছে। চশমা পড়া চোখদুটোতে যেন কষ্টের ছাপ। আমার ব‍্যাগ থেকে আর জুঁইফুলের মালাটা বের করা হলোনা।


এই সুগারের জন্য আমার আজকাল কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। তলপেটে চাপ পড়লে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা। এই ভাড়াবাড়ির একদম তিনতলার ছাদে বাথরুম। সিঁড়ি ভেঙে উঠে হাফাচ্ছি। এখানেই দুপুরের খাবারের আয়োজন। তবে এখন শুধুই চেয়ার-টেবিল। না না, চোখ আটকে গেল। প্রতিমাকাকির নাতনি আর একটি ছেলে। এককোণে ঘনিষ্ঠভাবে সেলফি তুলতে ব‍্যস্ত। অপ্রস্তুত আমি কী করব বুঝতে পারছিনা। একটা শুকনো কাশির শব্দ করলাম। ওরা আচমকা আমাকে দেখে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালো। আমিও বাথরুমে চললাম।
নীচে (নিচে) নেমে দেখি শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ। সবাই নিজের মতো আলাপচারিতায় ব‍্যস্ত। কেউ কেউ প্রতিমাকাকির ছবিকে পেছনে রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে গল্পে মশগুল। প্রতিমাকাকির ছবিটা এখন রজনীগন্ধার মালায় ঢেকে গেছে। মুখটাও দেখা যাচ্ছেনা। সবার অলক্ষ‍্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম। রজনীগন্ধার স্তুপে আর আমার আনা জুঁইফুলের মালাটা পরাতে ইচ্ছে হলোনা।


দরজা খুলে মায়ের মুখটা দেখেই বুঝলাম খুব কেঁদেছে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে গেল। আমিও পিছু নিলাম। বিছানার ওপর বেশ কিছু পুরোনো কিছু সাদা-কালো আর অল্প কিছু রঙিন ছবি। একসাথেই সবজায়গায় বেড়াতে যেতাম আমরা আর প্রতিমাকাকির পরিবার। বাবার ক‍্যামেরায় তোলা সেসব ছবিরা আজ আবার মা বের করেছে। প্রতিমাকাকির বেশ কিছু ছবি। মায়ের সাথে,কাকুর সাথে, বাবানদাদা আর আমাকে নিয়ে। সুবর্ণরেখার তীরে প্রতিমাকাকির একটা সিঙ্গেল ছবি। মাথায় জুঁই ফুলের মালা। প্রতিমাকাকি সবসময় বলতেন,
— আমি মরে গেলে,খবরদার, রজনীগন্ধার মালা দিবি না। জুঁইয়ের একটা মালা পরাস শুধু।
মা ছবিটা হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল,
–বহুবছরের বন্ধু আমার হারিয়ে গেল রে তুলি!
আপনজন হারানোর শোকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কষ্ট তো আমারও হচ্ছিল। বড়ো ভালোবাসাতেন। মায়ের অপারেশনের সময় আমাকে নিজের কাছে রেখে আত্মজার মতোই যত্ন করেছেন। প্রতিমাকাকির স্নেহের পরশ আজও আমার মনে ছড়িয়ে আছে। নাচের অনুষ্ঠানে অথবা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় ছোটবেলায় প্রতিমাকাকিই আমাকে সাজিয়ে দিত। আমাদের বাড়ির সামনের জুঁইগাছটাও প্রতিমাকাকির হাতে লাগানো। বলতেন,
– আমি মরে গেলে এই গাছের ফুলের মালা পরাস।
আমার ব‍্যাগে আজ সকালে সেই গাছেরই ফুলে গাঁথা মালাটা এখনও রয়েছে।
সিঙ্গেল ছবিটা টেবিলে একটা বইয়ে হেলান দিয়ে রাখলাম। পোস্টকার্ডের থেকে ছোট ছবি। খুব সুন্দর করে হাসছেন। ব‍্যাগ থেকে জুঁইফুলের মালাটা বের করলাম। পরানো যাবেনা এত ছোট ছবিতে।সামনে সাজিয়ে রাখলাম। ফুলের সুবাস যেন ছবিতে প্রতিমাকাকির হাসিতে ছড়িয়ে গেল। তৃপ্তির ছাপ। সুরভী জর্দার গন্ধটা আর কখনও পাবনা! বুকটা মুচড়ে চোখে জলের ধারা নামল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।