অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৯)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

কবিজন্ম বলে কিছু কি আছে ?
কলকাতা বা ডুলুং নদীর কাছে ?
যেখানে জীবন অবাক ও উচ্ছ্বল…
কারা পায় সেই ইশারা অনর্গল ?

জানুয়ারির রবিবারের আকাশটা ঝাড়গ্রামের এই প্রাইমারি স্কুলের উঠোনে যেন একটু বেশিই লুটিয়ে পড়েছিলো। এত গাঢ় ও স্বচ্ছ নীলাকাশ সচরাচর চোখে পড়ে না । নাকি , উন্মনাই ওর উন্মুখ অন্তরকে একটু বেশিই খুলে রেখেছিলো , তাই এমন মনে হল! ব্রেকফাস্টের টেবিলে সবাই খাবে কি — শুধু কুশল বিনিময় করতে করতেই সময় যে কোথা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল,কেউ বুঝতেই পারছিল না। প্রলয় , শুভব্রত ফুলকুশমার ডাক্তার বাবু , মেলেডার হেডমাস্টার মশাই, আর শীতের শেষে বসন্তের মতো , ঝরাপাতার অন্তর থেকে পলাশের কুঁড়ির মতো একঝাঁক তরুণ কবি ! সার্ট , পাঞ্জাবি , চুড়িদার , জিনস , শাড়ি , এমনকি নিখাদ ধুতি পাঞ্জাবিতেও যে বাংলা কবিতা এমন করে সাজতে পারে,তা উন্মনা অন্তত জানতো না।মেদিনীপুর কলেজের আন্তরিকতা ওকে মুক্ত মন ,মুক্ত চিন্তা আর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের দিগন্ত দিয়েছিল ঠিক ; তবুও কবিদের সম্পর্কে ওর এবং ওদের বরাবর একটু দূরত্ব রেখে চলার প্রবণতা ছিল। মেদিনীপুর শহরের নাটক , কবিতা চর্চার মধ‍্যে , ওরা বেশি পছন্দ করতো নাটককে । কবির মুখে কবিতা পাঠের থেকে ,বাচিক শিল্পীদের পরিশীলিত কণ্ঠের নিবেদনকেই উন্মনাদের দলটা একটু বেশিই নম্বর দিয়ে ফেলেছিল যেন । মুখে না বললেও , মনে মনে অন্তত তাই জানতো এবং মানতো । কিন্তু ব্রেকফাস্ট টেবিলের নিবিড় সান্নিধ্যে , পুরুলিয়ার তরুণ কবি যখন আলুর দম মাখা হাতেই বীরভূমের মাঝবয়সী কবির ফোন নম্বর খাতায় তুলে নিচ্ছিল , অভ্রঝিলিক মুকুটমণিপুরের মেয়েটি , পূর্ব মেদিনীপুরের পরিচিত কবির কথাগুলো যখন খাওয়া বন্ধ রেখে হাঁ করে শুনছিলো ; তখন, ঠিক সেই মুহূর্তেই উন্মনার মনে হলো — কবিতার ভুবনটাই যেন সাহিত‍্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ । মনে পড়লো কবি কৃষ্ণা বসুর একটি উক্তি ।মেদিনীপুরের একটি সাহিত্য সভায় তিনি বলেছিলেন– সারস্বত সমাজের শ্রেষ্ঠ নিবেদন হল কবিতা । জীবনে যা কিছু সুন্দর , যা কিছু অপরূপ তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমরা বলি — কবিতার মতো সুন্দর । জীবন একদিন কবিতার মতো সুন্দর হবে । ‘মেয়ে মানুষের লাশ’ কবিতার রচয়িতা প্রিয় কবি কৃষ্ণাদির এই কথাগুলো উন্মনা আরেকবার মিলিয়ে নিলো উজ্জ্বল তরুণ কবিদের চোখে চোখ রেখে । প্রায় কেউ ওকে চেনেনা , তবু যেন কতকালের চেনা ! প্রলয় আর মেঘলা খুব ব‍্যস্ত , তাড়াতাড়ি করে এই ব্রেকফাস্ট পর্বটা মেটানোর জন‍্য । এরই মধ‍্যে মেঘলা মাইক্রোফোনে বার দুয়েক ঘোষণা করেছে — আর পাঁচ দশ মিনিটের মধ‍্যে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে । একটু দূর থেকে হলেও উন্মনা স্পষ্ট দেখলো – স্টেজের ওপর একটা সাদা রঙের বোর্ড ।তাতে যত্ন করে লেখা– কবিতার কর্মশালা । স্টেজের নিচে দুটো চেয়ারে দুজন মাঝবয়সী মানুষ । হাতে একতারা নিয়ে একজন কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে , আরেকজন মন দিয়ে সেই হাসির কথাগুলো শুনছে , কিন্তু একটুও হাসছেনা । সেই রামগড়ুরের ছানা মার্কা লোকটা একটা লম্বা বিড়ি ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়তেই দূর থেকে উন্মনা প্রচন্ড বিরক্ত হলো। হঠাৎ ওর চিন্তার জাল ছি়ঁড়ে দিয়ে মেঘলা এসে সামনে দাঁড়ালো । সেকি ? এখনো তোমার খাবার শেষ করোনি ? তোমাকে তো প্রথমেই আমাদের দরকার ,উন্মনা। অমলেন্দু সেই কখন থেকে — শুরু করো শুরু করো বলে তাড়া লাগাচ্ছে । তাড়াতাড়ি কফি শেষ করে মাইক্রোফোনের সামনে এসো । উন্মনা লজ্জায় লাল হয়ে গেল । অমলেন্দুবাবু এসে গেছেন ? মেঘলা যেতে গিয়েও পাহাড়ি ঝর্ণার মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো– সে কি , তুমি দেখোনি ? স্টেজের নিচে বসে ফুকফুক করে বিড়ি টানছে , আর গায়ক ক্ষ‍্যাপা বিন্দাসের সাথে গল্প করছে । ওই তো অমলেন্দু । উন্মনা , তাড়াতাড়ি করো । এক মিনিটের মধ‍্যে চলে এসো।উন্মনা যেন একটু মিইয়ে গেল । কবি ও সাংবাদিক অমলেন্দু মন্ডল , যার এত নাম শুনেছে , যার বন্ধু মেঘলা অপূর্ব রূপসী আর প্রাণবন্ত , তিনি এতটা গম্ভীর মানুষ ? নাকি ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন ব‍্যক্তিত্বের ঘেরাটোপে । কোনো হাসিমুখের মানুষকে দেখলেই তো প্রথমে একটা ভালো লাগা তৈরি হয় , যেমন উত্তমকুমারের হাসিমুখ । আর , বিড়ি খাচ্ছেন কেন ? সিগারেট বিড়ির ধোঁয়া অসহ‍্য। ইদানিং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাও পর্যন্ত যেখানে তামাকের নেশা ছেড়ে দিচ্ছে, সেখানে একজন উদাহরণযোগ‍্য ব‍্যক্তিত্ব কিভাবে সবাইকে দেখিয়ে পাবলিক প্লেসে ধুমপান করছেন ? উন্মনার এই দমে যাওয়া মনটাকে চাঙ্গা করে দিলো অন্তহীন এনার্জির অবিকল্প কবিরূপ শুভব্রত এসে। দ্বিধাহীন বললো — দিদিভাই , তোমাকে সামনে রেখে আমি আর প্রলয়দা আজকের দিনের শেষে একটা প্রস্তাবের খসড়া সবার সামনে রাখবো । আমাদের এই প্রান্তিক জেলাগুলোর বেশ কয়েকজন তরুণ কবির কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। আমারই মতো তারা বারবার চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে আর অকৃতকার্য হচ্ছে , নয়তো বছরের পর বছর হাঁ করে বসে থাকছে ফলাফলের আশায়।জমিজমা ঘরবাড়ির অবস্থা খুব শোচনীয়। মা বাবা তাড়িয়ে দেয় না , আবার জামাই আদরও করে না। আমার তবু সামান্য জমি আর একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে। দু একমুঠো ছাত্র পড়াই , কিছু না পেলে সিঁড়ির তলায় বিড়ির দোকান করেও দিন চালিয়ে দেবো । প্রলয়দা বিবাহিত , তবু লড়াই করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার গরীবস‍্য গরীব কবিবন্ধুদের কি হবে দিদিভাই ? ওর বলার ভঙ্গিতে উন্মনা ফিক করে হেসে উঠতে গিয়েও , কবি শুভব্রতর টলটলে শান্ত মুখের ওপর অকালবৈশাখীর থমথমে ছায়া দেখে থমকে গেল ।সত‍্যিই তো ! একটা উচ্চশিক্ষিত ছেলের ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত সিঁড়ির তলে বিড়ির দোকান ? আর সময় নেই ।স্টেজের ওপর মেঘলার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে দ্রুত এগোতে গিয়েও , শুভব্রতর শেষ কথাগুলো যেন কানের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে গেঁথে গেল‌। লক্ষ্যে বিদ্ধ তীর হয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলো– দিদিভাই , কবি সম্মেলনের শেষে মেঘলাদি ,অমলেন্দুদা সবাই চলে যাবে তাদের নিজস্ব সফলতার জগতে। উড়োখই হয়ে থেকে যাবো , তুমি আমি প্রলয়দা । আর ক্রমশ কলম নিস্তেজ হতে হতে ভস্মশেষের ছাইয়ের মতো পড়ে থাকবে– কয়েকজন তরুণ কবি , যারা লেখাপড়া শিখে মানুষকে না ঠকিয়ে , বাংলা ভাষাজননীর আঁচলের কোণাটুকু ধরে বাঁচতে চেয়েছিল । কথাগুলো তোমাকে জানানোর কথা ছিল প্রলয়দার । দেখতেই পাচ্ছো ,ও এখন ভীষণ ব‍্যস্ত ।শূন‍্য আঁকড়ে ধরেও আমাদের বাঁচবার চেষ্টা করতে হবে। দিদিভাই ,আমাদেরও কবিজন্ম বলে কিছু একটা আছে । আমাদের কাছে সেটা খুব দামী । হ‍্যাঁ দিদিভাই , মাটি আঁকড়ে থাকা শিকড় আর মায়ের স্নেহের মতোই দামী।
দু’চোখ ছাপানো জল , আর প্রিয় দুই কবিভাই শুভব্রত ও প্রলয়ের জন‍্য ভরা সর্ষে ক্ষেতের মতো দু’কুল ছাপানো ভালোবাসা দিয়ে‌, উন্মনা যখন স্টেজে গিয়ে দাঁড়ালো , তখন ওর অফ হোয়াইট কাঁথা স্টিচের শাড়ি আর মেরুন ব্লাউজে সকাল এগারোটা দশের কাঁচা রোদ্দুর লুটিয়ে পড়লো । কোনো কোনো নারীর বেদনা যেন স্থায়ীভাবেই থেকে যায় তার নম্র চোখের পাতায় , নাকের পাটায় ,আর উদাসীন চিবুকের গভীরতায় ।তবু সব কিছু পেরিয়ে বিষণ্ণতার ওপারে থাকে শীত ঋতুর আলতো হাসি ।
মাইক্রোফোনের সামনে নমস্কার বলার আগের মুহূর্তে উন্মনার মনে হলো — অভিজ্ঞতা ও তারুণ‍্যে মেশা এই যে পঞ্চাশ-ষাট জোড়া চোখ , সেখানে কোথাও ঝঞ্ঝা বার্তার সতর্কতা নেই , বিমান আক্রমণের সাইরেন নেই , তাচ্ছিল্যের ঔদ্ধত্য নেই।তাহলে কি আছে ? আছে একটা নিটোল ও অতলান্ত কবিজন্ম । বুদ্ধ ও শ্রীচৈতন্যর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি হয়ে যা ঘোষণা করবে — আগামী পৃথিবীতে মানুষ ও প্রকৃতির জন‍্য এই দুনিয়ায় পুরোটাই থাকবে । জয়-পরাজয় সবকিছুই ফুল হয়ে ফুটে থাকবে সেখানে।
মেঘলা উন্মনার পিঠে আলতো ছোঁয়া দিয়ে বললো– প্লিজ উন্মনা , দেরি হয়ে যাচ্ছে । তোমার কাজ শুরু করো ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।