সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “ভারত ও পাকিস্থানের দুই পিকাশো – ১”- লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ১৬)

ভারত ও পাকিস্থানের দুই পিকাশোঃ মকবুল ফিদা হোসেন, সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি – ১

২০০৪ সালে আঁকা লাস্ট সাপার (“Last Supper” ) প্রায় ১৫ কোটি টাকায় বিক্রী হয়েছে।Credit…Sebastian D’Souza/Agence France-Presse — Getty Images
মকবুল ফিদা হোসেন  Maqbool Fida Husain (17 September 1915 – 9 June 2011) যাকে ভারতীয় পিকাশো বলে সম্বোধন করতেন অনেকে, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে জন্মান। স্থানঃ মহারাস্ট্রের পান্ধারপুর গ্রামে। তার রক্ত সূত্র ইয়েমেন এর সুলেমান বোহরা পরিবারের যারা গুজরাটে ২০০ বছর ধরে বাস করছিলেন।(উইকিপিডিয়া সূত্র) তিনি কৈশোরে বরোদা মাদ্রাসায় থাকা কালীন একজন দর্জির সহায়ক হিসাবে, তারপর একজন ড্রাফটসম্যানের অধীনে কিছুদিন কাজ করেন। ক্যালিগ্রাফি, কালি কলমে লিখনরীতি চর্চার সময় ছবির আকর্ষনে ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে, ২০ বছর বয়সে জে জে স্কুল অব আর্টস এ ছবি আঁকতে ভর্তি হন।
মকবুল হুসেনের মা জুনৈব মারা যান অতি শৈশবে। পিতা ফিদা হুসেন আবার বিয়ে করেন। এবং ইন্দোর চলে আসেন। মকবুল সেখানে স্কুলে পড়াশুনা করেন। ২০ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে তিনি মুম্বাই(বোম্বে) আসেন। বোম্বেতে জে জে স্কুল অব আর্ট এ ভর্তি হন। ২৫ বছর বয়সে, ১৯৪১ সালে বিয়ে করেন। প্রথম দিকে সিনেমার হোর্ডিং বানিয়ে জীবিকা শুরু করেন, পরে একটা খেলনা বানানোর কোম্পানীতে চাকরি করেন। সেখানেই নকশা বা ডিজাইন বানানো তার অভ্যেস হয়। তার রোজগার ছিল খুব কম। সেখানে তিনি বিজ্ঞাপন জাতীয় বলিউডের সিনেমা পোস্টারের কাজে যোগ দেন। তিনি বলেছেন, প্রতি স্কোয়ার ফুট চার থেকে ছয় আনা পেতেন। একটা বিলবোর্ড বা ব্যানার সাধারণতঃ ৬ বাই ১০ ফুটের মাপে হত। অনেকে কখনো পয়সাই দিতনা। সময় পেলে তিনি তখন সুরাট, বরোদা, ও আহমেদাবাদ যেতেন দৃশ্যচিত্র আঁকার জন্য। কম পয়সা পেতেন বলে কখনো খেলনা কোম্পানীতে ডিজাইন বা নকশা এঁকে উপায় করতেন। ১৯৪৫ সালে বোম্বে আর্ট সোসাইটি তার ছবি মুম্বাইতে প্রদর্শন করায়।
এই সময়টা এমন একটা সময় যখন বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট জাতীয়তাবাদী ধারায় এক নতুন ভারতীয় শিল্প আন্দোলন করছিল, সেই সময় মকবুল ও তার তরুণ বন্ধুরা ভারতীয় শিল্পকে আন্তঃর্জাতিক আঙ্গিনায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্থানের সৃষ্টি তখন ধর্মীয় দাঙ্গায় প্রচুর মানুষের বলিদান চলে, সম্পত্তির প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন প্রোগ্রেসিভ আর্টিষ্ট গ্রুপ ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে গড়ে উঠে। এই জোটবদ্ধ শিল্পীরা দেখলেন ভারতের নতুন শিল্প তৈরি করার পক্ষে এক শুভলগ্ন। ১৯৫২ সালে মকবুলের প্রথম একক প্রদর্শনী জুরিখে, ১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কের ইন্ডিয়া হাউসে হয়।  ধরা হয় ৬০ ০০০ ষাট হাজার ছবি এঁকেছিলেন আর অনেকগুলি সিনেমা বানিয়েছিলেন। তাকে ভারতীয় অনেক পুরষ্কার – পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষন সম্মান ও পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ তে পদ্মশ্রী,১৯৭৩ এ পদ্মভূষণ ১৯৯১ এ পদ্মবিভূষণ সম্মান পান ভারতসরকারের তরফ থেকে।
হূসেনের আঁকা ভারত মাতা  “Bharatmata” or “Mother India.
যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম– মকবুলের জীবনে এই অতীত গল্প অনেকে জানেননা, তার সাথে তার শুরুর দিকে ছবিগুলি কেমন ছিল তাও অনেকে জানেননা। আমরা হুসেনকে সাদা কালোয় দেখতে চেয়েছিলাম। তার শিল্পসৃষ্টিতে সমাজের প্রতিক্রিয়া বা প্রশংসা। তিনি যখন থেকে টাকা ও খবর মাধ্যমে – নিজের অস্তিত্ব -শাসকের মত দম্ভে দেখাতে চেয়েছিলেন, এই প্রবণতায় মেতে উঠেছিলেন- এই সময়টা নিয়ে কেউ তেমন কথা বলেননি। সমকালীন শিল্পী হিসাবে সত্তর দশকের- সম্ভবত এর পরে ফিদা হুসেনের ছবি নেই। সমকালীন ছবি বলতে আমি বলতে চেয়েছি- সমকালীন ভারতীয় জীবন যাত্রার ছবি, মকবুল ফিদা হুসেনের জীবন জড়িত ছবি, ভারতের নানা উত্থান পতনের ছবি তার ছবিতে নেই। তিনি এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের মনকে উপজীব্য করে বিতর্কিত থাকতে চেয়েছেন। অহেতুক ভাবনা দিয়ে নিজের স্বার্থ কিনতে চেয়েছেন। সৎশিল্পী হিসাবে তার ছবির ব্যাখ্যা না দিয়ে পালিয়ে থেকেছেন। মাঝখান থেকে কিছু কর্পোরেট ব্যবসায়ী টাকা বানিয়ে নিল।
তিনি ব্রিটিশ রাজের, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার টেরেজা, এবং ভারতের বিখ্যাত কিছু ব্যাক্তি নিয়ে ছবিখেলা খেলেছেন আর রামায়ন ও মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনীকে ছবি আঁকার অনন্ত উৎস বানিয়েছেন। এগুলিতে তার না ছিল শৈল্পিক আলাদা কোন ভাবনা বা কোন নতুনত্ব। তার যথারীতি ভঙ্গিমায় উৎপাদন বাড়িয়ে গেছেন। মাঝে মধ্যেই চমক কেটেছেন। কলকাতার শিল্পীদের সাথে তার তেমন কোন বিশ্বাস ছিলনা। দু একজন বাদে। কারণ দু একজনকে ঢাল বানিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। শিল্পী হিসাবে যে দায় বর্তায় অনুজদের প্রতি তাও ছিলনা মকবুলের। ২০০৮ সালে মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট যখন কাতারের দোহাতে হয় তখন তাকে বরাত দেওয়া হয় ৯৯ টা ছবির। কয়েকশত কোটী টাকা তিনি পেয়েছেন ২০১০ সালে কাতারের নাগরিকত্ব পান ও গ্রহন করেন। ২০০৬ সাল থেকে নানা কোর্ট কাছারির ভয়ে তার ছবির জন্য, লন্ডন ও দুবাইয়ে থাকতে শুরু করেন। ২০১১তে ৯ জুন লন্ডনে এই ভারতীয় পিকাশো বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে দেহ রাখেন।
 জীবনে অগুন্তি ছবি এঁকেছেন। টাকা রোজগার হয়েছে। পরীক্ষামূলক সিনেমা বানিয়েও খ্যাতি পান। কিন্তু পিকাশোর সাথে অনেক দিকে তফাত থাকলেও একটা দিক আমি উল্লেখ করব তা হল পিকাশো সারাজীবন ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে গেছেন মকবুল সীমিত ছিলেন। পঞ্চাশ দশক থেকে সত্তর দশকের শেষ অব্দি তার জীবনের যে কৃষ্টিময় কাজ রেখে গেছেন তাতে ছিল এক মহান শিল্পীর অনবদ্য অধ্যায়। আগামীতে সুযোগ পেলে উদ্যোক্তারা যদি সেগুলির কিছু প্রিন্ট আমাদের দেখান এই প্রজন্ম ও অনেক সমৃদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস। তার বিখ্যাত ছবির মধ্যে দ্য সিক্সথ সিল ও রাগামালা সিরিজগুলি উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলিউডের মাধুরী দীক্ষিতের প্রেমে পড়েন। মাধুরীর ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ছবিটি ৬৭ বার দেখেন। ‘আজা নাচলে’ দেখার জন্য পুরো প্রেক্ষাগৃহটি বুক করেছিলেন।। মাধুরীকে নিয়ে তিনি অনেক ছবি এঁকেছেন।
ফোর্বস্ ম্যাগাজিন শিল্পী মকবুল
হোসেনকে ভারতের পিকাশো বলে চিহ্নিত করেছিল। আমরা প্রতিবেশী দেশের শিল্পীদের খুব চিনিনা।পাকিস্তানেও একজন পাকিস্তানের পিকাশো আছেন। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, চীন, ভূটান ও পাকিস্তান। এশিয়া মহাদেশের সব কটি দেশের সাংস্কৃতিক দেওয়া নেওয়ার মধ্যে আমাদের অনেক বদ্ধ ধারণা ভেঙ্গে যেতে পারে ও আমরা সমৃদ্ধ হতে পারি। আমি ভাবছি, নির্বাচিত কিছু বিশিষ্ট শিল্পীদের আমার পোস্টে কিছুদিন দিতে থাকব। এটা করা দরকার। কারণ শিল্প নির্মান ও তার মোহন প্রভাব জেনে শুনেই আমরা শিল্পীদের সম্মান জানাব ও আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ ভাবনার মঞ্চে স্বাগত জানাব। পাকিস্থানেওনে ও একজন পিকাশো আছে। তার নাম সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি।  মুসলিম দেশ গুলি – যেমন পাকিস্তানে, তাদের ধর্মীয় কারণে মানুষের অবয়বের চেয়ে বিমূর্ত বা কোন নকশা/ আলিপনা জাতীয় শিল্প অধিক চর্চা হয়। তাদের মধ্যে নকশা করে লিখন পদ্ধতি যাকে আমরা বলি ক্যালিগ্রাফি- এই চর্চা অধিকাংশ মুসলিম শিল্পীরা করেন। ও ক্যালিগ্রাফিতে মুসলিম দের গুরুত্ব বেশি দেন। সাদেকোয়ান ও তেমন ক্যালিগ্রাফি ও পেইন্টার হিসাবে পাকিস্তানে সম্মানিত তারকা।
সাদেকের জন্ম ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩০ সালে  আমরোহা । সেখানে তার পড়াশুনা। তারা মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ের। তারপর দিল্লীতে চলে আসেন ও ক্যালিগ্রাফার হিসেব ১৯৪৪- মানে ১৪ বছর বয়সে আল ইন্ডিয়া রেডিও তে কাজ করেন। আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে আর্ট হিস্টরি নিয়ে গ্রাজুয়েট হন ১৯৪৮ সালে। ভারত বিভক্ত হওয়ার সময়  পাকিস্তানে চলে যান। সেখান থেকে চলে যান ইউরোপে ও আমেরিকায় ১৯৬৭তে পাকিস্তানে আবার ফেরেন। অনেক বড় বড় মূর‍্যাল পেইন্টিং করেন, বিশাল অঙ্কের বড় কবিতার বই প্রকাশ করেন। নিজেকে ফকির বলতেন। ১৯৮৭ সালে নিস্বঃ হয়ে মারা যান। একেবারে কপর্দকহীন।
(Above): Sadequain Mural Banaras Hindu University 40×12 feet rev2.
মকবুলের সাথে সাদেকোয়ান কে পাশাপাশি রেখে দেখি, সারাজীবন  হোসেনের মতন নকভী ছবি এঁকেছেন।সমান সম্মান অর্জন করেছেন। কত রকম আঙ্গিক ও কায়দায় উপস্থাপনায় তিনি ছবি এঁকেছেন। প্রদর্শনী করেছেন দেশে দেশে তার কাজের, মকবুল হোসেন এতরকম  ভাবে ছবি  নিয়ে আকার ভাঙ্গাগড়ার খেলায় মেতে উঠেননি যেটা পিকাশোও করেছিলেন শেষ বয়েস অব্দি। এখানে সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভির কিছু কাজের নমূনা দেওয়া হল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।