সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ৩৭)

‘ইজম ও শিল্প রচনার বিবর্তন’ আলোচনার উপসংহার

মগজ বা (Brain) প্রতিটি মানুষ সহ জীবজন্তুরই আছে বা থাকে। মানুষ তার চর্চা বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আরো চারপাশের মানুষের সাথে অভিজ্ঞতা অংশভাগ করে নিতে পারে। যারা বুদ্ধিমান, তারা বুদ্ধি চর্চার জন্য অন্যের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি জেনে নেয়, ফলে ভাবনা ও উদ্ভাবনীর সৃষ্টি হয়। এইভাবে সমাজ এগিয়ে যায়।
পশুপাখীর মধ্যে  অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু দেখা যায়, পশু-পাখী যে পরিবেশে বেড়ে উঠে সে সেই পরিবেশের মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।
শিম্পাঞ্জি কঙ্গোর শিল্প (painting)যখন ১৯৫০ সালে লন্ডনে প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল – আইসিএ (ICA)তে, – তখন দ্রুত দর্শক ও শিল্প প্রেমী লাভ করেছিল। তার প্রথম সংগ্রাহকদের মধ্যে মিরো এবং পিকাসো পাশাপাশি ডিউক অফ এডিনবার্গও ছিলেন।

১৯৬১ সালে আরেক শিম্পাঞ্জী মহাকাশে ভ্রমণ করে আসে। তার নাম হ্যাম।

উপরের বাঁ দিকে মহাকাশে যাবার আগে, ডানদিকে মহাকাশ থেকে ফেরার পর।

আমি বলতে চাইছি, উপযুক্ত চর্চা করলে আমাদের মগজ অনেক ভাবনা পায় ও নতুন কিছু ভাবনা  সৃষ্টিও করে। গ্রামে গঞ্জের শিল্প বিকাশ খুব কম হয় কেননা সেখানে চর্চা প্রায় নেই। শহরে পেশাদারী কিছু শিল্পী চর্চা ও আগ্রহের খাতিরে একই নকশা বা ফর্মূলার অনেক কাজ করেন। তারা মূলতঃ তাদের জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ ছাড়া নতুন কিছু করার মত মানসিকতা পাননা, ফলে তাদের কাছে নতুন জন্ম নেয়না।

আর্ট কলেজ থেকে ভিত্‌ স্বরূপ কিছু গৎবাঁধা ইতিহাস শিক্ষার পর জীবন ও সময়ের উপর ভাবনা না থাকলে উপলব্ধি আসেনা। উপলব্ধি এলে ও তা শিল্পে প্রকাশ করলে মৌলিকতার জন্ম নেয়।

উপলব্ধিই শিল্প আন্দোলনের বড় স্তম্ভ। নতুন একেকটা আন্দোলনই ইজম নামে চিহ্নিত হয়।প্রতিটা ইজমেই আছে দর্শন ও দক্ষতার মূদ্রণ। আর আছে সেই সময়ের কথা। ফলে শিল্পের দর্শকদেরও শর্ত থাকে, যথেষ্ট শিক্ষিত ও দীক্ষিত থাকার, না হলে শিল্প-রস আস্বাদ করা যাবেনা।

 আমাদের ভারতীয় ১৩৫কোটির দেশে, শিল্প-সংস্কৃতি বোঝার মতন মানুষ্কহুব কম নেই বললেই চলে। হাজার লোকের মধ্যেও ১জন আছে কিনা সন্দেহ। সেই তুলনায় ইউরোপ আমেরিকার লোকেদের সচেতনতা শিল্প সংস্কৃতি জনিত অনেক গুণ বেশি।  এই অক্ষমতা অধিকাংশই আমাদের দেশের মূর্খ রাস্ট্রনেতাদের জন্য। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনামোর জন্য। বাংলার একসময়, স্বাধীনতার আগে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যতটুকু ছিল, তা লুপ্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতার পর দেশীয় ভন্ড নেতাদের শোষণ ও শাসনে। তুলনায় মহারাস্ট্র, দিল্লী, ও দক্ষিণ ভারত অনেক উন্নত।

আমরা ক্লাসিক আর্ট (Meaning of Classical Art) বলার সময় বলি। দেখেছি অনেকেই ক্লাসিক আর্ট সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা রাখেননা।  তারা বলেন চিরন্তন। কিন্তু ক্লাসিক আর্ট চিরন্তন বলে থেমে যায়না। ফলতঃ এটা বোঝা যায়, বাংগালিরা পড়াশুনার ধার ধারেনা। এটা অতি দুঃখের বিষয়।

ক্লাসিক আর্ট মানে একটা বিশেষ সংজ্ঞায় ধৃত একধরণের ছবি বা ভাস্কর্য। বাংলা বলে ধ্রুপদী শিল্প। বাংলা অর্থ যথাযথ পাওয়া যাবেনা, কারণ আমাদের সমস্ত সংস্কৃতিই প্রায় বিদেশীদের হাত ধরে আসা। ছোট ছোট মিনিয়েচার মুঘল আমলের, আমাদের নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার আগে, মুসলিমরা শিল্প সংস্কৃতি এনেছিল, মুসলিমদের পর আমরা ইউরোপের শিল্প ঋণ করে চলছি। ফলে ক্লাসিক কথার অর্থ ইউরোপীয় ধারণায় বুঝতে হবে। ইউরোপের ক্লাসিক সময় ধরা হয়, সতেরো শতাব্দীর গ্রীক ও রোমানদের শিল্প সংস্কৃতি মূলতঃ  এবং এর শুরু ধরা হয় খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগ সময় থেকে।কারণ সেই সময় থেকেই গ্রীকদের ছবি ভাস্কর্য সম্পূর্ণ শুদ্ধতায় রূপ নিয়েছিল।

উপরের ছবিগুলি সব রোমানদের কপি করা, আসল কাজগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। বাঁদিকের ছবিটি রোমানদের ব্রোঞ্জ কপি ২য় শতাব্দীতে বানানো। ডিসকাস ছোড়ার মুহুর্ত।

মধ্য পঞ্চম শতাব্দীর একজন এথেনিয়ান ভাস্কর(Athenian sculptor) এলিয়ুথেরি র মাইরন, (Myron of Eleutherae) প্রাচীন গ্রীকের,  কর্মরত ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০-৪৪০ খ্রিস্টপূর্ব । অসম্ভব নিপুন কাজ তার।
ধ্রুপদী অর্থ মূল শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা – লাতিন শব্দ “আরস” (যার অর্থ “দক্ষতা” বা “নৈপুণ্য””ars” (meaning “skill” or “craft”)) থেকে উদ্ভূত – একটি  শুরুর ধারণার ভিত্তি। এটা বিস্তৃত হয়ে শিল্পে সংজ্ঞায়িত হয়েছে: প্রায়শই দক্ষতার উপর নির্ভর  করে ব্যবহার হয়েছে কিছু জ্ঞান বা বুদ্ধির ভর।” সুতরাং রেনেসাঁ চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করদের কেবলমাত্র দক্ষ কারিগর হিসাবে বিবেচনা করা হত (ইন্টেরিওর ডেকোরেটর?)। এতে কোনও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলো শিল্পীদের মর্যাদা ওই স্তরে উঠেছিল যেখানে বুদ্ধি ও দক্ষতা একসাথে প্রদর্শিত হয়েছিল।
গ্রীক এবং রোমের প্রাচীন সভ্যতার শিল্পকলা ও সংস্কৃতি উদাহরণ হিসাবে  পুনরায় সপ্তদশ শতাব্দীতে দেখা দেয়। এবং তা চিহ্নিত হবার জন্য ক্লাসিক বা শাস্ত্রীয় শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবি ভাস্কর্য, স্থাপত্যে এবং সাহিত্যে এই প্রাচীন সভ্যতার নীতির গুলি ক্লাসিকিজম হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
ধ্রুপদীতা সাধারণত  সূচিত করেঃ সম্প্রীতি এবং সংযম, এবং রূপ যা শিল্পের স্বীকৃত মানের মধ্যে সীমিত। নবজাগরণের (Renaissance) পর থেকে, প্রাচীন গ্রীক ও রোমান দেবতা ও বীরদের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ও ক্লাসিক্যাল পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে ক্লাসিক্যালিজম পশ্চিমা শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েছিল – ইতিহাসের চিত্রকলার বিষয়বস্তুর প্রধান উৎস হয়ে ওঠে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে, পশ্চিমে ঐতিহ্য অনুসারে  প্রাচীনত্ব, স্বাদের মান নির্ধারণ হিসাবে (যা ক্লাসিক শিল্পীরা) অনুকরণ করত। যার শুদ্ধতম রূপ, প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের সংস্কৃতি, নীতিগুলির উপর নির্ভরশীল, শিল্প ও সাহিত্যের  একটি নান্দনিক সৃষ্টি যা রূপ, সরলতা, অনুপাত, কাঠামোর স্পষ্টতা, নিখুঁততা, সংযত আবেগের পাশাপাশি স্পষ্টরূপে জোর দিয়ে  বুদ্ধি আবেদন থাকে। এই হল ক্লাসিক ছবি বা ভাস্কর্য। মানে পৌরাণিক । ক্লাসিকের পর আমরা চারশ বছর পেরিয়ে এসেছি। এর মধ্যে শিল্প আন্দোলনগুলি অনেক অনেক বিকাশ হয়েছে। আজ ক্লাসিক প্যাটার্ণে ছবি আঁকলে  কেউ কিনবেনা, সংগ্রহ করবেনা। ফলে প্রয়োজন মরে গেছে। নীচে কিছু ক্লাসিক পেইন্টিং এর নমূনা দিলাম।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।