শূন্য থেকে মানুষ আসেনি। লক্ষ লক্ষ বছরের মানুষের বংশধর হয়ে আপনি আমি এসেছি। সুতরাং আপনি কখনো বলতে পারবেননা আপনি মৌলিক, আপনার মত আর কেউ নেই, ছিলনা বা থাকবেনা।
ঠিক তেমন,এই পৃথিবীতে, হাজার হাজার বছর ধরে, নানা কোনে কোনে, বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাবে গড়ে উঠা মানুষ, এত কাজ ও ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছে , আপনি সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের বাইরের মানুষ নন। আপনি যেই কাজই করুননা কেন, আপনার সাথে পৃথিবীর কারুর, এক বা অধিকের কাজের সাদৃশ্য দেখবেন। আপনি যদি মূর্খ হন বা অজ্ঞ হন তাহলে আপনি বলতে পারবেন যে, আমিই সৃষ্টি করেছি প্রথম।কিন্তু আসলে আপনি কিছুই সৃষ্টি করেননি।সবই ছিল। আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দেখি, শিল্প আন্দোলনের যে চঞ্চলতা ইউরোপের শিল্পীরা এনেছিল, তা আসলে যীশুখ্রীষ্টের জন্মেরও আগে করা হয়ে গেছিল। যেমন কিউবিজম, বা নানা প্যাটার্ণের কথা যা শিল্প সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছিল তা কোনটাই নতুন নয়। আমরা ভিত্তিমূলক জিনিসগুলি পাল্টাতে পারিনা। শুধু তার রুপ বা ব্যবহার বা ভাবনা পালটাই। তাতেই আমাদের অহংকার বা গর্ব।
আমরা ছোটবেলা থেকেই নানা জিনিস দেখে বড় হই, অনুশীলন করি, প্রভাবিত হই। আমাদের মধ্যে একটা মূল্যবোধ তৈরি হয়। সেই মূল্যবোধ বিভিন্ন ভৌগোলিক জলবায়ুতে ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় তৈরি বস্তুতে আমরা বিস্তর ফারাক দেখি। উত্তর মেরুর সাথে দক্ষিন মেরুর মানুষের সভ্যতা ও আচরণে, কর্মে, জীবন যাপনে। মানুষ সাংস্কৃতিক কাজ কর্মেও এক জায়গার লোক অন্য জায়গায় গাছের বীজের মত, ভাবনা, কাজ কর্মে প্রনালী,ও নানা ভালো লাগা বস্তু আমদানী ও রপ্তানী করে। ফলে মানুষের কাজ কর্ম কোন একটা বস্তুর অস্তিত্ব থেকে আরেকটা বস্তুর গড়ে উঠার ভাবনা জারিত হয় ও গড়ে উঠে। শূন্য থেকে কিছু হয়না।আগে ছিল একটা বস্তু , মানুষ তার ব্যবহার করতে গিয়ে উন্নত রূপ দেয়। আর বলে আমি করেছি। এই অহংকার মানুষ করুক,কিন্তু এই দাবী না করুক এটা আমারই শূন্য থেকে গড়া। এর মালিক আমি। এই দাবী করলে, সে এক নিতান্ত মূর্খ, বা ধান্ধাবাজ। তার মধ্যে অসামাজিক গ্রাস করার আকাঙ্খা ফুটে উঠে। অন্যকে শোষণ করার প্রবণতা থাকে।
সাংস্কৃতিক জগতে নকল বা অনুসরণ নিয়ে আলোচনা একটা বিতর্ক টানে। কিন্তু দেখা যায়, বিতর্কটুকু একদম ফালতু। সময়ের অপচয়, মানুষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি। একদম অবিকল রেপ্লিকা, বা অনুরূপ কিছু করলে অবশ্যই সভ্য সমাজ আইনগত শাস্তি দেয়। কিন্তু এটা কেউ করেনা। মানুষ কোন জিনিস দেখে একটা ভাবনা তৈরি করে, সেই ভাবনাতে কোন কাজ আরো উন্নত বা অনুন্নত উৎপাদন করে, ফলে নতুন উদ্ভুত সৃষ্টিটি আগের কাজটির সাথে নিশ্চিত একটা অংশের পরিমানগতভাবে মিলে যেতে পারে। এই মিলটুকু সভ্য সমাজ যদি না ছাড়ে তাহলে পৃথিবী থেমে যাবে।বন্ধ্যা রূপ নেবে।আর সভ্য সমাজ এটা মানে বলেই আমরা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এত বাড়ন্ত দেখি।
পুরাণো বোতল থেকে মদ আপনি নতুন বোতলে ঢালছেন, নতুন কথা আর নতুন কিছু মিশিয়ে, তাকে মৌলিক বলা যায়?
পৃথিবীর সকল বিখ্যাত ও আদর্শস্থানীয় মানুষেরা সবাই তার প্রিয়জনের, প্রিয়বস্তুর প্রভাবে, সরাসরি, বা আংশিক ঋণ নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।আপনাকে কেউ লজ্জা দিলে আগে আমাদের সেই বরেণ্য মানুষদের লজ্জা দিতে হয়। আমরা তো তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম।সুতরাং যিনি এসব নিয়ে আওয়াজ তোলেন, অনুকরণ, সাদৃশ্য খোঁজে ফেরেন অন্যের কাজে, আসলে তিনি তার নিজের হতাশার জায়গাটা আপনাকে বলে লাঘব করছেন। তাকে করুণা করে অবজ্ঞা করে চলুন।
আমার কাজ বা ছবির সাথে, ইউরোপ, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকোর। অনেক শিল্পীর মিল আছে। কিন্তু এশিয়ার কারুর সাথে মিল নেই। কারণ আমাদের একটাই উৎস। আফ্রিকার জংলী মানুষের আদিম শিল্প। আমাদের মুম্বাইয়ের এক বাংলা শিল্পী, আমি নিশ্চিত, তিনি পড়াশুনার ধার ধারেননা, তিনি এক পটুয়া, একই ছবি অনেক সংস্করণ করে ছবি বিক্রী করে সুনাম করেছেন, তিনি একবার তাইপেয়ী, তাইওয়ানে, গাঁটের টাকা খরচ করে গেছিলেন প্রদর্শনী করতে, সেখানে এক ইউরোপীয় সাহেবের ছবি দেখেন, যার কাজের নমূনা আমার কাজের সাথে হুবহু মিল আছে। রেপ্লিকা নয় , তিনি বাংলার কিছু সেই গোত্রের শিল্পীদের কাছে প্রচার করেন। ফলে কিছু শিল্পী আমার কাজকে নকল বলে আমার ব্যবসায়িক ক্ষতি করে দিল কিছুদিন। আমি আমার ফর্ম আজও পাল্টাই নি। কিন্তু আমার ছবি ইউরোপে বিক্রী হচ্ছে।
বাংলার শিল্পী! জানেনতো, কাঁকড়ার জাত যেন, পা টেনে নামিয়ে দেবে। আপনি যতই ভাল কাজ করুন। কিন্তু কাউকে ঠেলে উপরে তুলতে শেখেনি, কোনদিন তুলেছে বলেও শুনিনি। তোলার ক্ষমতাও নেই।
এসব করে হতাশাগ্রস্ত লোকেদের কিছু মানসিক নিরাময় হয় বটে কিন্তু আপামর একটা জাতির নৌকা তলিয়ে দেয়। আমি গত চার বছর চুপ শুনে গেছি। কিন্তু এবার মনে হয়েছে। বাংলার এই হিংসা ভরা, শিল্পীদের মুখোশ খুলে দেওয়া দরকার। কারণ তারা কোনদিন ডুবন্ত নৌকা উদ্ধার জানেনা। জানে শুধু একটা ফুটো করিয়ে আস্ত যাত্রীবাহী একটা নৌকাকে অতলে তলিয়ে দিতে। এই সব শিল্পীদের চিহ্নিত করুন। লজ্জা দিন ওদের। ওরা কোনদিন ইউরোপিয়ান সাহেবরা কোত্থেকে উৎসপায়, নকল করে, তা নিয়ে কোন তথ্য খুঁজতে যায়না। না পড়াশুনা করে,না নিজেকে শিক্ষিত করে। না এসব নিয়ে আলোচনা করে?
মারসেল ডুচ্যাম্প (Marcel Duchamp ১৮৮৭- ১৯৬৮)। তিনি ১৯১৭ সালে পর্সেলিনের তৈরি একটি প্রস্রাবের পাত্র। বাজার থেকে কিনে এনে তার গ্রুপেরই একটা বার্ষিক প্রদর্শনীতে ‘ফাউন্টেন’ বা ‘ঝরণা’ নাম দিয়ে জমা দেন প্রদর্শনীর ভাস্কর্য হিসাবে, তার বন্ধুরা, দেখল, এত বাজার থেকে কেনা মাল, সে নিজে বানায়নি। খোলা মার্কেটে সহজ লভ্য, আর প্রত্যেকের বাড়িতেই এটা আছে। এটা শিল্প বস্তু হতে পারেনা। সেই প্রস্রাবের পাত্রটি বাদ দিয়ে দেওয়া হল।মারসেল ডুচ্যাম্পের ভাষ্যঃ ‘ এটা আমি প্রস্রাবখানার পাত্র নাম দিইনি, আমি এটাকে ঝরণা হিসাবে দেখেই দিয়েছি। এখানে আমার ভাবনা আমূল নতুন।আমার ভাবনাটাই শিল্প।’
বস্তু নয়। ভাবনা।কোথাও ভাবনা নয় বস্তু।পার্থক্য থাকেই। আপনি একটা বস্তুতে সাদৃশ্য দেখলেন , ভাবনাতে নয়। আপনার জ্ঞানের প্রসারতা নেই? আমি যা করি তার পিছনে পড়াশুনা আমাকে এত শক্তি দিয়েছে। মুক্তি দিয়েছে। আমার ছবিতে আকাট লোক যদি থাকে তাহলে বলবে নকল।আর আমি নকল হলে আমার মতো হাজার হাজার নকল ইউরোপীয় লোকেরাও নকল। এবং এটা গর্বের কথা।
আজ যদি মারসেল ডুচ্যাম্প এই বাংলাতে জন্মাত। আমি নিশ্চিত, তাহলে মারসেল ডুচ্যাম্প কে নিয়ে পৃথিবী ব্যাপী গবেষনা হতনা। মারসেলের সুইসাইড করতে হত এই বাংলার কিছু পটুয়ার জন্য। বাংলার জলবায়ূ ভাল নয়। লোকের মানসিকতা নরকের দিকে। তাদের চোখে সুন্দর কিছু নেই। সবই কুৎসিত দেখে।ছিঃ। কখনো মনে হয়, এখানে আমি জন্মেছি! ঘৃণা লাগে, আমার দেশের মানুষের কুৎসিত রুপ দেখে।মারসেল ঐ বাজারের কাজটির ব্যবহারিক নতুন ভাবনার জন্য আজ পৃথিবী বিখ্যাত। আমেরিকার বড় শিল্পী।
বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাশো। তাকে আমরা চিনি বিখ্যাত বলে, কিন্তু তিনিও আমার মতো দোষে দুষ্ট। আফ্রিকার আদিম শিল্পকলা থেকে তার বুনিয়াদ গড়া। তিনি যদি বাংলায় জন্মাতেন তার আর বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন কোন নরকের অতলে তলিয়ে যেত। ভাবুন!
এইসব শিল্প, কিউবিজমের উদাহরণ। এগুলি খ্রীষ্টজন্মের বহু আগে অশিক্ষিত মানুষেরা সৃষ্টি করে গেছেন
অনুকরণ বা অনুসরণ যদি না থাকত, তাহলে সমাজে প্রগতি আসতনা। মানুষ সভ্য হতনা।
রবি ঠাকুরের আঁকার সুনাম করেন আজকাল অনেকেই, তিনি জানতেন এই বাংলার জলবায়ু কেমন বিষাক্ত। তিনি প্রদর্শনী করেছেন বিদেশে।বাংলায় নয়। কেন?
তিনি জানতেন বাংলার মানুষের মানসিকতা। তিনি ভুক্তভোগী ছিলেন।