সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন অ্যালবার্ট অশোক (পর্ব – ৪৩)
দৃশ্যচিত্রঃ স্বপ্ন বা ভয়ের দেশ
দৃশ্যনন্দন আজ কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি দেখাব, বাংলার ফাইন আর্টসের চর্চাকারীদের। ছবি ভাস্কর্যের আন্দোলনগুলি, সার্থক শিল্পীদের প্রতিষ্ঠাগুলি একএকটা সার্থক আন্দোলন। এই আন্দোলন ছবির মাধ্যমে শিল্পের মাধ্যমে নান্দনিকতা ও উন্নত ভাবনায় পৌছানোর সিঁড়ি। এক একটি তাত্ত্বিক দিক মানুষের মেধার সৃষ্টি। এবং সমাজ রাস্ট্রকে নতুন পথ দেখায়। সুতরাং চর্চা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা শকটের চক্রের মত সময় সরণী ধরে পাশাপাশি এগিয়ে চলুক। এই চলার সাথে মাইলস্টোন পুঁতে পিছনের দিকে তাকিয়ে যা করা হয়েছিল, সার্থক অতীতের শিল্পীদের কাজ, আরেকবার দেখা দরকার। এগিয়ে যাওয়া আর অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া একমাত্র কৌশল সার্থকতা আবিষ্কারের।
একজন মেধা-শক্তিশালী শিল্পীর ছোঁয়া পেলে একটা সাধারণ বস্তু অসাধারণ হয়ে উঠে। এখানে রবি ঠাকুর সহ প্রকাশ কর্মকারের ২০০২ সালে করা একটি সাধারণ দৃশ্যচিত্রের ভাবনা আরেকজন কানাডিয়ান শিল্পী লরেন স্টুয়ার্ট হ্যারিস এর ১৯১৯ সালের দৃশ্য চিত্রের নমূনা রাখলাম।
তিনজনেই মজা করে একটা দৃশ্যচিত্রের গল্প বর্ণনা করেছেন। প্রকাশ কর্মকারের ছবিতে আপনি আগে যেখানে চোখ পড়ছে, সেখানে দেখুন নির্জন দিগন্ত জুড়ে যেন কিছু দানব আপনাকে নজর রাখছে। তেপান্তরের বুক বেয়ে যখন আপনি একলা অতিক্রম করেন, বুকটা কেমন ঢিবঢিব্ করে। ভয় মেশানো রোমাঞ্চ শিরশির্ করে বয়ে যায় মেরুদন্ড বেয়ে।
১৯৩০ এর দশকে। আমাদের রবি ঠাকুর এই মজাটা করেছেন। দেখুন এই দৃশ্যে, দুজন মানুষ যেন কিছু বলাবলি করছে। আর ১৯১৯ সালে শিল্পী লরেন হ্রদের পাশ দিয়ে কিছু মানুষ যেন সাড়ি বেধে এগিয়ে যাচ্ছেন।
ছবিগুলি মূলতঃ দৃশ্য চিত্র। তারা সবাই দৃশ্যচিত্রই আঁকলেন । এর মধ্যেই কিছু অতিরিক্ত অনুভূতি, আনন্দ মজা উপভোগ দিলেন সাধারন দর্শকদের। এছাড়া কৌশলগত আরো কিছু লেকচারের বাকী আছে। সেগুলি কখনো সুযোগ পেলে বলব।

প্রকাশ কর্মকারের

রবি ঠাকুর

Lawren Stewart Harris
কানাডার শিল্পী Lawren Stewart Harris, জন্ম 23 October 1885, Brantford, Canada মৃত্যু Died: 29 January 1970, Vancouver, Canada তিনি কানাডার সরকার (বা রাজতন্ত্রের শীর্ষক্ষমতার অধিকারিনী রাণীর ) এর শ্রেষ্ঠ সম্মান Companion of the Order of Canada. পান। এই সম্মানটি কানাডার নাগরিক জীবনে যারা সারাজীবন উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাদের দেওয়া হয়।
অ্যাবস্ট্রাক্ট abstract আর্ট। আমি অনেককেই দেখেছি, মানেটা বুঝেননা। অথচ, অভিধানগুলিতে পরিষ্কার লেখা আছে মানে। মানুষ এত নির্জীব হয়ে পড়ছে তাদের খাইয়ে না দিলে, তারা খেতে পারেনা। তো এরকম গুরু রাশির নাগরিকদের নিয়ে একটা জাতি অবলুপ্তির পথে।
abstract মানে সম্পূর্ণ চেহারাটা বা ছবিটা দেখতে পারছেননা। কেউ গল্প বললে আপনার একটা ধারণা হয়। এই ধারণা কিন্তু পরিষ্কার নয়। ঝাপসা। কিন্তু আপনি আইডিয়া করে এগুতে পারছেন। abstract আর্ট হল আলোকচিত্রের মত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেননা।
কিছু জিনিসের প্রতিমা হয়না। আপনাকে দূর্গা কালী, গাছ, বাড়ি মানুষ বললে আপনি পরিষ্কার ছবি চোখে ভাসাতে পারেন। যদি বলি স্নেহ, মমতা, ফুলের মাদকতা, যুদ্ধের ভয়াবহতা, – আপনি অন্যভাবে আপনার অভিজ্ঞতা দিয়ে দৃশ্যটা আঁকবেন। ফাইন আর্ট দুভাগে সাধারনতঃ ফিগারেটিভ বা নন ফিগারেটিভ বা abstract । কে কিভাবে এই অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট অভিব্যক্ত করে ও দর্শক গ্রহন করে তা সেই সময়ে বোঝা যায়।
আমি এখানে Lawren Stewart Harris কে আমাদের শিল্পীদের কাছে উদাহরণ হিসাবে রাখছি। যে এই কানাডিয়ান শিল্পী যে নান্দনিকতা গড়ে তুলেছেন তার বিমূর্ত ধারার ছবিতে তা প্রশংসনীয়। সরাসরি একটা প্রাকৃতিক অঞ্চলে গিয়ে একটা আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ নিলে হয়ে যায়। একজন শিল্পীকে ফটোগ্রাফের মত আঁকলে তার খরচ অনেক পড়ে। লোকে ফটোগ্রাফ অল্প পয়সায় কিনবে। শিল্পী আলোকচিত্রের সাথে অস্তিত্ব লড়াইয়ে এল। সে এমন করে ওই অঞ্চলের ছবিটা তার মত করে- ডিজাইন করে, প্যাটার্ণ করে, রং দিয়ে বানালেন যে মানুষ চোখের প্রলোভন সামলাতে না পেরে আলোকচিত্র ছেড়ে অনেক টাকা দিয়ে শিল্পীর কাজটি সংগ্রহ করেন। এখানেই শিল্পের জয়যাত্রা।
সত্যকে নিজের চোখে স্ক্যান করে নাও, তারপর সত্যকে নিজের মর্জি মতো বানিয়ে দর্শককে পরিবেশন করো। দর্শক বাস্তব দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তাকে আনন্দ দাও, মজা দাও, সত্যকে দাও। ল্যান্ডস্কেপের ছবি ওই জলরংযে ব্রিটিশদের শেখানো জিনিস – এখন ১০০ বছর পর আর্ট হিসাবে ধরতে কষ্ট হয়। আপনারা অনেকে দেখেছেন প্রবাদ প্রতিম শিল্পী প্রকাশ কর্মকার তার ল্যান্ডস্কেপের ক্যানভাস নিয়ে ২০০২ সালে গ্যালারী ৮৮ এ প্রদর্শণী করেছিলেন। জাদুকরের জাদুদন্ডও হার মেনে যাবে, ওই ছবির সামনে দাড়ালে। রবি ঠাকুর প্রথাগত ছবি আঁকা শেখেননি, কিন্তু তার মেধায় একটি ল্যান্ডস্কেপের ছবিকে অসাধারণ দ্ব্যর্থক বা চোখের ভ্রম সৃষ্টি করেছিলেন।
ফাইন আর্ট এর ছাত্র ছাত্রীরা কলেজে পেইন্টিং অভ্যাস ছাড়া বিভিন্ন ছবির বিশ্লেষণ বা মাহাত্ম্যর কোন বক্তৃতা পাননা। তারা সিলেবাস টুকু দায়সারা গোছের তেতো বড়ি হিসাবে খায়। যদি সত্যিই আর্ট কলেজগুলিতে কিছু শেখাত আপনার কি মনে হয় বাংলার শিল্পের আকাল আসে? বৃক্ষাণি ফলেন পরিচিয়তে। গাছে ফল না ধরলে সেটা গাছের মতন দেখতে । গাছ নয়। আমিও ভাবছি, কলেজে যোগ্য স্যার নেই। সার্টিফিকেট অর্জন করা কিছু পুতুল সাজানো।
Lawren Stewart Harris একটা নতুন দিশা দিয়েছিলেন। তিনি উত্তর আমেরিকার উত্তরের দ্বীপ সমুদ্র নিসর্গ চিত্রকে তার খুশী মনের মজার চিত্র দিয়ে দর্শকের মন রঞ্জিত করেছিলেন। বলা বাহুল্য তার ছবি অনেক মূল্যে নানা মিউজিয়ামে সংগৃহিত।