• Uncategorized
  • 0

স্ট্যালিন বিরোধী অপপ্রচার: সাম্রাজ্যবাদী শোষকের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা

লিখেছেন – তন্ময় সরকার

মৃদুল শ্রীমানী-র লেখা “সের্গেই কিরভ,রাজনৈতিক খুন, আর খুনের রাজনীতি” (২/১২/১৯) লেখাটির একটি প্রতিবাদ পত্র এসেছে আমাদের দপ্তরে, লিখেছেন তন্ময় সরকার।লেখাটিতে তিনি যে শিরোনাম দিয়েছেন,তাই রাখা হলো। পাঠক আপনাদের জন্য রইল এই লেখাটিও । পড়ে দেখুন। এই বিতর্কে আপনি আপনার মতামতও জানাতে পারেন।
বিনীত
মুখ্য সম্পাদক
গত ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে TechTouch টক-এ শ্রী মৃদুল শ্রীমানীর “সের্গেই কিরভ, রাজনৈতিক খুন, আর খুনের রাজনীতি” শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বের বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে তাঁর এই প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে শ্রী শ্রীমানী যে অংশে স্ট্যালিন, কিরভ ও ট্রটস্কির উল্লেখ করেছেন—সেই অংশটুকুই আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
প্রথমেই বলতে চাই, লেখকের উক্ত অংশের বক্তব্যকে আমি সর্বতোভাবে বিরোধিতা করছি এবং নির্দ্বিধায় ঘোষণা করতে চাই যে শ্রী মৃদুল শ্রীমানী যা লিখেছেন তা ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি লিখেছেন, “তিনি (ট্রটস্কি) স্তালিনের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে কথা বলায় স্তালিনের কোপে পড়েন, ও পার্টির পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিস্কৃত হন। নির্বাসিত হয়েও ট্রটস্কি স্তালিনের অমানবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।”
আসুন আমরা বিচার করে দেখি এই তথ্য কতখানি ইতিহাস নির্ভর। প্রথমেই বলে নিতে চাই, রাশিয়ার বিপ্লবের পূর্বে ট্রটস্কি ছিলেন লেনিনের বলশেভিক দল ও মতবাদের বিরোধী এবং মেনশেভিক নেতা। বিপ্লবের প্রাক্কালে তিনি বলশেভিক দলে যোগ দেন। কিন্তু তখন থেকে লেনিনের মৃত্যু পর্যন্ত লেনিনের নীতি ও কাজের সক্রিয় বিরোধিতা ও বাধা সৃষ্টি করেছেন। এবং লেনিনের মৃত্যুর পর নিজেকে পার্টির সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে দাবি করেন।
১৯৪৭ সালে গান্ধীবাদী (মার্কসবাদী নন) সাহিত্যিক শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চক্র ও চক্রান্ত’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। কিছু বছর আগে ‘প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস’ বইটির হুবহু পুনর্মুদ্রণ (replica) প্রকাশ করেছে। এই বইতে শ্রী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন:
“লেনিনের মৃত্যুর পর, মে মাসে (১৯২৪) পার্টি কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসলো। এই অধিবেশনে ট্রটস্কী খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করলেন, পার্টির উচিৎ তাঁকেই লেনিনের উত্তরাধিকারীরূপে গ্রহণ করা। ষ্টালিনও তাঁর দাবী উপস্থিত করলেন। ট্রটস্কী বললেন, তাহলে ভোট নেওয়া হোক্।…
“সেই পার্টি কংগ্রেসে ৭৪৮ জন ডেলিগেট ভোট দেবার জন্যে সমবেত হয়েছিলেন এবং ট্রটস্কী তাঁর জীবনের চরমতম বিস্ময়ে দেখলেন, সেই ৭৪৮ জন ভোটারই একবাক্যে ষ্টালিনকে ভোট দিল। এমনকী তাঁর গোপন চক্রান্তের যে তিন জন প্রধান ব্যক্তি— বুখারিন, জিনোভিভ্ এবং ক্যামেনভ— তাঁরাও জনমতকে উপেক্ষা করতে শেষ মুহূর্তে পারলেন না।
“ট্রটস্কী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের তিনজনকে বিশ্বাসঘাতক বলে তিরস্কার করলেন।” (চক্র ও চক্রান্ত, শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, পৃষ্ঠা- ৩৩)
তাহলে আমরা দেখলাম পার্টিতে ট্রটস্কির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হল না এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তা হল না। কিন্তু ট্রটস্কি চুপ করে রইলেন না। তিনি পার্টি ও স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে গোপন চক্রান্ত শুরু করলেন। পার্টির সমাজতান্ত্রিক নীতি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুললেন। ১৯২৭ সালের যে অধিবেশনে ট্রটস্কিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয় তার বিবরণ আমি দেব না। আমরা তা জেনে নেব বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ শ্রদ্ধেয় এম.এন. রায়ের বর্ণনা থেকে। তিনি নিজে সেই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন, এবং মতামত ও ভোট প্রদান করেছিলেন। উল্লেখ্য শ্রী রায় লেনিন, স্ট্যালিন ও ট্রটস্কির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার ও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন:
“… আমরা যাকে ভুল করে ট্রটস্কি-স্ট্যালিন বিরোধ বলি, সে সংঘর্ষের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে তাঁদের দুজনের কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ ঘটে নি। যে শেষ সংঘর্ষের ফলে ট্রটস্কি পার্টি থেকে বিতাড়িত হন, পার্টির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বিরোধিতার ইতিহাসের সেটি একটা অংশ।…
“… সেদিনকার অধিবেশন সারারাত্রি ধরে চলেছিল।… ট্রটস্কির মতামত যে সম্পূর্ণ ভুল, সে বিষয়ে আমার আর কোন সন্দেহ ছিল না।… তিনি যে একা, একেবারেই নিঃসঙ্গ, এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল।… আমিই ছিলাম শেষ বক্তা এবং আমার বক্তৃতার পরই ভোট গ্রহণ করা হয়।…
“কেবলমাত্র একটা দেশে সমাজতন্ত্র সফল হয় কিনা, এই ছিল অধিবেশনের বিচার্য বিষয়। ট্রটস্কির মত ছিল যে, তা হয় না, হতে পারে না।… আমার বক্তৃতায় আমি ট্রটস্কিকে একটিমাত্র প্রশ্ন করলাম। যদি মেনে নেওয়া যায় যে, পুঁজিতন্ত্রে পরিবেষ্টিত রাশিয়াতে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয়, তবে আমাদের সম্মুখে মাত্র দুটো পন্থা আছে। যতদিন অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না হয়, ততদিন রুশ দেশে আমাদের চরম লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা সম্ভব, তাই করে যেতে পারি। না হয় আমরা সোভিয়েট ইউনিয়নে যে ক্ষমতা স্থাপন করেছি, তা ছেড়ে যেদিন দুনিয়াব্যাপী বিপ্লব আরম্ভ হবে সেদিনের অপেক্ষায় বসে থাকতে পারি।… আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রটস্কি কি শেষোক্ত পথ বেছে নেবার পক্ষে? ট্রটস্কি গর্জন করে উঠলেন—কখন না। আমি বললাম যে তাহলে পার্টি থেকে তাঁর বিতাড়নের পক্ষেই আমি ভোট দেব।… সেদিনকার ঐতিহাসিক অধিবেশনে ট্রটস্কি পরাজিত হলেন—পার্টি সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে দলচ্যুত করল।… যদি ট্রটস্কির মত গ্রহণ করে স্ট্যালিনকে পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ফেলা হত, তবে আজ হয়তো সোভিয়েট ইউনিয়নের অস্তিত্বই থাকত না।” (চতুরঙ্গ, আশ্বিন ১৩৪৭, সংখ্যা ১, সৌজন্যে: প্রসঙ্গ স্ট্যালিন, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস)
এই হল ইতিহাস। এবার পাঠক বিচার করে দেখুন মৃদুলবাবু বর্ণিত ‘স্তালিনের কোপে’ পড়ে ট্রটস্কি পার্টি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, নাকি তার সংগত কারণ ছিল।
তিনি আরও লিখেছেন, “পরে লোক নিয়োগ করে স্তালিন এই বিশিষ্ট মার্কসবাদী নেতৃত্বকে খুন করান।” এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে আমরা কিছু পরে আলোচনা করব। তার আগে কিরভের হত্যা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।
শ্রী মৃদুল শ্রীমানী লিখেছেন, “লেনিনগ্রাদের পার্টি অফিসে আজকের দিনে তাঁকে (কিরভকে) গুলি করে খুন করেন এক বিশিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ নিকোলায়েভ। অবশ্য লিওনিদকে সের্গেই হত্যায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন সর্বোচ্চ সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন নিজেই।”
বলতে বাধ্য হচ্ছি ইতিহাসের এহেন বিকৃতি সত্যিই খুব দুঃখের।
প্রথমেই জেনে নেব সের্গেই কিরভের সাথে স্ট্যালিনের সম্পর্ক কেমন ছিল।
স্ট্যালিনের সবচেয়ে বেশি দিনের দেহরক্ষী আলেক্সেই রীবিন স্ট্যালিনের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে তাঁর স্মৃতিচারণা করেন। সেখানে তিনি লিখেছেন:
“প্রতিবছর কিরোভ স্ট্যালিনের কাছে আসতেন, দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব যেন এই সময় আরো গভীর হত। পাহাড়ের কোলে, গাছের ছায়ায় টেবিল চেয়ারে বসে দুজনে গল্প করতেন।…
“সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসের সময় কিরোভ পুরো সময়টাই আমাদের সাথে কাটিয়েছিলেন। কিরোভ স্ট্যালিনের খাটে শুতেন আর স্ট্যালিন আনন্দের সাথেই শুতেন ডিভানে। এমনকি তারা দুজনে একসাথে বাথরুমে গরম ভাপ নিতেন। এই সৌভাগ্য, স্ট্যালিনের এতটা কাছে যাওয়া, পলিটব্যুরোর অন্য কোন সদস্যেরই হয়নি। স্ট্যালিন কিরোভের জন্য গর্ব অনুভব করতেন। কারণ যেখানে বুখারিন, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ পার্টির শত্রুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিল সেখানে পার্টি কংগ্রেসে পার্টির মতাদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন কিরোভ। স্ট্যালিনের মতে কিরোভের হাতে পার্টি ছিল সুরক্ষিত।…
“একবার শরৎকালে কিরোভ কাজখাস্তানে গেলেন। দিনটা ২৮শে নভেম্বর। কমিউনিস্ট পার্টির প্লেনাম সবে শেষ হল।… ট্রেনের দরজার সামনে, স্ট্যালিন কিরোভকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আর মাত্র দু-তিনদিন বাদেই ১লা ডিসেম্বর কিরোভ খুন হলেন। স্ট্যালিন খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বিষাদের ছায়া তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল। কিরোভের মুখে চুমু খেয়ে স্ট্যালিন বলেছিলেন— ‘বিদায়। বন্ধু বিদায়।’” (দেহরক্ষীর চোখে স্ট্যালিন, আলেক্সেই রীবিন, প্রথিমিউস পাবলিশিং হাউস, পৃষ্ঠা- ১৩-১৪, ২০-২২)
এবং মৃদুলবাবু যে শিবিরের মতামত প্রকাশ করেছেন, তা নিয়েও রীবিন তাঁর বক্তব্য রেখেছেন:
“এতদিন পর আজ অনেকে বলেন, ‘এ হত্যার পেছনে রয়েছেন স্ট্যালিনই।’ কিন্তু এই প্রলাপে কান দেওয়ার আগে আরও কিছু বিষয় জানা দরকার। ১৯১৯ সালে, আস্ত্রাখান শহরের দখল নিয়ে কিরোভের সাথে ট্রটস্কির মতবিরোধ হয়। ট্রটস্কি চেয়েছিলেন এই শহরের দখল শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কিরোভ তা হতে দেননি। কমরেড লেনিনও কিরোভকেই সমর্থন করেছিলেন। ফলে শহরটি লালফৌজের দখলে থাকে। ট্রটস্কি নিজের এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। এরপরও ট্রটস্কির বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ কিরোভ আটকে দেন। ১৯২৭ সালে কিরোভ ঘোষণা করেন, ‘লেনিনগ্রাদে প্রতিবিপ্লবী শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’ কিরোভের এই পাদপ্রদীপের আলোয় আসা বোধহয় সহ্য হয়নি।” (ঐ, পৃষ্ঠা- ২২-২৩)
এই বক্তব্য স্ট্যালিনের একান্ত দেহরক্ষীর। কেউ ভেবে নিতেই পারেন এই বক্তব্য পক্ষপাতদুষ্ট। আবার ফেরা যাক ‘চক্র ও চক্রান্ত’-এ। দেখি সেখানে শ্রী চট্টোপাধ্যায় কী লিখেছেন:
“রাশিয়ার বাইরে ট্রটস্কি এবং রাশিয়ার ভেতরে জেনোভিভ্, এই দুইজনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো এক বিরাট ষড়যন্ত্র দল। বাচনিক প্রচার কাজ পরিত্যাগ করে এই দল পূর্ণ উদ্যমে তাদের অভীষ্ট সিদ্ধির উদ্দেশ্যে “কাজে” নামলো… কাজে মানে হলো, যে কোনও উপায়ে বিপক্ষের প্রধান ব্যক্তিদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা। শুরু হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম মনুষ্য শিকারের পালা।
“… কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে স্থির হল, প্রথম আঘাত করতে হবে, সারজী কিরভকে। কিরভ তখন লেনিনগ্রাড পার্টির সেক্রেটারী এবং ষ্টালিনের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ।
“১৯৩৫-এর নভেম্বর মাসে জেনোভিভ্ তাঁর প্রতিনিধিস্বরূপ বাকায়েভকে লেনিনগ্রাড পাঠালেন,… কিরভের হত্যার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন, পাকাপাকিভাবে তার ব্যবস্থা ঠিক করে আসতে।
“… যে লোকটার উপর আসল “কাজের” ভার দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গেও বাকায়েভের পরিচয় হলো। পাতলা, রোগা, বছর ত্রিশ বয়স, নাম লিওনিদ্ নিকোলেয়ভ্। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে কমিউনিস্ট যুবকদের প্রধান প্রতিষ্ঠান কমশোমলের একজন বিশিষ্ট সভ্য ছিল। তার ওপর হিসাব রাখার এবং তহবিলের ভার ছিল। কিন্তু হিসাবের গোলমাল ধরা পড়ায় তাকে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেই ব্যক্তিগত আক্রোশে সে সোভিয়েত-বিরোধী এই চক্রান্তে যোগদান করে।” (চক্র ও চক্রান্ত, পৃষ্ঠা- ১০৯-১১০)
এই নিকোলেয়ভ্ই কিরভকে হত্যা করে। অর্থাৎ কিরভকে স্ট্যালিন নন, ট্রটস্কি ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত মস্কো মামলায় জিনোভিয়েভ আর কামেনেভ নিজেরাই স্বীকার করেছেন তাঁরা কিরভ, স্ট্যালিন, ভরোশিলভ আর অন্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সেই মামলা হয়েছিল দেশি-বিদেশি সকলের উপস্থিতিতে জনসমক্ষে। এই বিষয়ে আমাদের কাছে ভুরিভুরি দলিল আছে। এখন কেউ সাম্রজ্যবাদীদের সেই ক্লিশে কথাটা বলতেই পারেন যে এই মামলা ছিল সাজানো। এই কুযুক্তির জবাবে আমরা উল্লেখ করতে পারি ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাংসদ আইনজীবী ডি.এন. প্রিটের বক্তব্য। তিনি সশরীরে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা ‘অ্যাট দ্যা মস্কো ট্রায়াল’-এ সবিস্তারে লিখেছেন। সেখানে প্রিট লিখেছেন:
“…আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়েছে মৌখিকভাবে। তা কোনমতেই আগে থাকতে ঠিক করে রাখা বা শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া নয়। অল্প কিছু সুনির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে দু একজন তা মনে রাখতে পারে আর ঘটনার মূলে কোনো সত্য না থাকলেও তোতাপাখির মত আউড়ে আসতে পারে। তা সাধারণ মানসিক ক্ষমতার সাধ্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বর্তমান মামলায় ষোলজন ব্যক্তি জড়িত। বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার মেইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ডজন ডজন কথোপকথন বা ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কখনো এখানে, কখনো ওখানে ঘটা নানা ঘটনা বা কথাবার্তা জনসমক্ষে এসেছে। … অন্তত ষোলজনই তা পারতেন বলে আশা করা যায় না।
“বাস্তবে সোভিয়েত আদালতে মামলার কার্যক্রম এগোয় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।… দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ অভিনেতাদের মাসের পর মাস রিহার্সাল করিয়েও শেষ দশ মিনিটের এমন সওয়ালজবাবের অভিনয় করানো সম্ভব নয়—মামলা সাজানো তা সকলের সামনে পরিস্কার হয়ে যেত। বাস্তবে সাজানো বিচারকে এত দ্রুত চলতে দিয়ে কোনো স্টেজ ম্যানেজারই সব তালগোল পাকিয়ে ফেলার ঝুঁকি নেবেন না।” (মস্কো মামলা, ডি.এন. প্রিট, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, পৃষ্ঠা- ১২-১৩)
অর্থাৎ স্পষ্টতই প্রামাণিত হয় কিরভ হত্যা কোনওভাবেই জোসেফ স্ট্যালিন করাননি। বরং স্ট্যালিন ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ট্রটস্কি যে বিরাট ষড়যন্ত্র রচনা করেছিলেন, কিরভ হত্যা ছিল তারই অংশ। এবং এই ষড়যন্ত্র অত্যন্ত কলঙ্কজনকভাবে চিকিৎসকের দ্বারা হত্যা করেছিল মেনঝিনস্কি, মহান সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি, তাঁর ছেলে পেশকভ এবং পার্টির প্রায় হাফ-ডজন নেতকে। শুধু হত্যা নয়, শিল্পে সাবোতেজ ঘটিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ও জনগণের অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল। ট্রটস্কির ক্ষমতার লিপ্সা, ইগো, দাম্ভিকতা এসব কিছুর জন্য দায়ি।
এবার আসব ট্রটস্কির হত্যার বিষয়ে। ট্রটস্কিকে যিনি হত্যা করেন তার অনেকগুলো নাম ছিল। র‍্যামোঁ মারকাডার ওরফে ফ্রাঙ্ক জ্যাকসন ওরফে র‍্যামোঁ ইভানোভিস লোপেজ ছিলেন ট্রটস্কির দলের সভ্য ও ট্রটস্কি ঘনিষ্ট। শ্রী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন:
“সমগ্র জগৎ বিস্মিত হয়ে শুনলো, নিজের তৈরি সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে বর্তমান জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী একান্ত শোচনীয়ভাবে নিহত হয়েছেন। কোনও রিভলভারের গুলি নয়, তরবারির আঘাত নয়, একটা সাধারণ কুড়ুলের আঘাতে আততায়ী তাঁর মাথা চূর্ণ করে দিয়েছে। এবং সে আততায়ী হলো তাঁরই দলের লোক ফ্রাঙ্ক জ্যাকসন।
“…আদালতে ফ্রাঙ্ক তার দলপতির জন্যে যে অভিশাপ-বাণী বর্ষণ করে, হতভাগ্য বিপ্লবীর সমাধি-স্তম্ভকে ঘিরে সেই ক্রুদ্ধ অভিশাপই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
— এই একটি লোক, আমার সমস্ত প্রবৃত্তিকে সে পরিবর্তিত করে দিয়েছে; এই একটি লোক আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ, আমার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই আজ আমাকে রূপান্তরিত করে নামহীন, দেশহীন যাযাবর করেছে, এক টুকরো কাগজের মতন সেই একটি লোক আমার জীবনকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে…” (চক্র ও চক্রান্ত, পৃষ্ঠা- ১৭৪)
পূর্বে জাপান থেকে পশ্চিমের আমেরিকা, দক্ষিণে ভারত থেকে উত্তরে সাইবেরিয়া—এক বিরাট আর জটিল ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করেছিলেন ট্রটস্কি— স্ট্যালিন আর সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই তার হত্যাকারী কুড়ি বছর জেল খাটার পর যখন কিউবা হয়ে রাশিয়ায় এসেছিলেন, রাশিয়ার জনগণ তাকে বীরের সম্মান দিয়েছিল। ভাবার কোনও কারণ নেই যে স্ট্যালিন তাকে বীর বানিয়েছিলেন। স্ট্যালিন তখন মৃত এবং রাশিয়ার মসনদে তাঁর বিরোধী নেতৃত্ব আসীন।
ঠিকই তো! আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর বিপ্লবীদেরকে একজন ইংল্যান্ডবাসী ইউরোপিয়ানদের হত্যাকারী হিসাবে গালি দিতেই পারে, কিন্তু আমাদের কাছে তাঁরা জাতীয় বীর। তাই স্ট্যালিন যদি জ্যাকসনকে ‘অর্ডার অব লেনিন’ পুরস্কারে ভূষিত করে থাকেন, দেশকালের বিচারে তা অন্যায্য কিছুতেই নয়।
শ্রী মৃদুল শ্রীমানী লিখেছেন, “সের্গেই হত্যার ছুতো ধরেই পরবর্তী চারটি বছর ধরে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে পার্জ (শুদ্ধিকরণ) করার নামে খুন করেছিলেন স্তালিন। অথবা নির্বাসনে। অথবা জেলে।”
এই বক্তব্যও সর্বৈব মিথ্যা। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর গর্ভাচভ পার্টির গোপন আর্কাইভ উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর মোট প্রায় ৯০০০ পৃষ্ঠার গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে উক্ত অভিযোগ সবই অসত্য এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপপ্রচার ছিল। আগ্রহী কেউ চাইলে www.northstarcompass.org-এ গিয়ে মারিয়া সোউসার দীর্ঘ প্রবন্ধটি পড়ে নিতে পারেন।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্ট্যালিন ছিলেন অতিমানবিক একজন কর্মযোগী মহান পুরুষ। আইনস্টাইন, আনা লুই স্ট্রং, ডুরান্টি, নেহেরু, পল রবসন, বার্নাড শ’, জন গান্থার, পাবলো নেরুদা, লুই ফিসার, পাবলো পিকাসো, জাঁ পল সাত্রে, চার্চিল, মাও সে তুং, শিবদাস ঘোষ, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, জে ডি বার্নাল, নেতাজী সুভাষ… এই তালিকা শেষ হবে না যাঁরা স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেছেন, দ্ব্যর্থহীনভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা আর বিশ্বাস জানিয়েছেন।
TechTouch টকে শ্রী মৃদুল শ্রীমানীর লেখাটিতে তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই মিথ্যাচার করেছেন—এ-কথা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি না। কারণ একটা কথা প্রচলিত আছে, মহান স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতা আর সাম্রাজ্যবাদীদের আশীর্বাদে যত বই ছাপা হয়েছে সবগুলোর পাতা দিয়ে এই পৃথিবীকে মুড়ে দেওয়া যাবে। কারণ শোষকদের বুকে স্ট্যালিন যেমন আঘাত হেনেছিলেন, এমন আর কেউ কখনও করেনি। তাই সেই অপপ্রচারের দ্বারা কেউ অসচেতনভাবে প্রভাবিত হয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু এভাবে কি কুৎসাকারীদের মনের কালি দিয়ে স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করা যাবে?
শেষ করব স্ট্যালিনের দেহরক্ষী আলেক্সেই রীবিনের কথা দিয়ে:
“নিজের জন্য কমরেড স্ট্যালিন কিছুই সঞ্চয় করেননি। পরিবারের জন্যও না। কোনও অর্থ বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তিনি রেখে যাননি। কোনও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি তিনি। এমনকি নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে, তাদের প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কোন সরকারি ক্ষমতার বিশেষ প্রয়োগ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ঘর থেকে পাওয়া গিয়েছিল সর্বসাকুল্যে ৯০০ রুবল। এই ছিল তাঁর সর্বমোট সম্পত্তির পরিমাণ।
“তাই, কমরেড স্ট্যালিনের যারা কুৎসা করে তারা শুধু স্ট্যালিনের শত্রু নয়, শুধু রাশিয়ারও শত্রু নয়, তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শত্রু, সমাজতন্ত্রের শত্রু, জনগণের শত্রু তারা। যতদিন মেহনতি মানুষ পৃথিবীতে থাকবে, অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে, ততদিন কমরেড স্ট্যালিনের নাম শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়ে থাকবে এবং শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হবে।”

ঋণ স্বীকার:

প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত
১) প্রসঙ্গ স্ট্যালিন
২) চক্র ও চক্রান্ত, শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
৩) দেহরক্ষীর চোখে স্ট্যালিন, আলেক্সেই রীবিন
৪) মস্কো মামলা, ডি. এন. প্রিট
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।