ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || আফ্রিকার ডায়েরি- ৫ – সুব্রত সরকার

 আফ্রিকার ডায়েরি

( মাসাইমারা ঘুরে কেনিয়ার সীমান্ত ইসেবানিয়া হয়ে তানজানিয়ায় প্রবেশ…)

আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। গতকাল এমন ভোরেই নাইরোরির বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। আজ মাসাইমারায় ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি ভোর হয়ে গেছে! ভোরের নরম কুসুম আলোয় চারপাশ শান্ত সুন্দর। পাখিদের কাকলি কানে এসে কলতান হয়ে বাজছে । আফ্রিকায় এসেছি আজ দুদিন হলো!..
আজ আমাদের খুব লম্বা সফর। যত তাড়াতাড়ি পারি বেরিয়ে পড়ব। এবার একে একে তিনজনের তৈরী হয়ে নেওয়ার পালা।
গতকাল সন্ধ্যায় মাসাইমারার গেম ড্রাইভ থেকে লজে ফিরে এসে খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত ছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার করেও শেষ পর্যন্ত খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যেতে পারি নি। লজের লন জুড়ে মাসাইদের আগুন জ্বেলে নৃত্যগীত হচ্ছিল, সেখানে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। মাসাইদের গান মানে যেন শব্দগীতি। মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ বের করে সমবেত ভাবে গায়। আর নাচ হলো তালে তালে লাফানো। “মাসাই জাম্প” নামে যা খ্যাত। একেকজন খুব উঁচু পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। এই নাচের মাধ্যমে মাসাই পুরুষদের শৌর্যের প্রকাশ ঘটে। যে যত উঁচুতে লাফ দেবে, তার বীরত্ব তত প্রকাশ পাবে। সামাজিক সম্মানও তত বেশি।
আজ আর্লি ব্রেকফাস্ট বলা ছিল। ডাইনিং হলে গিয়ে দেখি সাহেব-মেমরা সব আমাদের আগেই চলে এসে ব্রেকফাস্ট নিয়ে টেবিলজুড়ে বসে পড়েছে। আমরাও পছন্দের খাবার নিয়ে নিলাম। অনেক অপশন। নিজের খাবার খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। আমি খাদ্য নিয়ে খুব এক্সপেরিমেন্ট বা ভ্যারাইটির কথা ভাবি না। মোটামুটি নিজের পছন্দের খাবার ঠিকই পেয়ে যাই। খেয়েও নিই চুপচাপ।
আজ আমাদের প্রায় তিনশো কিমি রাস্তা পেরতে হবে। তার মধ্যে থাকবে অনেকটা গেম ড্রাইভ। মাসাইমারার দ্বিতীয় দিনের গেম ড্রাইভ করতে করতে পৌঁছে যাব ইসেবানিয়া (Isebania) বর্ডারে। সেখানে পাসপোর্ট – ভিসা দেখিয়ে কেনিয়ার প্রতিবেশি দেশ তানজানিয়ায় প্রবেশ করব। তানিজানিয়ায় থাকব চার রাত পাঁচদিন। আজ প্রথমে আমরা ইসেবানিয়া থেকে একশো কিমি দূরের লেক শহর মুসোমায় যাব। তানজানিয়ার বিখ্যাত লেক ভিক্টোরিয়া দেখব। সেখানে আমাদের রাত্রিবাস। তার পর দু’রাত তানজানিয়ার বিখ্যাত জঙ্গল সেরেংগেটিতে এবং একরাত গোরোংগোরোর পাশের শহর কারাটু তে কাটিয়ে নামাঙ্গা বর্ডার দিয়ে আবার কেনিয়ায় প্রবেশ করব।

আজকের গেম ড্রাইভের রাস্তা দেখলাম মূল জঙ্গলের গেট দিয়ে প্রবেশ না করে, তার সমান্তরাল একটা রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। পথের ওপাশে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, সাভানার হলুদ উপত্যকা, আকাশিয়ার সবুজ বন। এপাশে মাসাই জনপদ, গ্রাম, লজ, রিসর্ট, স্কুল, বাজার। এভাবে অনেকটা পথ যেতে হয়। এই পথ একদম ভালো ছিল না। ল্যান্ড ক্রুজারের মত শক্তিশালী গাড়ি ছিল বলে পিঠ- কোমড়ে তেমন ব্যথা হয় নি।
জঙ্গলের সমান্তরাল এই মেঠো পথ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে দেখলাম একটা বোর্ড – Republic of Kenya / Narok County Government লেখা। এই পথটা ধরে যেতে যেতে কেনিয়ার গ্রামজীবনের একটা ছবি ধরা পড়ল। পথের ধারে বাড়ি- ঘর যেমন আছে, তেমন স্কুল, বাজার, দোকান, লজও আছে। Oloigero Primary School দেখলাম। Mara Leisure Camp, Mara Sweet Acacia Lodge দেখতে পেলাম। পথে অনেক ছাত্র ছাত্রী চোখে পড়ল স্কুলে যাচ্ছে। সবার স্কুলের ইউনিফর্ম আছে। ওদের দিকে হাত নেড়ে অনেকবার টা টা করেছি, ওরাও হেসে হাত নেড়েছে। যেখানেই আমি বেড়াতে যাই, স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের দেখা পেলে বেশ লাগে। সুযোগ থাকলে আলাপও করি। ওদের মধ্যেই আমি ‘সবুজ পাঠ- অন্যভুবন’কে খুঁজে পাই!..

এভাবে চলতে চলতে প্রায় এক দেড় ঘন্টা পেরিয়ে এসে জঙ্গলে প্রবেশ করার একটা গেট পেলাম। জানলাম এটা সাউথ গেট। গেটে ঢুকে কিছুটা এগোতেই দেখলাম দুটো ইমপালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দারুণ ওদের মাথার শিংজোড়া। আপনমনে ঘাস চিবোচ্ছে। কি শান্ত, সুন্দর জীবন। আরেকটু এগিয়ে পেলাম একদল ভোলাভালা টাইপের জেব্রা। জেব্রারা যেন বড় শান্ত, নিরিহ প্রাণী। তারপর পেলাম এক নোংরা জলের খাল। সেখানে মনের সুখে ডুব দিয়ে রয়েছে কতগুলো জলহস্তী। ওরা নাকি নোংরা পচা জলেই স্নান করতে ভালোবাসে!..
এই জঙ্গলের পরিবেশ পরিচিত সেই সোনালী সাভানার মতই। আদিগন্ত ধূ ধূ করছে। এ এক অসাধারণ হলুদ অরণ্য। বন্যপ্রাণ আপনমনে চরে বেড়াচ্ছে। তুমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছো কি দেখছো না ওরা থোড়াই কেয়ার করে!.. এই যে দর্শকদের প্রতি এত শৈল্পিক উদাসীনতা এটা ওরা কি ভাবে রপ্ত করেছে খুব জানতে ইচ্ছে করে!..
এই জঙ্গলে এরপর হাতি দেখেছি এক পাল। হায়েনা, ওয়াইল্ড বিস্ট, আফ্রিকান রোলার প্রচুর দেখা যায়। চড়ুই পাখির মত ছোট্ট ও ছটফটে রোলাররা দেখতে ভীষণ সুন্দর। ভয় পায় না মানুষকে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও উড়ে পালায় না। ফিস ঈগল দেখলাম কয়েকটা।
মাসাইমারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর মজার সঙ্গে বন্যপ্রাণ দর্শন যেন ফ্রি!.. একটু পর পরই কিছু না কিছু দৃষ্টিগোচর হবেই হবে।
সেক্রেটারি বার্ড একটা সুন্দর পাখি। কি সুন্দর ঝুঁটি আছে। অনেক দেখলাম। দু’ তিনরকম হেরন আছে। ব্ল্যাক হেডেড হেরন, গলিয়াথ হেরণ চোখে পড়ল। এক বছর আগে আমেরিকার চার্লসটন শহরে নদীর ধারের এক পার্কে হেরন দেখেছিলাম কয়েকটা। এরা লুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাখি। এতদিন পর আজ আফ্রিকার জঙ্গলে আবার ওদের দেখে বেশ মজা পেলাম। দেশ বিদেশে বেড়ানো তো মজা কুড়নো আর স্মৃতি জমানোর এক নিরন্তর খেলা। এ খেলার দক্ষ খেলোয়াড় হতে পারলে, বেশ জীবন রসিক হয়ে বাঁচা যায়!..

সাউথ গেট দিয়ে ঢুকে গেম ড্রাইভ করতে করতে অনেকটা পথ বেড়ানো ও অনেক বন্যপ্রাণী দেখা হলো। এ দেখার আনন্দ ক্লান্ত করে না পথচলাকে। এবার এসে পৌঁছলাম আরও একটা গেটের কাছে – টিকিট কেটে ঢুকতে হলো। গেটের পাশেই ছিল পাথরে খোদাই করা একটা ফলক, তার বুকে লেখা – Maasai Mara National Reserve Cheetah Observation Rules- বেশ কড়া আইনকানুন, গাড়ির স্পিড লিমিট সর্বোচ্চ ৫০ কিমি, পশুপাখিদের বিরক্ত বা খাবার দেওয়া চলবে না, গাড়ি খেয়ালখুশি মত যে কোনও পথে যেতে পারবে না। এই সব নিয়ম ভঙ্গ করলে পঞ্চাশ হাজার কেনিয়ান শিলিং ফাইন!..
এই জঙ্গলের পথেও পশুপাখির দেখা পাচ্ছি। কেপ বাফেলো অনেক দেখলাম। হায়েনাগুলো দুজনে দুজনে ঘুরে বেড়ায়। থমসন গ্যাজেল দেখতে পেলেই মন বেশ খুশি হয়। বাঘ, সিংহ এখনো দেখতে পাই নি। হাতি, জলহস্তি আবারও দেখলাম। এ দেখায় বিরতি নেই। মাসা বলল, সামনেই নদী আসছে। নদীর নাম “মারা”। এই মারা নদীর কথা অনেক শুনেছি। আজ প্রথম তাকে দেখবে। গতকাল নাইরোবি থেকে আসতে আসতে তেমন কোনও নদী দেখি নি, তাই প্রথম নদী দেখার আনন্দ পেতে মন উৎসুক হয়ে রয়েছে। এপথেও যেতে যেতে কিছু জনপদ, ছোট গ্রাম, হাট-বাজার চোখে পড়ল। বেশ মজার জিনিসও দেখলাম পেট্রোল পাম্প!.. একজন লোক একটা মাত্র তেলের মেশিন নিয়ে বসে আছে, সেটাই ওদের পেট্রোল পাম্প। জঙ্গলের গভীরে ছোট ছোট গ্রামের জন্য এমনই আরও পেট্রোল পাম্প পরেও অনেক দেখেছি। এদিকটাকে বলে মারা ওয়েস্ট। এখানে রাস্তার ধারে চোখে পড়ল Illumuran Youth Environmental Group এর একটা বোর্ড। ওরা জঙ্গলের জনজাতিদের জন্য কিছু সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে মনে হয়। এখানকার গ্রামগুলোকে আমাদের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের আদিবাসী গ্রামগুলোর মতই মনে হয়। পথের ধারে সেই লালমাটি, গরু, ছাগল, হাট আর আফ্রিকার আদিবাসী গরীবগুর্বো আম জনতা।

দ্বিতীয় দিনের এই ভ্রমণটা প্রচলিত গেম ড্রাইভের মত একদমই হচ্ছে না। মাঝে মাঝে গ্রাম, জনপদ, জঙ্গল, গেম ড্রাইভ। আবার লোকালয়, বাজার, জঙ্গল, গেম ড্রাইভ। বেশ অন্যরকম মজা উপভোগ করছি। এভাবে যেতে যেতে একসময় দেখা পেয়ে গেলাম মারা নদীর। প্রথম দেখায় মনে হবে আমরা বুঝি রাঁচি বা নেতারহাটের কোনও পটভূমিকায় এসে পড়েছি। কোয়েল নদীকে দেখছি! ভীষণ মিল আছে। একই রকম কিছুটা এখানকার ভূপ্রকৃতি। মারা নদীর চলনও তাই। বিরাট নদী নয়। পাহাড় জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলেছে কালচে জলের মারা নদী। নদী দেখতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। নদীর সঙ্গে মিতালি চট করে হয়ে যায়। ” ওগো নদী, আপন বেগে পাগল পারা… পথে পথে বাহির হয়ে আপন হারা…”
মারা নদীকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে চলে যাই
মারা নদীর কাছে। আমাকে এমন আত্মহারা হতে দেখে মাসাও ছুটে চলে এসেছিল আমার পেছনে। তার পর দুজনে মিলে একটু ফটোসেশান হলো। এ সব স্মৃতি কোনওদিন পারব ভুলতে!..

মারা নদী পেরিয়ে কিছুটা এসেই পেলাম এক মাসাই ভিলেজ। মাসার পরিচিত। মাসাই সর্দার দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছিল পর্যটকদের জন্যই। মাসা ল্যান্ড ক্রুজারটাকে রাস্তা থেকে নামিয়ে সটান চলে গেল ওদের ডেরায়। আকাশিয়া গাছের ছায়ায় মাসাইরা বসে ছিল। আমাদের গাড়ি গিয়ে থামতেই সমবেত উল্লাসে ওরা বলল, “জাম্বো, জাম্বো, কারিবু। ওয়েলকাম ফ্রেন্ডস।”

আমি, সোহম, ডুলুং গাড়ি থেকে নেমে এলাম। নামা মাত্রই ওদের সর্দার এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা মাসাই ভিলেজ, মাসাই কালচার সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড? ”
আমরা সম্মতি জানালাম। সে তখন আমাদের নিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসাল। এবার শুরু হলো এক অভিনব বার্গেনিং। মাসাই সর্দার বলল, মাসাই ভিলেজ ও মাসাই কালচার কে দেখতে-জানতে হলে আমাদের একেকজনকে তিরিশ ডলার করে দিতে হবে। আমি জানতাম, মাসাই ভিলেজে ঢুকতে ডলার লাগে। এবং জনপ্রতি রেট কুড়ি ডলার। তাই কুড়ি ডলারেই আমরা ওদের রাজি করালাম। আমাদের দিতে হবে তিনজনের জন্য ষাট ডলার। যা ভারতীয় টাকায় প্রায় পাঁচ হাজার !..
মাসাই ভিলেজ ট্যুর একটা বড় আকর্ষণ আফ্রিকা ভ্রমণে। কেনিয়ায় সরকার থেকেই এই নিয়ম করে রেখেছে। পর্যটকরা মাসাইদের গ্রামে বেড়াতে যায়, আলাপ পরিচয় হয়, নাচ গান দেখে, হস্ত শিল্পের জিনিস কেনে, ঘরে বানানো মধুও অনেকে কেনে। এর ফলে মাসাইদের জীবন-জীবিকায় একটু উন্নতি ঘটে।
মাসাই সর্দার সুন্দর ইংরেজিতে প্রথমে মাসাই জনজাতি সম্পর্কে বলল। মাসাই শব্দের অর্থ হলো- ‘আমার জনগণ।’ মাসাই জনগোষ্ঠী ‘ মা’ ভাষায় কথা বলে। ওরা নীলোটিক ( নীল নদের উপত্যকার আদিবাসী)। মাসাইরা আধা যাযাবর এবং পশুপালক।
মাসাইরা একেশ্বরবাদী। সেই ঈশ্বরের নাম – ‘এনকাই’। বা ‘এনগাই’। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানান সামাজিক ও অর্থনৈতিক মিশ্রণের ফলে এখন অনেক মাসাই খৃষ্টান বা মুসলিম হয়ে গেছে।
মাসাইদের খাবার দুধ, মাংস, চর্বি, রক্ত, মধু এবং গাছের ছাল। গরুর রক্তের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে ওরা খায় খুব পবিত্র মনে করে। আমাদেরও আপ্যায়ন করে বলেছিল, গরুর রক্তের সঙ্গে দুধ দিয়ে খেতে!..

মাসাই পুরুষরা পলিগ্যামি অর্থ্যাৎ বহুগামী। এবং সেটা বেশ বুক ফুলিয়ে বলে। পুরুষরা সবাই একাধিক বিয়ে করে। মাসাই সমাজে এটা খুব প্রচলিত কালচার। এই নিয়ে ঘরে কোনও ঝগড়া- বিবাদ নেই! আমাদের সর্দার চমকে দিয়ে বলল, সে দশ বিবাহ ইতিমধ্যে করে ফেলেছে!.. মানে আবারও করতে পারে!.. মাসাই সমাজে যার ঘরে যত বেশি গরু ছাগল সে তত বেশী ধনী। তাই তার বিয়ে করার সাহস ও অধিকারও তত বেশি। ওদের কোনও ফিক্সড ডিপোজিট, শেয়ার, ডিবেঞ্চার, এম আই এস, ইনসিওরেন্স, পেনশন কিচ্ছু লাগে না!.. ওদের সম্পর্কে তাই লেখা হয়- ” The Maasai measure wealth by the number of cattle they own, and cows are considered more valuable than money in their culture. “

সর্দারের মুখে এসব গল্পকথা শুনতে শুনতে অনেকটা সময় মুগ্ধ হয়ে কাটালাম। তারপর সর্দার নিজের হাতে গ্রামের বাউন্ডারির বেড়া ঠেলে খুলে দিয়ে আমাদের মাসাই ভিলেজে প্রবেশের অনুমতি দিল। ভিলেজ মানে হলো চারদিকে কাঁটা ঝোপের বেড়া। বেশ উঁচু বেড়া। খুব সহজে যাতে বনের জন্তু জানোয়ার টপকে না আসতে পারে। প্রতি রাতে মাসাইরা পালা করে গ্রাম পাহারা দেয়। গ্রাম মানে কাঁটা ঝোপের বেড়ার ঘেরাটোপে থাকা দশ পনেরোটা ছোট ছোট চৌকো ঘর। বাইরেটা গোবর- মাটির দেওয়াল, মাথায় খড়, সাভানা ঘাস, গাছের ছাল বা চট জাতীয় কিছু দিয়ে ঢাকা। পাশাপাশি সব ঘরগুলো। এক একটা ঘরে এক একটা পরিবার থাকে। অনেকটা শহরের কলোনির মত!
এমন একটা মাসাই ঘরে কুঁজো হয়ে ঢুকে দেখি কি অদ্ভুত ওদের ঘর- বাসস্থান! অন্ধকার একটা খুপরি। পুচকে একটা জানলা। ঘরে বাইরের কোনও আলোই ঢুকতে পারে না। ওই ছোট্ট একটা অন্ধকার ঘরেই ওরা রান্না করে, খায়, ঘুমায়। সন্তান প্রসব করে। বিছানা বালিশ, খাটিয়া রাখে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোও যায় না। আশ্চর্য হয়ে ভাবি মাসাই পুরুষরা তো বেশ দীর্ঘদেহী হয়। ওরা এই ঘরে ঢুকে কি করে থাকে!..

মাসাইরা যাযাবর প্রকৃতির। এক জায়গায়, একঘরে বেশি দিন থাকে না। এক বছর বা দু’বছর অন্তর ওরা নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে ঘর বেঁধে দলবদ্ধ ভাবে বসবাস শুরু করে। মাসাইদের কুঁড়ে ঘরগুলোর একটা নাম আছে – ‘বোমা’। গোয়াল ঘরের নাম – ‘ক্রাল’। আরও অনেক কিছু শিখলাম সর্দারের কাছে – লেপার্ডকে বলে – চুই। সিংহকে বলে – সিম্বা। জলহস্তীকে বলে- কিবাকো।
মাসাইদের দেবতার নাম – গুগুনোগুম্বর। জলের দেবতা – নেয়ামি। বজ্রের দেবতা – খনভাম।
আমাদের সর্দার খুব বলিয়ে কইয়ে এবং চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। গ্রামে সবাই ওকে বেশ ডরায়, সম্ভ্রম করে। ওর এক ডাকে জড়ো হয়ে গেল মাসাই রমণীরা। দেখে মনে হলো ওরা সবাই মাঠে গোয়ালে খেতিতে কাজ করছিল। সর্দার বলল, আমাদের মেয়েরা সোয়াহিলেতে কথা বলতে পারে। ইংরেজি জানে না। তোমরা চাইলে ছবি তুলতে পারো। আমরা ইতিমধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় সোয়াহিলি শব্দ শিখে নিয়েছি। পথে ঘাটে বলে মজাও পাচ্ছি।
আমি সর্দারকে বললাম, “তোমাদের গ্রামের ছোটরা কোথায়? ওদের ডাকো?”
একজন রমণী ছুটে চলে গেল একটু দূরে। তারপর দেখি চারপাশ থেকে জড়ো হয়ে গেল প্রায় দু’ডজন কচিকাঁচা। আমরা অনেক পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার নিয়ে গিয়েছিলাম শিশুদের জন্য। ডুলুং – সোহম সেগুলো দেওয়া শুরু করল ওদের হাতে। কি আনন্দ পুঁচকেগুলোর। পৃথিবীর সব শিশুদেরই এই একটা দুষ্টুমি বোধহয় চিরন্তন, একটা হাতে পেন্সিল লুকিয়ে অন্যহাতটা বাড়িয়ে দেয়। যদি আরও একটা পাওয়া যায়!..ডুলুং এর কড়া নজরে তা ধরা পড়ে যেতেই লজ্জা পেয়ে দে ছুট!..সর্দার তখন হাসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখছি। আর সবুজ পাঠের কথা মনে পড়ছে। এ ভালোলাগার স্বাদ বড় অনাবিল।
আমরা যত পেন্সিল ইরেজার নিয়ে গিয়েছিলাম, তত লাগলো না। সর্দার বলল, “রেখে যাও, বড়রা স্কুল থেকে এলে ওদেরও দেব।” খাতার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু লাগেজ ভারী হয়ে যাওয়ার দরুণ আর আনতে পারি নি খাতা।
অবশিষ্ট পেন্সিল, রাবার, শার্পনার গুলো সর্দারের হাতেই তুলে দিলাম। বড়রা স্কুল থেকে ফিরলে পেয়ে যাবে।
এবার বিদায়ের পালা। তার আগে সর্দার বলল, “মাসাই জাম্প দেখবে না?”
“ইয়েস।”আমরা তিনজনই একসঙ্গে বললাম।
বড় এক গাছের ছায়ায় শিঙ্গায় ফু দিয়ে শুরু হল মাসাই জাম্প। মনে হলো সব মাসাই পুরুষরা চলে এসেছে। ওদের সবার গায়ে সেই লাল কালো ডুরে কাটা চাদর, হাতে ছিপছিপে সরু লম্বা লাঠি। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে কেমন লিলিপুট মনে হচ্ছিল।
মাসাই জাম্পের সঙ্গে ওদের সমবেত চিৎকার খানিকটা গানের সুরের মত , তার তালে তালে নাচ ও লাফ দেওয়া চলে। একসময় আমাকেও ওরা দলে নিয়ে নিল। চেষ্টা করে বার কয়েক আমিও লাফ দিলাম। এসেছি আনন্দ কুড়োতে, স্মৃতির ভান্ডারে মণি রত্ন ভরাতে- তাই লাজুক হয়ে থেকে এই সুযোগ নষ্ট কেন করব!..

এক দেড় ঘন্টা সময় এভাবেই কেটে গেল। মাসাই ভিলেজ ভ্রমণ স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে রয়ে গেল সারা জীবনের জন্য।
ফিরে আসার সময় মন কেমন করছিল। সর্দার আমাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে বলল, “আসান্তে সানা।” সোয়াহিলি ভাষা। অর্থ হলো
Thank you very much. তারপর হেসে বলল, Come again.
সোহম হঠাৎ এসময় বলল, Kwaheri. সোয়াহিলি শব্দ। অর্থ হলো- বিদায়।
মাসা বলল, “তান্ডে।” অর্থ হলো Let’s go!..
ডুলুং হেসে বলল, ‘সাত্তা’। অর্থ হলো – ওকে। লেটস গো।..
আমি মুদু হেসে সর্দারের সঙ্গে করমর্দন করে বললাম, “গুডবাই। আসান্তে!.. অনেক ধন্যবাদ!.. আসান্তে সানা!..”
ল্যান্ড ক্রুজার এগিয়ে চলল। সর্দার হাত নাড়ছে, ঝাপসা চোখে দেখছি। এবার আমরা সোজা গিয়ে থামব ইসেবানিয়া বর্ডারে।
এপারে কেনিয়া, ওপারে তানজানিয়া!..

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *