কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন — বান মাস্কা

প্রায় দশ বছর মুম্বাইয়ে প্রবাসী বাঙালি হয়ে রাস্তার মোড়ে অনেকবার ইরানী চা খেলেও কখনই ইরানী রেস্তোরাঁগুলোতে যাওয়া হয়নি৷ এরপর যখন পুনে চলে এলাম প্রতিবেশী বন্ধুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে দুই পরিবার মিলে চলে গিয়েছিলাম গুড লাক কাফেতে৷ দোকানটি যে বিশাল ঝাঁ চকচকে এমন নয়, দেখে একেবারেই মনে হয় না যে এখানেও ভালো কিছু খাবার পাওয়া যায়৷ সকলের পাতে পাতে উঁচু উঁচু পাও আর চা। এদিনে ওই বন্ধুর ছেলে মেয়েরা লাফাচ্ছে কে কটা বান-মাস্কা খাবে৷ আমি জানতাম না খাবারটা আসলে কি! বান শুনে বুঝেছিলাম পাউরুটি জাতীয় কিছু খাবার হবে৷ মাস্কা কি হতে পারে সেই নিয়ে কোন মাথা খাটাইনি৷ এরপর যখন খাবার এলো, দেখলাম বড় সাইজের বান, পিস পিস করে কাটা আর ভেতরে পুরু করে দেওয়া বাটার/মাখন। মাখন দেখেই মনে পড়ল, একসময় স্কুলে প্রচলিত কথা ছিল “কিরে মাস্কা লাগাচ্ছিস!” এই মাস্কা লাগানো ছিল মাখন লাগানো। অর্থাৎ বাটারিং করা বা তৈলমর্দন করা। স্বার্থচরিতার্থের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত প্রক্রিয়াটি যে আসলেই বাস্তবে খাবার থেকে এসেছে আমি ভাবিনি এতোদিন৷ সেটা সেদিন খেতে বসেই উদ্ধার করেছিলাম।

কলকাতায় যেমন নানান দেশ বিদেশের লোকেরা এসে বসবাস করেছে, রাজত্ব করেছে, তাদের সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তার করেছে তেমনি এই দিক থেকে মুম্বাই এবং মুম্বাইয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি বাদ যায় না৷ কলকাতায় যেমন জলপথের যাতায়াতের সুবিধার কারণে ঔপনিবেশিক বানিজ্য বিস্তার সহজ হয়েছিল তেমনি মুম্বাইতেও জলপথ বেশ উন্নত৷ বিশেষ করে পশ্চিমের দেশগুলি থেকে লোকজন বেশ ভালোই আসত। কেউ বেড়াতে কেউ বানিজ্য করতে আবার কেউ প্রাণে বাঁচতে৷ যারা বর্তমানে মুম্বাই অধিবাসী তারাও আমার মতো প্রত্যেকেই স্বীকার করবে, এখানে বহুসংস্কৃতির লোক মিলে মিশে থাকে৷ সেই কারণেই হয়তো এখানেও নানান বিদেশী খাবার দোকান পাওয়া যায়৷ যার মধ্যে অন্যতম হল ইরানী খাবার দোকান৷

ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সময়ে সময়ে মানুষের আগমন ঘটেছিল ভারতের পশ্চিমে। তাদের মধ্যে অনেকেই জরাথ্রুস্টীয় ছিল। এদের চলে আসার পেছনে সব থেকে বড় কারণ ছিল এরা ইরানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে কঠিন ভাবে নির্যাতিত হত। যেমনটা আজও হয়ে থাকে। ক্ষমতাবানের কাছে অক্ষম বা স্বল্প ক্ষমতাবানের মাথা নত করে জুলুম সহ্য করে বেঁচে থাকা। এটাই হয়তো নিয়ম। খাদ্যশৃঙ্খলে পড়েছিলে একে অপরকে খায়৷ আর সেটা তাদের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই৷ শিকার করা কি সবার সমান ক্ষমতা? না। তা নয়৷ পশু মানুষে পার্থক্য থাকলেও সৃষ্টির আদি থেকে মানুষের মধ্যেও এই খেয়ে ফেলা প্রবৃত্তি কাজ করে। যার জোর তার রাজ৷ যাইহোক, ১৮৭০-৭২ সালে ইরানে তথা পারস্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেই সময় দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচতে জরাথ্রুস্টীয়দের সাথে সাথে অ-জরথ্রুস্ট্রীয় ইরানিরাও বাঁচার তাগিদে দেশ ছেড়েছিল। আর অনেকেই উঠেছিল ভারতের পশ্চিমে, বিশেষ করে গুজরাট, মুম্বাই এই অঞ্চলগুলোতে। ধীরে ধীরে এদের সংখ্যা বাড়ে। স্থায়ী জীবন শুরু হয়ে। ফলে ভারতেও তাদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং সামাজিক মর্যাদা গড়ে উঠেছে। যার ফলে আজও পার্সিদের বিশেষ দিনে কেন্দ্র সরকারে ছুটি বরাদ্দ হয়।

পার্সিরা ভারতে এসেই নিজেদের বিস্তার শুরু করেছিল। যেমন ব্যাংকিং, টেক্সটাইল, জাহাজ নির্মাণ এবং রিয়েল-এস্টেট শিল্পে তাদের যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। আস্তে আস্তে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর সাথে গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল। ইরানিরা ফার্সি ভাষার একটি উপভাষা দারি ভাষায় কথা বলত এবং খুব কম পুঁজি নিয়ে ইরান থেকে এসেছিল। ফলে তাদের নতুন জীবন শুরু থেকেই অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হওয়ার দরকার হয়ছিল। পরিশ্রমী হওয়ার কারণে ইরানিরা অল্প সময়েই তৎকালীন বোম্বেতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এর পেছনে অবশ্য আরও একটা গল্প আছে৷ বোম্বেতে বসতি স্থাপনকারী এই ইরানিদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মধ্য ইরানের ইয়াজদ এবং কেরমান শহর থেকে এসেছিলেন। ইয়াজদ ইতিমধ্যেই তার মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং অভিবাসীদের মিষ্টি তৈরির দক্ষতা তৎকালীন বোম্বেতে তাদের ব্যবসায় তাৎক্ষণিক সাফল্য এনে দেয়। যদিও অর্থের অভাব ছিল, কিন্তু মনের উদারতা এই পথকে মসৃণ করেছিল৷ কারণ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কোন দোকানের কোণার প্লটগুলিকে অশুভ বলে মনে করতেন ফলে খালিই পড়ে থাকত। আর সেই জায়গাগুলো অনেক কম দামে পাওয়া যেত। যেগুলো ইরানিরা হাতছাড়া করেনি। এই কারণেই অনেক পুরানো ইরানি ক্যাফে আজও রাস্তার মোড়ে অবস্থিত। বা কোন দোকানের কোনায় অবস্থিত৷ গুডলাক কাফেও অনেকটাই তাই।

ইরানিদের এই বসবাস ভারতবর্ষে শিল্প বিপ্লব ঘটাতে শুরু করে। ১৮৬০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে টেক্সটাইল থেকে শুরু করে নানান দিকের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে। বিশেষ করে আমেরিকায় যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল তুলোর বিশাল চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল৷ ভারতের পশ্চিমে এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করেনি। এবং গড়ে উঠেছিল তুলাকল। ইতিমধ্যে ভারতে রেল চালু হল, ব্যবসায় তখন শুধু মুনাফা অর্জনের ডাক। ব্রিটিশ সরকার এই সব সুযোগ লুফে নিয়েছিল। যার কারণে বোম্বে পোর্ট ট্রাস্ট (১৮৭৩) প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৭৫ সালে সাসুন ডক তৈরি করা হয়। এরপর ১৮৮০ এবং ১৮৮৮ সালে আরও দুটি ওয়েট ডক তৈরি করা হয়। এই উন্নয়নের ফলে উচ্চ শ্রম চাহিদা দেখা দেয় এবং ১৮৮৮ সালে খোলা নবনির্মিত ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী বোম্বেতে প্রবেশ করতে শুরু করে। এই নতুন শ্রেণীর শ্রমিক, বেশিরভাগই কারখানার শ্রমিক, রেলওয়ে শ্রমিক এবং ডক শ্রমিক। ইরানি ক্যাফেগুলোও সুযোগের সদ ব্যবহার করে৷ ফলে দ্রুতই মূল বাজারে পরিণত হয় এবং শ্রমিকদের কাছে খুব কম দামেই বিস্কুট, রুটি (মাখন লাগানো বান বা পাউরুটি) এবং চা বিক্রি করত।

এভাবেই প্রচলিত হয়ে যায় বাটার রুটির সাথে চা। যা পার্সিদের নানান খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে আজও বাজার মাতিয়ে রেখেছে৷ এতো ইতিহাস, প্রচলন ইত্যাদির গল্প করলাম। কিন্তু কি আছে এমন এই বান মাস্কাতে? কেনই বা মুখে লেগে থাকা খাবার?

খাদ্যরসিক বা ভোজনরসিক যারা খাবার নিয়ে জানতে ভালোবাসেন তারা নিশ্চই জানেন, বেকারির দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে ইউরোপীয়রাই অগ্রজ। তাদের তৈরি পাউরুটির কাছে সারা বিশ্ব এখনও পিছিয়ে পড়ে। এই বানমাস্কার বান বা পাউরুটিও স্বাদে আর গঠনে অভিনব৷ পাতে দেওয়ার সময় কুসুম গরম, নরম তুলতুলে, অসম্ভব সুন্দর স্বাদ। জিভে হাল্কা মিষ্টির সাথে অদ্ভুত পেলবতা ছড়িয়ে পড়ে। আর এই মাস্কা মানে মাখন কিন্তু বাজারের মাখন নয়। মানে আমুল বাটার বা বিভিন্ন কোম্পানির বাটার নয়। ইরানি কাফেগুলো যেমন নিজেদের বান নিজেরাই তৈরি করত মাখনও নিজেরাই করত। এক সময় এই মাখন ছিল আনসল্টেড। বর্তমানে সামান্য নুনের ব্যবহার থাকলেও তা একেবারে মোলায়েম। এই বান দিয়ে বার্গার বা অন্যান্য কোন খাবারই তৈরি হয় না। স্রেফ গরম গরম মাখনের সাথে মিলে প্রতি চায়ের সিপে এক কামড়েই বাজিমাত করে।

আসলে প্রত্যেকেই চায় তাদের বিশেষত্ব ধরে রাখতে। ইরানিদের গাঢ় দুধের ক্ষীর স্বাদের চায়ের সাথে এই বান মাস্কা ইরানিদেরই বিশেষত্ব। অন্য কেউ এরকম তৈরি করেছে বলে আমার জানা নেই৷ করলেও ইরানি কাফের মতো সুন্দর এবং মনোরম কখনই সম্ভব নয়।

জনপ্রিয়তার আরও একটা বড় কারণ হলো সস্তা। আজকের বাজারেও সস্তায় বলা যায়৷ এতো কম দামে মন ভালো করা স্বাস্থকর, পেট ভর্তি থাকবে এমন খাবার পাওয়া যায় না বললেই চলে৷ আর সস্তায় বিক্রির স্ট্র‍্যাটিজি নিজেকে শুধুমাত্র বিখ্যাত করে এমন নয়, সমাজের সমস্ত শ্রেণীর লোকের কাছে গুরুত্বও পায়৷ কোয়ালিটি ও সস্তা দুটো কথা একসাথে যায় না ঠিকই কিন্তু ব্যতিক্রম বলেও তো একটা কথা আছে৷ বানমাস্কা এমন ধরণেরই একটা খাবার৷

প্রথমবার খেয়েই প্রেমে পড়েছিলাম। আজও জিভে লেগে আছে বানমাস্কা। বর্তমানে বানমাস্কা যে শুধু মাখন দিয়ে পাওয়া যায় এমন নয়, সময়ের সাথে সাথে এরও অনেক ফিউশন ঘটেছে। সামান্য মিষ্টির স্বাদ আনতে জ্যামের ব্যবহার হয়। কিংবা বড় সাইজের অমলেটও দিয়ে দেওয়া হয় ভেতরে। অনেকে আবার ফ্লেভারড বাটারও ব্যবহার করে থাকে। সব কটা ফিউশন ভালো লাগলেও অথেনটিক খাবারের আলাদাই স্বাদ ও ঐতিহ্য থাকে আর সেটা আনসল্টেড মাখনের সাথে নরম ফোলা মিঠে বানেই পাওয়া যায়৷ গুডলাক কাফেতে গিয়ে আজও যখন খাই মনে করি একসময় দেশি বিদেশী মজুর, শ্রমিক ও অন্যান্য অফিসযাত্রীরা কোণার কাফেতে দাঁড়িয়ে খিদে পেটে আনন্দ ভরে দিচ্ছে, হাসছে, কথা বলছে… পথ ঘাট গাছ পালা আকাশ সকলেই তাদের দেখছে যেমন আমাকেও। যেন সৃষ্টি ও বিবর্তনের নির্বাক সাক্ষী।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *