হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

হরিদাদুর বলা জাহাজের গল্পগুলো বিট্টু তার স্বপ্নের রাজ্যে দেখতে পেল… সে স্বপ্নতে আপাতত হরিদাদুর সফরসঙ্গী। হরিদাদুর জাহাজ রেঙ্গুন শহরকে বিদায় জানিয়ে পেনাং-এর পথে। পেনাং শহর সুন্দর একটি দ্বীপ। সমুদ্রের পারেই পেনাং এয়ারপোর্ট।
তারপর… অষ্টম পর্বে…

পেনাং এয়ারপোর্টে বড় বড় হোটেল। বিদেশীদের ভিড়। জিনিসপত্র সস্তা সিঙ্গাপুরের মত ট্যাক্স ফ্রি শহর। এখানে ভারতীয় কে. কে বিড়লার তৈরী এশিয়ার বৃহত্তম কাপড়ের কারখানা। শহরের একপ্রান্তে রোপওয়ে ট্রলি ট্রেনে চেপে পাহাড়ের উপর লাভার্স গার্ডেনে যাওয়া যায়। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অনেক ভারতবাসী অধিকাংশই দক্ষিন ভারতীয় এবং ওখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছে। দুদিন পরেই পেনাং থেকে পোর্ট ক্ল্যাংয়-এ যাওয়া হল। ক্ল্যাং্ শহর মালয়েশিয়ার রাজধানী কোয়ালামপুরের খুব কাছেই। ক্ল্যাং শহরে মালয়েশিয়ার এক মন্ত্রীর সঙ্গে হরির আলাপ হয়। তিনি ক্ল্যাং শহরেই থাকেন। নিজের গাড়ীতে কোয়ালালামপুরে যাতায়াত করেন। তার জন্মস্থান ভারতের মাদ্রাজ শহরে ছিল। তিনি ভারতীয়দের দেখলেই আদর যত্ন করেন। হরিকেও তিনি তার বাড়ীতে আমন্ত্রণ জানান। তার একমাত্র মেয়ে আরতি কোয়ালালামপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কোয়ালালামপুর বিশ্ববিদ্যালয় খুব বড় এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। ছোট ছোট পাহাড়ের পাশে সবুজ ঘাসের লন। লনের উত্তর পূর্ব দক্ষিণ পশ্চিম সব দিকেই ইউনিভাসিটির বিল্ডিং। বিভিন্ন বিল্ডিং-এ বিভিন্ন ভাষায় আরবী ফার্সী সংস্কৃত ইংরেজী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপরও ক্লাস হয়। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। আরতি গাড়ীতে হরিকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিয়ে পেনাং শহরে ড্রাইভ করে নিয়ে যায়। পেনাং শহর খুব কাছেই একটি মালয়েশিয়ার ছোট দ্বীপ। ফেরীতে পারাপার হওয়া যায়। গাড়ী নিয়ে ফেরী বোটে সোজা ড্রাইভ করে, পেনাং শহরের ভিতর চলে যায়। সমুদ্রের পাড়ে একটি ওপেন রেষ্টুরেন্ট সবুজ ঘাসের উপর চেয়ার টেবিল আছে। ওখানে বসে মেনু দেখে চা ও বিভিন্ন খাবার অর্ডার দেওয়া হল। আরতি বড়লোকের মেয়ে। দুহাতে টাকা খরচ করছে। হরি মনে মনে লজ্জিত হয়। কিন্তু আরতির হরির সঙ্গ বেশ ভালো লাগছে। হরির মত স্মার্ট একজনকে পেয়ে নিজেকে মুক্ত ডানা মেলে যাওয়া পাখির মত মনে হচ্ছে। এরপর আরতি হরিকে সমুদ্রের তটরেখা দিয়ে গাড়ী করে বহুদূরে নিয়ে যায়। গাড়ী থামান হল রোপওয়ে ট্রলি ট্রেন স্টেশনে। ঐ ট্রেনে করে দুজনে উঠে গেল পাহাড়ের উপর গার্ডেনে। সেই গার্ডেনের একটি চেয়ারে দুজনে পাশাপাশি বসে কত কথা বলল। হরি দু’দিনের জন্য এখানে এসেছে। সে স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে আরতির সাথে জড়ালো না। যতটা দূরত্ব বজায় রাখা যায়, সে তাই করল।
যাই হোক, সেখানে একটি কাচের ঘরে বিভিন্ন ধরনের সাপের প্রদর্শনী। তার পাশেই রয়েছে গার্ডেনে গাছের তলে বসার স্থান। ওখানে ছোট্ট দোকানে ঠাণ্ডা বা গরম ড্রিংক্স ও স্ন্যাক্স পাওয়া যাচ্ছিল। তবে দাম আকাশ ছোঁয়া। আরতি কোনও কৃপণতা দেখাল না। সে হরিকে ড্রিংক্সের অফার করল। হরি ড্রিংক্স করা থেকে বিরত থাকল। আরতির চোখে সে আরও সম্মান আদায় করে নিল। হরিকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। হরি সেটা বুঝতে পেরেছে। সে যতটা সম্ভব আরতির আহ্বানকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হরি আরতিকে একটা ছোট্ট শপের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল। সেই ছোট্ট শপ সুন্দর ভাবে সাজান, সবসময়ই গান হচ্ছে। আকাশের মেঘ যেন ধোয়ার মত হাতের পাশ দিয়ে চলে যায়। মনে হয় যেন স্বপ্নের দেশে মেঘের উপর বিচরণ করা হচ্ছে। ঐ উঁচু পাহাড় থেকে নীচে শহরকে খুব সুন্দর দেখা যায় যেন তুলিতে আঁকা ছোট ছোট বাড়ী। অনেকক্ষন হয়ে গেল এবার ফেরার পালা। আরতি গাড়ী চালিয়ে আবার ফেরী বোটে করে কোয়ালালামপুরের রেলষ্টেশনের পাশ দিয়ে সোজা ক্ল্যাং-এর পথে রওনা হল। কোয়ালালামপুর ষ্টেশনে সন্ধ্যায় ট্রেনে উঠলে ভোরে সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়া যায়। আরতি এবার বাড়ী ফেরার জন্য দ্রুত গতিতে গাড়ী চালাতে থাকে। বাড়ী ফিরতে রাত ন’টা হয়ে গেল। ওদেশে শাসন ব্যবস্থা খুব কড়া। পথে কখনও সিক্যুরিটির অভাব বলে মনে হয় নি। এমনকি বাড়ীর লোকেরা যদিও অধীর আগ্রহে হয়ে অপেক্ষায় আছে ওদের জন্য তবুও আরতিকে কেউ কোন কথা বলেনি। বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার টেবিলে ডাক পড়ে গেল। রাত্রির ডিনার শেষে হরি তার জাহাজে ফিরে গেল। হরি আরতিকে বিদায় জানাতেই দেখল, আরতির চোখে জল। সে মনের কথা হরিকে জানাতে চেয়েছিল। হরি বুঝতে পেরে বলল,
“আমি জাহাজে করে বিভিন্ন দেশে যাই। আমাদের সাথে বেশী জড়িয়ে থাকলে কষ্ট বেশী হবে আরতি। আমি আবার আসব, আবার দেখা হবে, কথা হবে। একসাথে আনন্দ করব। এই দুদিনে তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে। তুমি ভালো থেকো”।
পরের দিন জাহাজ সিঙ্গাপুরের দিকে রওনা হবে। অবশেষে জাহাজ ছেড়ে দিল সিঙ্গাপুরের দিকে। সিঙ্গাপুর খুব দূরে নয়। জাহাজে একদিনেরও কম সময় লাগে। জাহাজ সিঙ্গাপুর নোঙ্গর করল। ফেরী বোট (ছোট বোটে) শহরের ফেরীঘাটে পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর সবদেশের লোক এখানে শপিং করতে আসে। সুন্দর শহর। আইন শৃঙ্খলা খুব কড়াকড়ি। সিঙ্গাপুর একবছর পৃথিবীর ক্লিনেষ্ট সিটি বলে সম্মান পেয়েছিল। জাপান ছাড়া আর কোন এশিয়ান দেশই এই সম্মান পায় নি। এখানে অনেক দক্ষিণ ভারতীয়দের বসবাস। ভারতের ওপর এদের অগাধ ভালবাসা। এই সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র তার আজাদহিন্দ ফৌজ তৈরী করে ভারতের বৃটিশ সরকারকে আক্রমন করেছিলেন। তারা গেয়েছিল “কদম্ কদম্ বাড়ায়ে চল্”। বৃটিশ সরকার ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে। সিঙ্গাপুরে চার ভাষী মানুষের বসবাস- ইংরাজী, তামিল, চীনা, ও মালয়েশিয়ান। এখানে সবই রাষ্ট্র ভাষা। যে কোন জাহাজ ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যেতে হলে সিঙ্গাপুরে তেল নেওয়ার জন্য থামাতেই হয়। সিঙ্গাপুর খুব ব্যস্ত বন্দর। এখানে প্রায় সবসময় কমপক্ষে একশ জাহাজ নঙ্গরে থাকে। সিঙ্গাপুর নিজেই একটি দ্বীপ। একটি বড় ব্রীজ দিয়ে মেন্ ল্যাণ্ড মালয়েশিয়ার সঙ্গে যুক্ত। সিঙ্গাপুর ছোট দেশ। সমুদ্রের মধ্যে কতগুলি ছোট ছোট দ্বীপ ও সিঙ্গাপুরের অধীনে। কাছাকাছি একটি ছোট দ্বীপে অপরিশোধিত তেল পরিশোধিত হয় এবং পরিশোধিত তেল সব বিদেশী জাহাজে বিক্রয় করে অনেক বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে। সিঙ্গাপুর জাপানের পরেই এশিয়ার মধ্যে উন্নত দেশ। ফেরী বোটের ঘাট শহরের মেন রাস্তার পাশে। ফেরী ঘাট থেকে অবতীর্ন হলেই রবিনসন শপিং সেন্টার। অবশ্য সমস্ত শহরই একটি সাজান শপিং সেন্টার বলা চলে। শহরের ভিতর অদূরে টাইগার বাম্ গার্ডেন। ওখানে বিভিন্ন ফান ফেয়ার। ওখানে দুই পহাড়ের মধ্যে রোপ ওয়ে কেবল্ চলাফেরা করে। এখানে কলকাতার ফোর্ট উলিয়ামের মত আন্ডারগ্রাউন্ড সেনার ঘাঁটি আছে। অদূরে আরও কয়েকটি দ্বীপ সমূদ্রে মাথা উচু করে আছে। এইসব ছোট্ট দ্বীপগুলো সবই সিঙ্গাপুরের অন্তর্ভুক্ত। খোলা আকাশের নীচে ঐ দ্বীপগুলো ছোট ছোট পাহাড় নিয়ে বিশাল সমূদ্রের বুকে মাথা উচু করে আছে। এখানে সমূদ্র একবোরে শান্ত। ঢেউ তেমন নেই। টাইগার বাম্ গার্ডেন ছোট্ট পাহাড়ের উপর। সিঙ্গাপুরে সন্ধ্যে হয়ে গেলেও সে দেশ আলোয় ঝলমল- কোন অন্ধকার নেই। লোড্ শেডিং নেই। সুন্দর সুন্দর গ্রীন, ব্লু বাস চলে যায় ওখান থেকে টার্নজিংপাগার শপিং সেন্টার। বড় রাস্তার উপর দিয়ে শপিং সেন্টার। একটি ব্রীজ এপার-ওপার দুদিকেই বড় বিল্ডিং এমনকি ব্রীজও সুন্দর শপিং সেন্টার। বড় বড় দোকানে সব রকমের জিনিসেই কেনা যায়। বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন প্রকারের জিনিস পত্র। যেন এলাহি ব্যাপার। বিল্ডিং দুটির নীচের তলায় বিভিন্ন হোটেল রেষ্টুরেন্ট। কাছেই সিঙ্গাপুর মেন রেল ষ্টেশন। ষ্টেশনের উপরেও হোটেল, ডিপার্ট মেন্টাল শপ। টানজিংপাগারের নীচে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সমূদ্রের পাড় ঘেসে একদিকে রেস্ কোর্স ময়দান, বিভিন্ন খেলার ক্লাব ঘর পাশেই বড় সিটি হল।
রাস্তার অপর পাশে বড় পার্ক ঠিক সমূদ্রের তটরেখায়। সন্ধার সময় সুসজ্জিত পার্কের ভেতর অনেক লোকের ভীড়। সিটি হলে প্রায়ই ভারতীয় মিউজিকের অনুষ্টান হয়। পার্ক থেকে একটু বড় রাস্তা এগিয়ে গেলেই ভারতীয়দের শাড়ী ও অন্যান্য জামা কাপড়ের দোকান। ওখানে অনেক সিনেমা হলও আছে। বেশীর ভাগ হলে ইংরেজী এবং হিন্দী ছবি চলে। চীনারাও হিন্দী ছবি দেখে। হিন্দি ছবি সব সময় হাউসফুল। হরিও সেই সুসজ্জিত সিনেমা হলে ঢুকে দু’দুটো সিনেমা দেখে ফেলল।
——————–
হরি কি সিনেমা দেখল? তারপর?… পড়ুন পরের পর্বে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *