সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাস অগ্নিভাস সিরিজে তথাগত দত্ত

দেহবণিক

পর্ব: ১

চারদিক অন্ধকার। দূরে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে আছে ঠিকই, তবে তার বিন্দুমাত্র আভা এসে পড়ছে না এখানে। অগ্নিভাস একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অগ্নিভাস অর্থাৎ অগ্নিভাস সেন। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। ছিমছাম চেহারা। বয়স ঊনত্রিশ। হাতে লোডেড রিভলভার।
রাত প্রায় একটা। হঠাৎ অন্ধকারে কিছু একটা নড়ে উঠল বলে মনে হল। অগ্নি আরও সতর্ক হয়ে উঠল। অগ্নিভাসের দৃষ্টি প্রখর। সে জানে, কীভাবে ধরতে হয় অপরাধীকে।
কয়েকদিন আগের কথা। বিবাদীবাগে ওর একটা কাজ ছিল। তার আগে অবশ্য ওকে এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের একটা পাঁচ তারা হোটেলে সময় কাটাতে হয়েছিল। অগ্নিভাস হোটেলের ৩০২ নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ডান হাতটা মুখের সামনে তুলে এনে কবজিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দুপুর একটা পঞ্চান্ন। পরক্ষণেই সে দরজায় টোকা দিল আলতো করে। তারপর বেশ কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা।
একটা টেক্সট মেসেজ ঢুকল অগ্নিভাসের ফোনে— ‘খোলা আছে’। অগ্নিভাস চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল তারপর সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়ল ৩০২ নম্বর ঘরে। ফাইভ স্টার হোটেলের রয়্যাল সুইটের সৌন্দর্যকে সে অগ্রাহ্য করে শুধু অনিলীনা গুপ্তাকেই খুঁজে চলেছিল। কিন্তু কাউকেই অগ্নিভাসের চোখ তাকে দেখতে পেল না। বাঁ দিকে মেহগনি কাঠের টেবিলে রাখা একটা অ্যান্টিক ঘড়িকে পিছনে ফেলে একটু এগোতেই টয়লেট। টয়লেটের দরজায় হাত ছোঁয়াতেই দরজা খুলে গেল। অগ্নি দেখল, বাথটাবে একটা বিবস্ত্র মেয়ের শরীর। ‘খোলা আছে’ কথাটার যে কতরকম মানে হতে পারে, তা ভেবে অগ্নির ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি খেলে গেল।
অনিলীনা তার ভেজা আঙুল তুলে অগ্নিভাসকে কাছে ডেকেছিল। অগ্নি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল অনিলীনার দিকে। অগ্নিভাসের মনে হয়েছিল, এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলেই অনিলীনার যৌবনের উত্তাপে বাথটাবের সমস্ত জল ফুটতে শুরু করবে। তাই দু’হাতে তার নরম শরীরটাকে তুলে অগ্নিভাস এনে শুইয়ে দিল নরম বিছানায়। অনিলীনা দু’হাতে অগ্নিভাসের গলা জড়িয়ে ধরেছিল আর অগ্নিভাস মুখ রেখেছিল অনিলীনার স্তনের বোঁটায়।
অগ্নিভাস অনিলীনার ভেজা ঊরুসন্ধিতে জিভ ঠেকাল। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অনিলীনা আর অগ্নির জিভ আদর করে চলেছে অনির ঊরুসন্ধিস্থলে। অনি চেয়েছিল, অগ্নি তার পায়ুমন্থন করে তুলে আনুক তৃপ্তির অমৃত। এই পেশাটাই এমন, অগ্নির এই রুপসি অনিলীনার যোনি সম্ভোগ করার ইচ্ছা থাকলেও কিস্যু করার নেই। ক্লায়েন্টের ইচ্ছাই এখানে শেষ কথা।
সব কিছুর পর অনিলীনা গুপ্তা বলেছিল, অগ্নি, তোমাকে আমার দারুণ লেগেছে। আবার আসবে তো?
সার্টেইনলি ম্যাম। আপনার সেবায় সবসময়। অগ্নি বলেছিল। অগ্নিভাসের আকর্ষণীয় চেহারা যে কোনও সুন্দরীকে আবিষ্ট করে তোলে।
অগ্নি পোশাক পরে নিয়েছিল। কিন্তু অনি বিবস্ত্র অবস্থায় গা এলিয়ে পড়ে থাকল বিছানায়। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে তৃপ্ত।
অনিলীনা হাতে ফোন তুলে নিয়ে অগ্নিভাসকে অনলাইন পে করতে করতে বলেছিল, জানো অগ্নি, তোমার সামনে ল্যাংটো হয়ে থাকার আলাদা একটা মজা আছে। তোমার শরীর আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তুমি আমার শরীর দেখতে পাচ্ছ! এটা ভাবলেই আলাদা একটা ফিল আসছে।
অনির শরীরের সুগন্ধ তখনও অগ্নিভাসের পোশাকে লেগেছিল। অনিলীনার সঙ্গে সময় কাটিয়ে অগ্নি বিবাদীবাগ অঞ্চলের একটি ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট অফিসে গিয়েছিল। পুরোনো আটতলা বাড়ি। তার একদম উপরের তলায় আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স। তখন পাঁচটা বেজে গিয়েছে। প্রায় সমস্ত অফিসই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু খোলা বলতে এই আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স আর দোতলার একটি অফিস। খুব সম্ভবত ট্রাভেল এজেন্সি হবে কোনও।
অগ্নি লিফটে ঢুকে আট নম্বর বোতাম টিপল। লিফট উঠতে শুরু করল। লিফট থামল চারতলায়। আর দরজা খুলতেই চারজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল অগ্নিভাসের ওপর। তাদের পরনে কালো পোশাক। মুখও ঢাকা কালো কাপড় দিয়ে।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে অগ্নি দ্বিতীয় লোকটিকে ধরাশায়ী করে ফেলল এক মুহূর্তে। বাকি তিনজন তখন ওকে কাবু করার চেষ্টা করে চলেছে আপ্রাণ। কিন্তু তারা পারল না। তৃতীয় আর চতুর্থ লোকটিই বরং কাবু হয়ে পড়ল অগ্নিভাসের লাথি আর ঘুসিতে। চোখের নিমেষে এসব কাণ্ড ঘটে গেল। লিফট এসে পৌঁছেছে আটতলায়। দরজা খুলতেই প্রথম লোকটি ঝড়ের বেগে দৌড়তে শুরু করল। এ-ই সম্ভবত দলের পান্ডা। অগ্নিও পিছু নিল তার। লোকটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। অগ্নিভাসও তা-ই। পুরোনো বাড়ির সিঁড়ি যেমন হয়, বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বিস্তৃত।
লোকটি প্রায় চারতলায় পৌঁছে গিয়েছে। অগ্নি তখন ওর থেকে মাত্র হাত ছ’য়েক দূরে। অগ্নিভাস হঠাৎ থেমে গেল। কিন্তু লোকটি দৌড়েই চলেছে। লোকটি চারতলা ছাড়িয়ে এবার তিনতলার দিকে নামতে শুরু করল। আর অগ্নিভাস? অগ্নিভাস তখন সিঁড়ির রেলিংয়ে উঠে পড়েছে। লক্ষ্য স্থির। আর হঠাৎই সে হিংস্র চিতার মতো মারল লাফ। মাঝখানে প্রায় চোদ্দো ফুটের ব্যবধান। পড়লে পরে সোজা গিয়ে পড়বে একতলায়। অবধারিত মৃত্যু! তবে না। সেরকম কিছুই হয়নি। হবেও না। কারণ, লোকটির নাম অগ্নিভাস সেন। সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সেই লোকটির ঘাড়ে। লোকটি আর্তনাদ করে পড়ে গেল। আর অগ্নি তখন এলোপাথাড়ি ঘুসি আর লাথি মারতে থাকল লোকটির মুখে, পেটে। লোকটির মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারিয়েছে।
নিশ্চিত হতে অগ্নি লোকটির নাকে আঙুল ঠেকাল। নাহ। মরেনি। শ্বাস চলছে। আঙুল সরিয়ে নিয়ে অগ্নি সোজা হয়ে দাঁড়াল, আর ঠিক তখনই বাকি তিনজন পিছন থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। তিনজনের এলোপাথাড়ি আক্রমণে অগ্নি ধরাশায়ী হয়ে পড়ল।
সেই তিনজনের একজন কর্কশ গলায় বলে উঠল, তুই আজ আমাদের বসের ক্ষতি করে খুব ভুল করলি। তুই নিজের কবর নিজে খুঁড়লি, সেটা জেনে রাখিস।
অগ্নিভাসের নাক থেকে তখন রক্ত ঝরছে গলগল করে। সে এই অবস্থাতেও গর্জন করে উঠল, চুপ কর। আমি নিজের কবর নিজে খুঁড়ি না। বরং তোদের দিয়েই আমি কবর খোঁড়াব। আর সেই কবরে মাটি চাপা দিয়ে মারব তোদের এই বসকে। মিলিয়ে নিস।
অগ্নি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। তবে তৃতীয় লোকটি ঠিক তার পিছনেই ছিল। সে একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কোমরে রাখা রিভলভার বের করে অগ্নিভাসের মাথায় সজোরে মারল এক বারি। অগ্নিভাসের অচৈতন্য দেহটি ধপ করে পড়ল সিঁড়িতে। তারপর নীচে গড়িয়ে গেল কয়েক ধাপ।
সেযাত্রায় বড়ো কোনও ক্ষতি হয়নি। বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি এসে অগ্নিকে উদ্ধার করেছিল। চোখে মুখে জল দিতেই জ্ঞান ফিরল। আর জ্ঞান হতেই ও বুঝল, এই সুযোগে চারটে ক্রিমিনালই পগারপাড়।
সিকিউরিটি বলল, আপনার এ অবস্থা কে করল, স্যার? ওরা? ওরা কি আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল?
অগ্নি বলল, ন্যাকাচোদা! এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি সিকিউরিটি হয়েছ! ওরা যখন কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ঢুকল, তখন তোমার সন্দেহ হল না?
সিকিউরিটি আমতা আমতা করে বলল, মানে স্যার, দেশের বাড়ি থেকে বউ এসেছে অনেকদিন পর। মানে আমি একটু ইয়ে করছিলাম আর কী! তাই দেখতে পাইনি।
— তা ঢোকার সময় না হয় ইয়ে করছিলে, দেখোনি। যখন ওরা বেরোল, তার অনেক আগেই তো তোমার উইকেট পড়ে যাওয়ার কথা! তুমি তো ফ্রি ছিলে। তখন কী করছিলে বাপ?
— স্যার, কী করব বলুন! ওদের দেখেই তো আমার মাথায় উঠে গিয়েছিল ভয়ে।
— ওরা ঢোকার সময় তুমি সামনে থাকলে, তখনও তোমার মাথাতেই উঠে যেত। কাজেই বউয়ের অজুহাত দিয়ো না দয়া করে!
সেদিন সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ওদের গাড়ির নম্বর ধরা পড়েনি। তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি বলতে গেলে। তবে আজ অগ্নিভাস পুরো তৈরি হয়ে এসেছে। ওর কাছে আগে থেকেই খবর ছিল, ওই চার মূর্তি আজ রাতে কবরখানায় ঢুকবে লাশ চুরি করতে।

(ক্রমশ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *